হিল ভয়েস, ৭ মে ২০২২, বান্দরবান: সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগ মদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কর্তৃক পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বৌদ্ধ বিহারের ভূমিসহ বিভিন্ন জনের ভূমি জোরপূর্বক জবরদখল ও বিভিন্ন অপকর্ম সংঘটনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশাসনকে জানালেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না এবং কেউ কেউ ভয়ে এব্যাপারে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, খোদ সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এইসব সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে থাকে এবং লালন-পালন করে থাকে।
সম্প্রতি বান্দরবান সদর উপজেলা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কয়েকটি স্থানে সন্ত্রাসীদের কর্তৃক অবৈধভাবে এই ধরনের ভূমি জবরদখল এবং অপকর্ম করার খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বান্দরবান সদর উপজেলায় বোমাং রাজা উচপ্রু’র ৩১৩নং মৌজাধীন মেঘলা পর্যটন এর সন্নিকটে চাকমা পাড়া গ্রামের এক বৌদ্ধ বিহারের ৩ একর ভূমি জোরপূর্বক দখলে নেয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী দলের নেতা অনুপম চাকমা (৩৫)। অনুপম চাকমার বাড়ি নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে তার দাদুর বাড়ি রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার এলাকায় বলে জানা গেছে। সে বর্তমানে বান্দরবান জেলায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের পক্ষে প্রশাসনের সাথে সমন্বয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত বলে জানা গেছে। ফলে বিভিন্ন সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে যেমন, তেমনি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে তার রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ।
জানা গেছে, অনুপম চাকমা ইতোমধ্যে বেদখলকৃত উক্ত বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় বাগান সৃজন করছে এবং একটি বিশাল কাঠের ঘর তৈরি করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাকমা গ্রামবাসী জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বান্দরবান সেনা জোনের কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল মোঃ মাহমুদুর রহমান পিএসসি’র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও আশ্রয়-প্রশয়ে ঐ কাঠের বাড়িটিতে বর্তমানে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের একটি সশস্ত্র গ্রুপ অবস্থান করছে। তিনি বলেন, কখন যে তাদের প্রতিপক্ষের সাথে সংঘাত হয়- তা নিয়ে খুব আতংকের মধ্যে আছি।
ওই গ্রামবাসী আরও জানান, প্রায় প্রতিদিন ঐ বাড়িতে সন্ত্রাসীরা মাদক, ইয়াবা খেয়ে হৈচৈ করে থাকে এবং মেয়ে মানুষের কন্ঠও শোনা যায়। গ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ হলেও কেউ মুখ খুলে কোনো কিছু বলতে সাহস করে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ গ্রামের এক বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, কাপ্তাই বাধের পর থেকে দীর্ঘ বছর ধরে আমরা এখানে বসবাস করে আসছি। ঐ ভূমি সরকারিভাবে বৌদ্ধ বিহার গড়ে তোলার জন্য নির্ধারিত ভূমি। কিন্তু অনুপম চাকমা নামে এক ব্যক্তি তা জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে। পরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের পরিচালক চার্মিং বাবুকে জানিয়েও কোনো সুফল পাইনি।
অপরদিকে আরও জানা যায়, উক্ত অনুপম চাকমা গত ৩ জুন ২০২২ বান্দরবান সদর উপজেলার ৩৩৭নং বালাঘাটা মৌজার লেমুঝিরি পাড়ার কার্বারি হাফহ্রী মারমাকে তার বসতভূমির ৬ শতক পরিমাণ জায়গা সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটের এক সদস্যের নিকট জোরপূর্বক ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অতি সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য করেন।
জানা গেছে, কার্বারি হাফহ্রী মারমার ঐ জায়গা নিয়ে সামান্য পারিবারিক ঝামেলা রয়েছে। কিন্তু ঐ পারিবারিক ঝামেলাকে ব্যবহার করেই অনুপম চাকমা বান্দরবান সেনা জোনের আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট সদস্য সার্জেন্ট মোহাম্মদ আজিজ উল্লাহ’র সাথে যোগসাজস করে ঐ জায়গাটি আজিজ উল্লাহ’র কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করার ব্যবস্থা করে।
জানা গেছে, মোহাম্মদ আজিজ উল্লাহ জায়গাটি ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কিনলেও এর প্রকৃত মূল্য এর চেয়ে কয়েকগুণ। কিন্তু ভুক্তভোগী কার্বারি হাফহ্রী মারমা অস্ত্রের হুমকি পেয়ে কাউকে কোনো কিছু বলতে পারছেন না।
এদিকে স্থানীয় আরও এক সূত্রে জানা যায়, বান্দরবান সদরের বালাঘাটায় অবস্থিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কার্যালয়ে প্রায় প্রতিদিন নিরীহ সাধারণ জুম্ম গ্রামবাসীকে ডেকে এনে বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে মারধর করা হয়। সেখান থেকে প্রায় লোকের আর্তচিৎকারের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
সন্ত্রাসীদের কার্যালয়ের প্রতিবেশী এক বাঙালি দোকানদার জানান, প্রায়ই ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা তাদের কার্যালয়ে যুবতী নারীদের নিয়ে আসে। এক পর্যায়ে তাদেরকে নির্যাতন ও চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। আমরাও আতংকের মধ্যে থাকি। প্রশাসনকে জানালেও তারা নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে।
তিনি বলেন, গতকালও (৬ জুন ২০২২) ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি মংপু হেডম্যান তাদের এই কার্যালয়ে আসলে ৩/৪ জনের অধিক লোকের চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। সভাপতি মংপু নিজেও মারধর করেন বলে জানা যায়।
এছাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নেও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কর্তৃক জোরপূর্বক জুম্মদের কাছ থেকে ভূমি বেদখল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, জামছড়ি ইউনিয়নের ৩৪০নং মৌজার তংপ্রু পাড়ার গ্রাম প্রধান অংচমং মারমা কার্বারির পিতৃসম্পত্তি ৫ একর পরিমাণ পাহাড়ি ভূমি থেকে ২ একর ভূমি জবরদখল করে নিয়েছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কয়েকজন নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মারমা গ্রামবাসী জানান, গত ১০ মে ২০২২ ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের সদস্য অনুপম চাকমা ও মগ পার্টির সদস্য অনুমং মারমা (ভূমি দালাল)-এর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র দল এসে আমাদের গ্রামের কার্বারি অংচমং মারমার জায়গাটি জবরদখল করে নিয়েছে। কার্বারির জায়গার অনেক গাছ কেটে, সীমানা প্রাচীর ও খুঁটি ভেঙে বেদখলকৃত জায়গায় অনুপম চাকমার নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে তারপর চলে গেছে তারা।
ঘটনার দুই দিন পর ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন উক্ত গ্রামবাসী।