নিপন ত্রিপুরা
অল্প ক’দিন আগে জাতীয় সংসদের ২৯৯-পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের এমপি দীপংকর তালুকারের একটি সংসদীয় বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা আমার নজরে এসেছে। ৮ মিনিট বরাদ্দকৃত বক্তব্যে তিনি ১০ মিনিট বক্তব্য রাখেন। তার পুরো বক্তব্যই ছিল একদিকে বাজেট ও পাহাড়ের উন্নয়ন নিয়ে সরকার প্রধানকে তোষামোদী করা। অপরদিকে প্রকারান্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের স্বার্থ বিরোধী, মনগড়া, সত্য বিবর্জিত ও চুক্তি বিরোধী বক্তব্য। তার এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার কারণ এমন নয় যে, লোকে তার বক্তব্য খুব পছন্দ করেছে! বরং ভাইরাল হওয়ার কারণ হলো- তার মত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কীভাবে পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে এমন অসংলগ্ন বক্তব্য পেশ করতে পারেন!
তালুকদার সাহেব তার বক্তব্যে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটা পিছিয়ে পড়া এলাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে সাজেকে যাওয়ার রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সাজেকে যাওয়ার কোন রাস্তা ছিলো না ……সে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে সাজেক। মাইলে পর মাইল রাস্তা হয়েছে। ২৬ টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে, যেখানে যেখানে সম্ভব হচ্ছে না সেখানে সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, দীপঙ্কর বাবুর এ বক্তব্যও সত্যের অপলাপ। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শোষণ ও নিপীড়নের ফলে পাহাড়িদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনকে আড়াল করার অপচেষ্টা। পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা পাহাড়ি মানুষ কোনক্রমে পিছিয়ে পড়া ছিলোনা। পাহাড়ের ভিন্ন ভাষাভাষি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা ছিল। নগররাষ্ট্রের কাঠামোয় পাহাড়িদের জীবন ও সমাজ পরিচালিত হত। সামাজিক স্তরে কিছু নিপীড়ন ও বঞ্চনা থাকলেও তার বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রাম ছিল। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের সমাজে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে ব্রিটিশ বেনিয়ার শাসকেরা ধীরে ধীরে পাহাড়িদের ঐতিহ্যগত নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে থাকে। ক্রমান্বয়ে পাকিস্তান শাসনামল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের ফলে পাহাড়ি মানুষের সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। পাহাড়ি মানুষের আত্মপরিচয় ও অধিকারআজো রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বঞ্চিত। প্রান্তিক নয়শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ক্রমাগত নিপীড়নের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল আজ চরম সংকটগ্রস্ত।
সরকার মাইলের পর মাইল রাস্তা করেছে তারজন্য সাধুবাদ। গড়ে দেয়া রাস্তাঘাট আদতে স্থানীয় মানুষের জীবনে কতটুকু কাজে আসছে সেটাই বড় কথা। কথিত পর্যটন কেন্দ্র সাজেকের মানুষকেমৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে দশকের পর দশক ধরে সে কথা জনাব তালুকদার সাহেব বললেন না। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন। তাকে বলতে চাই, সাজেকে ২০১৭ সালে বড় ধরনের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবছর এ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সেবারে এর মাত্রাটা বেশি হওয়ায় তা জনসমাজে প্রচারণায় চলে আসে। খাদ্য সংকট সমাধানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আদৌ কোন পরিকল্পনা বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাছাড়াও প্রতি গ্রীষ্মের মৌসুম এলে সাজেকে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। এ নিয়ে সাজেকবাসীর পক্ষ থেকে প্রশাসন বরাবর নানা ধরনের আবেদন জানালেও প্রশাসন কার্যত কর্ণপাত করছেনা। ফলে খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ পানীয় সংকট সাজেকে নিয়মিত লেগে রয়েছে।
সাজেকের পর্যটনের বিরূপ প্রভাবের ফলে ১০০টি লুসাই পরিবার দেশান্তরিত হয়েছে। বলতে গেলে সাজেকে এখন হাতেগোনা আর মাত্র ১৬-২০টি লুসাই পরিবার রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার অভাবে পাংখো লুসাইরা দেশ ছেড়েছেন। যে কংলাক, রুইলই পাড়াতে ২০০৯ সালে পাংখো-লুসাই পরিবার ছিল ১২০টি। কংলাক পাড়ার মৌজা প্রধান হেডম্যানশীপ ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাকমা রাজা বরাবর আবেদন করেছিলেন। ইন্ডিপেডেন্ট টিভিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আর মাত্র ১০ পরিবার রয়েছে। টিকতে পারবো কিনা জানি না।(সূত্র:রাঙ্গামাটির সাজেক ছেড়ে যাচ্ছেন পাংখো-লুসাইরা, ইন্ডিপেডেন্ট টিভি, ২০১৭)
সাজেকের শিক্ষার চিত্র নিয়ে একটু বলা দরকার।কথিত সাজেক পর্যটন কেন্দ্রের আশেপাশে ৬/৭ টি গ্রাম রয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে একটি মাত্র প্রাইমারি স্কুল, যা বহু বছর আগে ইউএনডিপির অর্থায়নে পরিচালিত হত। স্কুলের শিক্ষকের সংখ্যা ৫ জন। গত বছর স্কুলটি জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় স্কুলের শিক্ষকেরা এখনো বেতন পাননি। তারা কবে বেতন পাবেন তাও তারা জানেন না। এই হল সাজেকে অবকাঠামোর উন্নয়নের দুরবস্থা। অনেকেই ভাবতে পারেন সাজেকে তো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় প্রবাদের মত চেরাগের নীচেরটা নাকি সবসময় অন্ধকার থাকে। সাজেকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে দীপংকর তালুকদার বলেছেন, ২৬ টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে, যেখানে যেখানে সম্ভব হচ্ছে না সেখানে সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এটি মিথ্যা ও মনগড়া বক্তব্য। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি অলিখিত চুক্তি হয়েছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর পাহাড়ের প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু ৬০ বছরের অধিক সময় পার হলেও পাহাড়ির ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। সোলার বিতরণ কার্যক্রমে রয়েছে হরেক রকমের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা।
তিনি বরকল উপজেলাতে একটি এলসি রেল স্টেশন ও ইমিগ্রেশন পয়েন্ট স্থাপনের দাবি তুলে বলেন, এসব স্থাপিত হলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রাণ সঞ্চার হবে, দেশের রাজস্ব বাড়বে। পাহাড়ের মানুষ অবশ্যই উন্নয়ন চান, শান্তি চান ও সম্প্রীতি চান। কিন্তু তার আগে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চান। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পাহাড়ের জুম্ম জনগণ ও স্থায়ী অধিবাসী বাঙালিদের অধিকার সন্নিবেশিত আছে। দীপংকর তালুকদার সংসদে উন্নয়নের দাবি তুলেছেন খুব ভালো কথা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের উপর উন্নয়নের দায়িত্ব সেই আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট কি যথাযথ ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা হয়েছে? পার্বত্য চুক্তিতে এসব পরিষদের উপর সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ যেসব বিষয় ও কার্যাবলী ন্যস্ত করার কথা ছিল, সেগুলো কি কার্যকর করা হয়েছে? নি:সন্দেহে তা হয় নাই। হয় নাই বলেই আজো পার্বত্যবাসীর নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার অর্জিত হয়নি। বর্তমানে পূর্বের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া উন্নয়ন চলছে। ফলে এসব উন্নয়ন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি এবং এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে চলেছে।
পর্যটন নিয়ে দীপংকর তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ¦ল। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার তিনি এমনভাবে সাজাতে বলেছেন যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করবেন তারা যেন সহজেই বুঝতে পারে পর্যটনের শহরে প্রবেশ করেছেন। তার বক্তব্যেরমাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবলি একটি বিনোদনের জায়গা। সেখানকরা মানুষেরা বিনোদনের বাহার। পর্যটনের ফলে জুম্মদের ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা বলতে কিছু চলে না। তালুকদার তার বক্তব্যে এসব কিছুই আড়াল করেছেন।
তিনি আদিবাসী জাতিসমূহের শিশুরা স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষানিয়েসংসদে যে বক্তব্য রেখেছেন তা পুরোপুরি মিথ্যা। তবে শিক্ষকদের পাঠদান নিয়ে তার বক্তব্য সরকারের অপরিকল্পনার চিত্র ফুটে উঠেছে বলা যায়। তিনি সরকারের সুনাম করতে গিয়ে সকল সত্য গোপন করেছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি আদিবাসী জাতিসমূহের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ খন্ডের ৩৩ (খ)-তে বলা হয়েছে, পার্বত্য জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার বিধান রয়েছে।বাংলাদেশ সরকার প্রথম দফায় পাঁচটি আদিবাসী মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং তদনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০১২ সালে, যা পরবর্তীতে ২০১৬ সাল থেকে পাঠ্যবই ছাপা হয় এবং আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদেরকে বিলি করা হয়।
প্রথমে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় ভাগে কোচ, ওঁরাও (কুড়-ক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খিয়াং ভাষার পর অন্য ভাষাতেও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে বলে জানানো হয়েছিল। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৫টি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রাক-প্রাথমিকের আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। আদিবাসীদের জোরালো আন্দোলনের মুখে সরকার তড়িঘড়ি করে২০১৭ সালে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ে বা প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। ফলত দীপংকর তালুকদারের সংসদে দেয়া সরকার দেশের সকল আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার বক্তব্য একদম অসত্য ও মনগড়া। সবচেয়ে ত্রুটি হচ্ছে, পাঠদানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও সিলেবাস প্রণয়ণ কর্মসূচিতে গোড়ায় গলদ রয়ে যাচ্ছে।কোনো কোনো স্কুলে চাকমা ভাষার শিক্ষক নাই তো, আরেক স্কুলে সিলেবাস নাই ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে ত্রুটি রয়েছে। যার ফলে নিয়ম রক্ষার জন্য সরকার কর্তৃক আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু কোনোভাবেই কাজে আসছে না।
পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন বসানো নিয়ে সংসদে দেয়া দীপংকর তালুকদারের বক্তব্য ছিল বড় ধরনের মিথ্যাচার। স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির আলোচনার জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় কমিটিতে এই দীপঙ্কর তালুকদারও একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরে তার শ্রম রয়েছে। অথচ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি কত দ্বিধাহীনভাবে বলে দিলেন, একটি মহলের দাবি অনুযায়ী পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক অপ্রয়োজনীয় সেনাক্যাম্প তুলতে আনতে হবে। সে অনুযায়ী তুলে আনা হয়েছে। সে জায়গায় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী এপিবিএন ক্যাম্প বসানো হবে। তিনি বলেন, অনেকে বলছেন এটি পার্বত্য চুক্তির বরখেলাপ, তিনি সে সাথে বলেন , “পার্বত্য চুক্তির কোথাও লেখা নাই, সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত জায়গাতে পুলিশ বসানো যাবে না, এপিবিএন বসানো যাবে না।” “জনগণের চাহিদা অনুযায়ী এপিবিএন বসানো হয়েছে।” তার আগে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১৭ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, (ক)সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী(বিডিআর,বর্তমান বিজিবি) ও স্থায়ী সেনানিবাস(তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম,রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন। একই ধারার(খ) তে বলা হয়েছে, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যাক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকদের নিকট অথবা জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।
তাহলে দীপঙ্কর তালুকদার কী করে বললেন যে,চুক্তির কোথাও এমন লেখা নাই, তেমন লেখা নাই! পরিত্যক্ত জায়গাগুলোতে কোন আইনবলে তিনি পুলিশ ক্যাম্প,এপিবিএন বসানোর পথ দেখেন? যেখানে সেই সমস্ত জায়গাগুলো প্রকৃত মালিকদের কাছে অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করার কথা লেখা আছে সুস্পষ্ট করে, সেখানে কিভাবে তিনি পুলিশ ক্যাম্প বসানোর বৈধতা দেখতে পান? উল্টো পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পের জায়গা প্রকৃত মালিক নতুবা জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের বিধান জোরালোভাবে রয়েছে। সুতরাং দীপংকর তালুকদার জনগণের দোহাই দিয়ে যা কিছুই বলুক, পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পের স্থলে এপিবিএন বসানো পার্বত্য চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্পের জায়গা এপিবিএন স্থাপন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সভাতে কোনো ধরনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তাহলে পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন স্থাপন চুক্তি বিরোধী ও পেশি শক্তি প্রয়োগের অন্যতম উদাহরণ। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আজ পর্যন্ত ঠিক কয়টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে তার সঠিক তথ্য দেখা যায়নি। চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তথ্যমোতাবেক চুক্তির পূর্বে মোট নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পের সংখ্যা ৫৪৬টি। চুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহারের সংখ্যা ২৪১টি এবং একটি পদাতিক ব্রিগেড। বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পের সংখ্যা ২০৬ টি। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তথ্য সমর্থন জানালেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পের সংখ্যা হওয়ার কথা ৩০৫ টি। এখানেও হিসাবের ফাঁকি রয়েছে। প্রকৃত ক্যাম্পের সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিকের বেশি।
তিনি তার বক্তব্যে আরো অবৈধ অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজদের কথা তুলে ধরে বলেছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। আমি তার কথায় একমত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু অস্ত্রধারীরা তো তার নাকের ডগায় শুভলং, জীবতলীতে, নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। দীপংকর তালুকদার এদের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্চ্য করেন না। আরেকদিকে মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়ায় অবস্থান করে সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও গুলি করে মেরে ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে দীপংকর তালুকদার টু শব্দটি করছে না। তাহলে নির্দ্ধিধায় বলা যায়, সন্ত্রাসীর পালক তথা আশ্রয়দাতা কে? কারা পাহাড়ে অশান্তি চায়? কেবল অবৈধ অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজের কথা বলে পাহাড়ে জুম্ম জনগণের উপর জুলুম, শোষণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়কে লুকিয়ে জায়েজ করেছেন। বলতে গেলে সেটেলারদের নিপীড়নের কার্যক্রমকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি সরকার বা অপরাপর সংসদ সদস্যদের বুঝাতে চেয়েছেন পাহাড়ে সবকিছু ঠিক। কোনকিছু হচ্ছে না। সেটেলাররা নিরীহ, তারা হত্যা, ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা করে না। কেবল পাহাড়িরাই সব ষড়যন্ত্রের হোতা। চুক্তি বাস্তবায়নের নাম করে পাহাড়িরা সকল শান্তি, সম্প্রীতির বিনষ্টের মূল। চুক্তি বাস্তবায়নের নাম করে তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে বেড়াচ্ছে। ঠাকুর ঘরে ক্যারে? আমি কলা খাই না স্বভাব দেখিয়ে কিছু সময় ভন্ড সাজা যায় কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের ভিতর চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় জনগণের ক্রোধকে সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, চাঁদাবাজ আ্যখ্যা দিয়ে কোনভাবে দমানো যাবে না।
কর্তৃত্ববাদীশাসকগোষ্ঠীর চরিত্র এমনি অধিকার না দিয়ে অধিকারের দাবিতে যারা লড়াই করেন, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসী অ্যাখ্যা দিয়ে আন্দোলন দুর্বল করার অপচেষ্টা করে থাকে। আন্দোলনকে বির্তকিত করার অপচেষ্টা করে থাকে। এ ষড়যন্ত্র ক্ষণিকের জন্য সফল হলেও চূড়ান্তভাবে কিন্তু কোনোকালে শাসকগোষ্ঠী সফল হতে পারেনি। এটি পাহাড়ের জুম্ম জনগণ জানেন।
আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের প্রতিনিধি বা সরকার যত মিথ্যাচার করবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হবে। পাহাড়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন সাধনেপার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নাই। যতই সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ তকমা দেয়া হোক কিংবা সামরিক দমন-পীড়ন বাড়ানো হোক সমস্যার সমাধানহবেনা। বরং সমস্যা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।