হিল ভয়েস, ১৯ জুন ২০২২, ঢাকা: ‘বৈচিত্র্যের ঐকতানই আমাদের শক্তি, বহুত্বের উৎসবে বুনি মুক্তি’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে গত শুক্রবার (১৭ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি’তে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জুম ম্যাগাজিন প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ এর বিদায়ী সভাপতি রাতুল তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উৎসবের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাবি’র উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো.আখতারুজ্জামান এবং সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি’র ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা প্রমুখ।
সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক ঐতিহ্য চাকমা’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার শুরুতেই ‘জুম’ ম্যাগাজিনের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন জুম ম্যাগাজিনের এবারের সম্পাদক ও সংগঠনটির সহ-সভাপতি সতেজ চাকমা।
স্বাগত বক্তব্যে সতেজ চাকমা বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল এখনো তা পূর্ণতা পায়নি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দর্শন নিয়ে যে দেশটির যাত্রা হয়েছিল তার মূল সৌন্দর্য নিহিত আছে বহুত্বে। বাঙালি ভিন্ন অপরাপর সংস্কৃতিগুলোও যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র উর্বর সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় সমানভাবে চর্চিত হতে পারে তার জন্যই আমাদের এই প্রয়াস। বাংলাদেশ যে বহু ধর্মের, বহু জাতির দেশ এটাই আমাদের বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যকে উদযাপন করাই আমাদের এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য। এ ধরনের বৈচিত্র্যমই সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠুক এই কামনা করি।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান বলেন, পাহাড়ের এ শিক্ষার্থীরা খুবই সরল এবং সরলতাই তাদের সৌন্দর্য্য। এ সরলতার জন্য তারা কারোর সাথে ঠগবাজি করতে পারে না, যেটা করে খুবই মন দিয়ে করে থাকে। আজকের এ জুম ম্যাগাজিন তাদের এই সৃজনশীলতার একটি নিদর্শন। এ জুমে কবিতা আছে, প্রত্যাশা আছে, ক্ষোভ আছে এবং বিকল্প চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের নানা ভাবনা আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে জুম্ম শিক্ষার্থীদের শিল্প, সাহিত্য ও স্ব স্ব সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশের নিরাপদ ক্ষেত্র দাবি করে তিনি আরো বলেন, আমাদের বৈচিত্র্য ব্যাপক কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা খুবই কম। পাহাড়ের জুম্ম শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন তিনি।
সম্মানিত অতিথি’র বক্তব্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, পাহাড়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীরা জুমের যে উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে এটি আমি মনে করি বহুত্বাবাদী এ বাংলাদেশ তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত চিন্তার দ্বার খুলে দিবে। রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা চেতনা পরিপুষ্ট হয়। এটি বলার উপেক্ষা রাখে না যে, তাদের এই আয়োজন বাংলাদেশের বৈচিত্র্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে একক সংস্কৃতি লালন নয়, বহুজাতিক বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিরই প্রকাশ ঘটেছে। জুম ম্যাগাজিনের মাধ্যমে জুম্ম শিক্ষার্থীদের ভাবনা, চিন্তা, ক্ষোভ, প্রত্যাশা ও সৃজনশীলতা প্রতিফলিত হয়েছে বলে তিনি এই ম্যাগাজিন প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রশংসা করেন।
এছাড়াও বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা বলেন, আমরা বহুজাতির একটি দেশে বসবাস করি। মনোকালচার কোনো ক্ষেত্রেই ভালই নয়। আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা যারা জগন্নাথ হলে অবস্থান করে, আমি সবসময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমাদেরকে একে অপরের হাত ধরে পথ চলতে হবে। এভাবেই দেশ আরো এগিয়ে যাবে এবং উন্নত সমৃদ্ধ হবে বলে।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা বলেন, শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে পাহাড় থেকে আসা এ পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা নিজের শেকড়, সমাজের কথা ভাবছে, দেশের অসংগতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলছে এটি আমাদের আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে আশাবাদী করে। তারা যেন পড়ালেখার সাথে সাথে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনেও মনোনিবেশ করেন তার জন্য পাহাড়ের তরুণ জুম্ম শিক্ষার্থীদেরকে আহ্বানও জানান তিনি।
সভায় সমাপনী বক্তব্য রাখেন জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি রাতুল তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি তার সমাপনীর বক্তব্যে তার জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা গতিশীলতার জন্য সাংস্কৃতিক উর্বর ভূমি ও বহু সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র টি.এস.সি’তে সংগঠনের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দের দাবিও জানান। আলোচনা সভার পরেই অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ঢাবি জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের শিল্পীদের আবৃত্তি, গান ও নৃত্য পরিবেশনার পরেই গান পরিবেশন করে আদিবাসীদের গানের দল মাদল। এরপর ঐতিহ্য চাকমা’কে সভাপতি, শ্রেয়া চাকমা’কে সাধারণ সম্পাদক ও অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা’কে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩৭ সদস্যের নতুন কমিটির ঘোষণা করা হয়। সারাদিন ব্যাপী উক্ত আয়োজনে ছিল আর্ট ক্যাম্প, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও মাদলের গান। এছাড়াও উক্ত অনুষ্ঠানে উদীয়মান বক্সার সুর কৃষ্ণ চাকমা সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।