হিল ভয়েস, ২৭ জুলাই ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক:
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের উপর শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার আবার অবান্তর, বিতর্কিত, অহেতুক বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে জারি করা সরকারের এই নির্দেশনাকে ‘সরকারের আদিবাসী ভুত’, ‘পুরোটাই আঁতেলগিরি’ বলে অভিহিত করেছেন অনেক নেটিজেন।
এক নেটিজেন বলেছেন, ‘আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না এরকম কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও নাই।’ আরেক জন বলেছেন, ‘১৯৯৩ সালে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করতে পারলে ২০২২ সালে কেন পারবেন না?’ আরেক নেটিজন ক্ষোভ জানিয়ে দাবি করেছেন, “বাংলা ভাষা থেকেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি তুলে দেওয়া হোক।”
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুলাই ২০২২ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় (টিভি-২ শাখা)-এর উপসচিব শেখ শামছুর রহমানের স্বাক্ষরিত ‘সংবিধান সম্মত শব্দ চয়ন প্রসঙ্গে’ শীর্ষক এই নির্দেশনা জারি করা হয় হয়। ‘সদর দপ্তর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের ০৪.০৭.২০২২ তারিখের ২২ সংখ্যকপত্র’ বরাত দিয়ে এই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, “বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।”
উক্ত নির্দেশনায় আরো বলা হয় যে, “০৯ আগষ্ট ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত টকশো-তে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”
এটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে ১৯৯৩ সালে এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০০ ও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে ‘আদিবাসী’ শব্দ উল্লেখ করে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিলেন। এমনকি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইসতেহারে ‘আদিবাসী’ শব্দটি উল্লেখ করে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও বেহাত হওয়া জায়গা-জমি পুনরুদ্ধারের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন।
আরো উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক জাতীয় ও বিশেষ আইনে আদিবাসী শব্দটির স্বীকৃতি রয়েছে। যেমন ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে ‘আদিবাসী পাহাড়ি’ (indigenous hillmen), ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসী (aborginal), ১৯৮৪ সালের আয়কর আইনে ‘আদিবাসী পাহাড়ি’ উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলতে ‘আদিবাসীদেরকে’ বুঝানো হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। হাইকোর্টের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় এবং সরকারের বিভিন্ন দলিলেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস সামনে আসলেই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষগুলোর আদিবাসীদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠে, যার সর্বশেষ উদাহরণ হলো প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের সদর দপ্তর থেকে জারিকৃত ১৯ জুলাই ২০২২-এর নির্দেশনা।
অথচ আইএলও’র কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর ছাড়াও সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০০৭ সালের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করা এবং আইএলও’র ১৯৮৯ সালের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠী বিষয়ক ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষরের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এমনিতর অবস্থায় সরকারের ১৯ জুলাই ২০২২-এর নির্দেশনায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অজুহাত প্রদর্শন করে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না বা কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ইত্যাদি নামেই উল্লেখ করতে হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের আইনে নাই। এরকম কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও নাই।”
তিনি আরো বলেছেন, “আমাদের সংবিধানে একটি মূলনীতি সংযোজিত হয়েছে অনুচ্ছেদ ২৩ক হিসাবে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” এটা হচ্ছে রাষ্ট্রপরিচালনা মূলনীতি সমূহের একটা, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এই মূলনীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করা। এটাকে আপনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির একদম প্রথম দফাটির সাথে মিলিয়ে পড়তে পারতেন- অনেকাংশে একইরকম। এই মূলনীতিগুলি রাষ্ট্রের লক্ষ্য, এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে এই মূলনীতির কোনটাই আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যাবে না।”
মেহেদী হাসান নোভেল নামে আরেক নেটিজেন উল্লেখ করেছেন, “শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পল্টি! বিরোধী দলে থাকার সময় এমনকি ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাণীতে বাংলাদেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাওতাল, ওরাও, মুন্ডা ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে এড্রেস করেছেন। কিন্তু এখন তিনি রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপন জারি করছেন যাতে আদিবাসীদের আদিবাসী না বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা হয়। ১৯৯৩ সালে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করতে পারলে ২০২২ সালে কেন পারবেন না? অবিলম্বে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই।”
অশোক কুমার চাকমা সরকারের নির্দেশনাকে ‘পুরোটাই আঁতেলগিরি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার ফেসবুক ওয়ালে তিনি আরো লিখেছেন, “আন্তর্জাতিক আইনে এখন বলা হয় Indigenous Peoples. এখন এই Indigenous Peoples শব্দটির বাংলা অনুবাদ ‘আদিবাসী’ রাখবেন নাকি রাখবেন না, সেটা সরকার বাহাদুর সংবিধানের দোহাই দিয়ে ঠিক করেন। যেহেতু সংবিধানে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, সম্প্রদায় ও নৃ-গোষ্ঠী বলা হয়েছে, সেহেতু বাংলা অভিধান থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাতিল করা হোক। বাংলা ভাষা থেকেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি তুলে দেওয়া হোক। সংবিধান কেন শুধু মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য হবে!”
সজীব চাকমা এটাকে ‘সরকারের আদিবাসী ভুত’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সংবিধানে নিজের ইচ্ছানুসারে সরকার আদিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘উপজাতি’, ‘সম্প্রদায়’ ইত্যাদি অভিহিত করেছে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে তা করতেও পারে। কিন্তু সংবিধানে তো বলা হয়নাই যে, কেউ ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবে না।”