হিল ভয়েস, ১৩ জুন ২০২২, ঢাকা: গতকাল ১২ জুন ২০২২ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছর উপলক্ষে অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবিতে ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে সংহতি সমাবেশ ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম যৌথভাবে এই আয়োজন করে।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা’র সভাপতিত্বে এবং বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা’র সঞ্চালনায় সংহতি সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আন্তনী রেমা। এছাড়াও আলোচনা পত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা।
সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী।
সমাবেশে নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক বলেন, আমরা একটা জায়গায় সমবেত হয়েছি, একটা বিশাল অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। এখনো এই প্রতিবাদ জারী রেখেছে পাহাড়ের নারীরা। অনেক আগে আমরা বড় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এখন সেই প্রতিবাদ শোনার জায়গাও নেই। আগে আমরা কোনো না কোনো উত্তর পেলেও এখন কোনো উত্তর পাই না। কল্পনা অপহরণের ২৬ বছর মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সের অর্ধবছর। আমাদের জবাবদিহির জায়গাতে ঘাটতি আছে বলেই এসব হচ্ছে। ২৬ বছরে আমরা একটা গুম-খুন-হত্যা-অপহরণের দেশ হিসাবে পেয়েছি। কিন্তু আমরা তো এই ধরনের বাংলাদেশ চাইনি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, কল্পনা চাকমার গ্রামে আমরা গিয়েছিলাম শান্তি চুক্তির পর পর। কল্পনা চাকমার মা এবং তার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র বা সরকার কল্পনা চাকমা’র সন্ধান দিতে পারেনি। আমরা যারা তাঁর সন্ধান চাই, বিচার চাই- আমরা সবাই অপেক্ষায়। গত ২৬ বছরে রাষ্ট্র অনেক বদলে গেছে। আগে যেমন লিখতে পারতাম কিন্তু এখন আর সেভাবে লিখতে পারি না। নিজে নিজে আমরা সেন্সর করি। অন্ধকারের পরে ভোর আসবে। আমরা প্রত্যাশা করি যে, যখন রাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন এভাবে হারিয়ে যান, নিখোঁজ, নিরুদ্দেশ হন এবং খুঁজে না পান তখন আমাদের রাষ্ট্র, তার সাংসদ, জেনারেলরা দু:খিত হবেন, লজ্জিত হবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কল্পনা অপহরণ নিয়ে আমরা নানা কিছু দেখেছি। তৎসময়ে ২৪ পদাতিক ডিভিশন হেলিকপ্টারের মাধ্যমে প্রচারপত্র বিলি করে তাকে সন্ধান দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরষ্কার দেবেন বলে ঘোষণা করেছিল। আমরা সহযোদ্ধা হিসাবে মিছিলে একসাথে ছিলাম। কিন্তু কল্পনা চাকমা’কে চিনেছি ‘কল্পনা চাকমা’র ডাইরি পড়ে। কল্পনা চাকমা যে অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সাধারণ কৃষিজীবী জুমিয়া পরিবার থেকে উঠে এসে পড়াশুনা করে প্রতিবাদী হয়েছেন। প্রান্তিক মানুষের কথা বলেছেন। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা বলছেন কল্পনা চাকমা’র সাথে আমরা ছিলাম সেটা খুবই সহজ ছিল না। কেননা, তখনকার সময়টা খুব একটা ভালো ছিল না। ভৌগোলিক পরিস্থিতি ছিল বিরূপ এবং এখনকার সময়ের মত ইন্টারনেট ছিল না। কাজেই কল্পনার লড়াই, সংগ্রাম আজকের তরুণ বন্ধুদের বুঝতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বয়স ২৬ কি ৫২ হলেও এর বিচার হবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র বিচার করবে না। দাম্ভিকতা নিয়ে থাকবে। কিন্তু যতদিন মানবিকতার পক্ষে লড়াই হবে, জুম পাহাড়ের মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন আমরা কল্পনার আদর্শকে ধারণ করবো এবং অনন্তকাল আমরা কল্পনা চাকমাকে স্মরণে রাখবো।
অনুষ্ঠানে কল্পনা চাকমা’র বান্ধবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি কল্পনা চাকমাকে প্রথম দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। খুব শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন মেজাজী। একটা সময় সে আমাকে চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে ছিল একজন বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং পাহাড়ে যা ঘটছে তা জানাবার প্রয়াস। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার একজন মেয়ে কীভাবে এত প্রাগ্রসর চিন্তা করতে পারে। কল্পনা সেসময় সেনাশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন এবং একই সাথে নিজ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশে নারী আন্দোলন একসময় জাতীয়তাবাদী ছিল। কল্পনা অপহরণের পরই প্রথম এই জাতীয়তাবাদী চরিত্রে অভিঘাত তৈরী করে। তখনই মূল ধারার নারী আন্দোলনের সাথে পাহাড়ের আদিবাসী নারী আন্দোলনের এক সমন্বয় ঘটে। কল্পনা চাকমা’র মেজাজের ধার কেবল বুঝতে পেরেছিল সেনাবাহিনী। যার জন্য তাকে অপহরণ করেই নি:স্তব্ধ করে দেওয়া হল। রাষ্ট্র সেসময় কল্পনার বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে পাহাড়ে সেনা শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কল্পনা শুধু পাহাড়ের মশাল নয়, এদেশের নারী আন্দোলনে এবং নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের মশাল।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী বলেন, আমাদের দেশের জন্য খুবই দু:খজনক যে, ২৬ বছরেও আমরা কল্পনা চাকমা’র খোঁজ পেলাম না। এর মধ্যে ৩৯ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। প্রশাসন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনো তার কোনো হদিস দিতে পারেনি। এটা আমাদের বিচার ব্যবস্থার দুরাবস্থার কথা ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশে আমরা যখন নারী নিপীড়নের ঘটনা দেখি তখন সেখানে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা দেখি। আমরা যারা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলি, স্বজন আছি তারা সবাই সেই ১৯৯৬ সালে কল্পনা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে রাজপথে আছি। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তারও অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা একই সাথে কল্পনা অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চাই এবং পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী যে বাহিনীগুলোকে পাহাড়ের বাইরে সরিয়ে নিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল তাদেরও যেন সরিয়ে আনা হয় এবং পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী বলেন, আজ ২৬ বছর হয়ে গেল। কিন্তু আমরা এখনো পর্যন্ত তার কী হয়েছে তা কিছুই জানতে পারিনি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। তারপরও আজকে আমাদেরকে অপহরণ দিবস, নিখোঁজ দিবস পালন করতে হচ্ছে। নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীরা আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো হদিস মিলছে না। একটা রাষ্ট্রে সুশাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কতটা ঘাটতি থাকলে এধরনের ঘটনাগুলো বারংবার ঘটে। এখন আমরা পোষাক কী হবে, কীভাবে চলবো সব ধরনের আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলি, বাঙালি, আদিবাসী, প্রান্তিক সকল মানুষের বাংলাদেশের কথা বলছি, সেসব মানুষরা আমরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছি। কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা নিয়ে এখনো যারা কন্ঠ সোচ্চার রাখছেন তাঁদের সবাইকে কন্ঠ জারি রাখবার আহ্বানও জানান এই নারী নেত্রী।
এছাড়াও সংহতি বক্তব্য রাখেন কল্পনা চাকমা’র সহযোদ্ধা ও নারী নেত্রী ইলিরা দেওয়ান। অনুষ্ঠানের সভাপতি চঞ্চনা চাকমার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা শেষ হয় এবং সংহতি সমাবেশের পরে প্রতিবাদী গান করেন মাদল, এফ-মাইনর, বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরাম এর শিল্পীবৃন্দ ও অরূপ রাহী।