অং-ম্রান্ট-অং
২০২২ সালের প্রথম দিকে হঠাৎ ফেইসবুকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ নামের একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম প্রচার চোখে পড়ে। এ সংগঠনের লোকজন Kuki-Chin National Front-KNF নামক একটি ফেইসবুক পেইজ থেকে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত ভিডিও এবং কর্মীদের ভিডিও, ছবি, রাজনৈতিক বক্তব্য, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্ম জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে দীর্ঘ বছর আন্দোলন-সংগ্রামরত রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনামূলক মিথ্যাচার, আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের স্বাধিকার এবং অস্তিত্ব বিরোধিতাকারী শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর সমর্থনে জনমত যোগাড় করার কাজ চালিয়ে যেতে দেখা যায়। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলা আলীকদম, লামা, থানছি, রুমা, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বাঘাইছড়িকে কুকি-চিন অঞ্চল (Territory) দাবি করে একটা স্টেট বা রাজ্য স্থাপনের একটা মানচিত্র দেখিয়েছে। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং- এই জুম্ম আদিবাসী জাতিসত্তাকে কুকি গোত্র বা কুকি-চিন জনগোষ্ঠী বলে দাবি করতে দেখা যায়। এই হলো Kuki-Chin National Front-KNF এর কার্যক্রমের মোটামুটি চিত্র।
Kuki-Chin National Front-KNF এর প্রচারিত তথ্য থেকে জানা যায়, এ সংগঠনের নেতা বা সভাপতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা উপজেলা সদরে এডেন রোড পাড়া নিবাসী নাথান বম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজন চিত্রশিল্পী এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চিত্রশিল্প প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার লাভ করেছেন।
Kuki-Chin National Front-KNF নামক রাজনৈতিক সংগঠনটির জন্মলাভ হয়েছে সেনাবাহিনীর সার্বিক পরিচালনায়। সংগঠনটির পূর্ব নাম ছিল Kuki-Chin National Development Organization (KNDO)। ২০০৮ সালে রুমা বাজারের এডেন রোডে সংস্থাটির অফিস স্থাপন করা হয়। সংস্থাটির কার্যক্রম বান্দরবান জেলা সদরে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মোঃ নকীব আহমেদ চৌধুরী এর মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তীতে এ সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রমেও উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রুমা জোনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে সংস্থাটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, Kuki-Chin National Development Organization (KNDO) এবং পরবর্তীতে Kuki-Chin National Front-KNF সেনাদের প্রত্যক্ষ মদদে ও ব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট। ফলে সংগঠনটির নেতারা তাঁদের জন্মদাতা সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং সেনাবাহিনীর দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
Kuki-Chin National Front-KNF গোঁজামিল অসত্য তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থাপনের দ্বারা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত। এ সংগঠনটি কুকি-চিন জনজাতি সংগঠিত করার জন্য গোঁজামিল তথ্য তৈরি করে চলছে। এ সংগঠনের নেতারা বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দুটি দেশ ভারতের ‘কুকি’ এবং মায়ানমারের ‘চিন’ জাতি থেকে দুটি শব্দ যুক্ত করে ‘কুকি-চিন’ জনজাতি নামকরণ করেছে। সাধারণত এভাবে যুক্ত হলে হয় ‘বম’। Kuki-Chin National Front-KNF বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো এবং খিয়াংকে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জাতিসত্তা হিসেবে দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মায়ানমারে খুমি ও ম্রো জাতি আরাকানি জাতি হিসেবে স্বীকৃত। ফলে তাদের জনগোষ্ঠী তত্ত্বটি ভুয়া।
শুধু তাই নয়, Kuki-Chin National Front-KNF অসত্য ইতিহাসের তথ্য হাজির করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস পরিবর্তন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে বম, পাংখোয়া, লুসাইসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসমূহকে বড় জুম্ম জাতি কর্তৃক অন্যায়, বঞ্চিত, নিপীড়ন ও বিতারিত করার কোনো ইতিহাস নেই। সেরকম যদি হতো তাহলে বমদের মধ্যে কেউ হেডম্যান থাকতো না। কোনো জুম্ম আদিবাসী জাতি কর্তৃক বম, পাংখোয়া, খিয়াং, লুসাই, চাক, ম্রোদের ভূমি কেড়ে নিয়ে নিজের লোকজনকে বসতিস্থাপন করানোর কোনো ইতিহাস নেই। অথচ Kuki-Chin National Front-KNF ফেইসবুক পেইজ থেকে কাল্পনিক কাহিনী সাজিয়ে আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে মনোগত বিভাজন ও বিদ্বেষ সৃষ্টির প্ররোচনা প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছে। এর দ্বারা আদিবাসী জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি, বিভেদ ও বিদ্বেষ জাগিয়ে নেতারা নিজেদের সামান্য হীনস্বার্থের বিনিময়ে আগ্রাসী ও সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ এবং উদ্দেশ্য-লক্ষ্য পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য সংগঠনটির নেতারা কাজে নেমে গেছে।
Kuki-Chin National Front-KNF এর বক্তব্যে সেনাবাহিনীর সুর। লক্ষ্য রাখলে দেখতে পাবেন যে, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বাস্তবায়ন এবং জুম্ম আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তার নেতাদের বিরূদ্ধে সেনাবাহিনী যেভাবে আখ্যা-ব্যাখ্যা ও অভিযোগ করে থাকে, ঠিক একইভাবে কেএনএফও আখ্যা-ব্যাখ্যা, অভিযোগ করে থাকে। তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জুম্ম আদিবাসীদের স্বার্থের বিপক্ষে সমস্ত বিষয়বস্তু এবং মতামত কেএনএফ প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, নিপীড়ক-বঞ্চনাকারী শাসকগোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীর বক্তব্য ও প্রচার-প্রচারণাকে অকুণ্ঠমনে সমর্থন দিয়ে চলেছে।
Kuki-Chin National Front-KNF এর সস্তা প্রতারণামূলক কর্মকান্ড সুস্পষ্ট। জুম্ম আদিবাসীদের ছয় জাতিসত্তাকে কুকি-চিন জনগোষ্ঠী দাবি করে প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত হলেও লামা, আলীকদম, চিম্বুকসহ সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্রো, খিয়াং, খুমি, বম, পাংখোয়াসহ আদিবাসীদের ভূমি দখলের প্রতিবাদে নাথান বম ও কেএনএফ এর কোনো বক্তব্য আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আলীকদম, থানছি, রুমা, রোয়াংছড়ি হতে দেশান্তরী হতে বাধ্য হওয়া ম্রো, বম, মারমাদের নিয়ে কেএনএফ সংগঠনের কোনো মাথাব্যথা নেই, দৃষ্টি নেই। ২০১৫ সালের দিকে খাদ্যাভাব এবং সেনাসমর্থিত বহিরাগত বাঙালিদের নিপীড়নে পড়ে দেড় হাজারেরও অধিক ম্রো জাতির লোকজন আলীকদমের পোয়ামুরী এলাকা থেকে মায়ানমারে দেশান্তরী হয়েছে। বর্তমানেও শাসকদের নিপীড়নে পড়ে বিভিন্ন এলাকার আদিবাসীগণ কেউ ভিন দেশে, কেউবা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে বাধ্য হচ্ছে; তা নিয়ে কেএনএফ এর কোনো উদ্বেগ নেই। বরং যাঁরা আদিবাসীদের ভূমিসহ অন্যান্য অধিকার নিয়ে কথা বলেন এবং কাজ করেন তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় ও মিথ্যা প্রচারণায় কেএনএফ ব্যস্ত থেকেছে। এ সংগঠন তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু জেএসএস অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (মূল দল) এবং তার নেতৃবৃন্দ। জেএসএস, জেএসএস এর সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং চাকমা জাতি কেএনএফ এর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালি, শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে অধিকারকামীদের বিপক্ষে বানোয়াট কাহিনী প্রচার-প্রচারণা এবং আদিবাসীদের ভয় ছড়ানো ছাড়া কেএনএফ এর কোনো উপস্থাপনা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালি ও সেনাবাহিনীর স্বার্থে বক্তব্যগুলো সংগঠনটির নেতৃবৃন্দকে ভীষণ খুশি হতে এবং সহমত জানাতে দেখা যায়। এর ফলে তাদের নিজেদের বঞ্চিত এবং অধিকারকামী দেখানো অজুহাত ও প্রতারণা বৈ কিছু নয়।
কেএনএফ এর স্ববিরোধিতা বিষয়ে সকলে সচেতন হতে শুরু করেছে। কেএনএফ ও তার নেতারা নিজেকে নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অধিকারকামী জনসাধারণের পক্ষে লড়াইকারী চিত্র অঙ্কন করে জনগণের এবং মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষের সমর্থন লাভের চেষ্টা করে আসলেও দিন দিন তাদের স্ববিরোধী চরিত্র প্রকাশ হয়ে পরিষ্কারভাবে সবার কাছে ধরা দিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অধিকারকামী মানুষ আরেক নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অধিকারকামী মানুষ বা সংগঠনকে শত্রু মনে করে না অর্থাৎ শোষক, শাসক, নিপীড়ক, বঞ্চনাকারী, অধিকারহরণকারীই শত্রু হয়ে থাকে। কিন্তু কেএনএফ ও তার নেতারা শোষক, শাসক, নিপীড়ক, বঞ্চনাকারী, অধিকারহরণকারীকে শত্রু হিসেবে লক্ষ্যবস্তু করে না। কেএনএফ ও তার নেতারা শোষক, শাসক, নিপীড়ক, বঞ্চনাকারী, অধিকারহরণকারীদের কর্মকান্ডে কোনো বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করে না; বরং তাঁদের কর্মকাণ্ডকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাছ-বিচারহীনভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত বাঙালিদেরকেও নিরীহ বাঙালি আখ্যায়িত করে তাদেরকে স্বীকার করে নিয়েছে। কেএনএফ ও তার নেতাদের কাছে শত্রু হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা। পরবর্তীতে তাঁরা ম্রোদেরও শত্রু করবে। এটি চরম স্ববিরোধী দালালি চরিত্র।
সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর পক্ষে দালালি করার জন্য কেএনএফ সংগঠনের সৃষ্টি। কেএনএফ এর জন্ম ও লালন-পালন হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বারা। এটি সকলের নিকট স্পষ্ট। সংগঠনটি রাজনৈতিক ও সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করার পর লক্ষ্য করা যায়, সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধ ও কার্যক্রমকে জায়েজ এবং সমর্থন করার কাজ প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে। কেএনএফ ও তার নেতারা বহিরাগত ধনী বাঙালি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ আদিবাসীদের কৃষিভূমি দখলের বিরুদ্ধে কখনো কোনো প্রতিবাদ করে না; সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করে না। আরো অবাক করার ব্যাপার হলো, চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পূর্বে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত লালরিজাপ বম এর ঘটনাকে সেনাবাহিনীর বক্তব্যের অনুরূপ শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত বলে প্রকৃত সত্য ঘটনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি সেনাবাহিনীর অপরাধকে জায়েজ করে নেওয়ার অপচেষ্টা। সেনাবাহিনী ও বিদেশি সশস্ত্র দলের অপরাধ কর্মকান্ডগুলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত থেকেছে। এ সংগঠন ও তার নেতারা প্রকৃতই সেনাবাহিনীর বি-টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, কেএনএফ ও তার নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভুয়া ইতিহাস এবং কাহিনির প্রচারণা চালিয়ে নিপীড়িত, বঞ্চিত, অধিকারহারা আদিবাসীদের বিভ্রান্ত করতে চায়। আদিবাসীদের সংহতি বিনষ্ট করে শাসক ও সেনাবাহিনীর অপরাধ কর্মকাণ্ডকে সাফল্য এনে দিতে চায়। এজন্যই প্রাথমিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তার নেতাদের কেএনএফ আক্রমণে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। এখনো পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তার নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের আদিবাসীদের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁদেরকে শত্রু বানানো হলো সমগ্র আদিবাসীদের শত্রু বানানো। তাই কেএনএফ ও তার নেতারা আদিবাসীদের শত্রুর ভূমিকাই গ্রহণ করে চলেছে; তাদের দ্বারা আদিবাসীদের কোনো মঙ্গল আসবে না।