সজীব চাকমা
কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা এবং এর জের
আজ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিনের শুরুতে মধ্যরাতে আনুমানিক ১:৩০ টা হতে ২:০০ টার মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তিনি একদল চিহ্নিত সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক নির্মমভাবে পাশবিক কায়দায় অপহরণের শিকার হন। বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নির্যাতন ও নিপীড়নের অন্যতম দিক হচ্ছে জুম্ম নারীর উপর সহিংসতা। কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা তারই এক বর্বরোচিত সাক্ষ্য। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ও দেশের আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতার এক জ্বলন্ত প্রতীক।
অপহরণকারীরা বাড়ির দরজা ভেঙেই কল্পনা চাকমাসহ তার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম)কে ঘুম থেকে তুলে এনে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। এসময় চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করলেও, টর্সের সামান্য আলোর ঝলকে অপহরণকারীদের কারো কারো মুখমন্ডল দেখাও যাচ্ছিল। তাদের কেউ পুরোপুরি, কেউবা অর্ধেক গামছা বা কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা। একসময় চোখ বেঁধে কল্পনা চাকমা ও তার দুই ভাইকে আলাদা করে এবং কল্পনা চাকমাকে একদিকে নিয়ে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ পর কল্পনা চাকমার উদ্বিগ্ন ‘দাদা..দাদা..’ ডাক শুনতে পায় কল্পনার ভাইয়েরা এবং সেটাই ছিল ভাইদের কাছে তাদের প্রিয় একমাত্র বোনের শেষ কন্ঠস্বর। যে কন্ঠস্বর তারা এখনও ভোলেননি। এক পর্যায়ে কল্পনার ভাইয়েরা গুলির শব্দ শুনতে পান। এরপর অপহরণকারীরা কল্পনার দুই বড় ভাইকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। তবে তারা গুলির সংকেত পেয়েই এবং গুলির সাথে সাথেই জীবন পণ করে পালিয়ে কোনমতে বাঁচতে সক্ষম হন। পরে ঘটনাটি তারা এলাকার মানুষ, পুলিশের কাছে এবং বিভিন্ন জনের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
সহিংসতা ও বর্বরতা সেখানেই থেমে থাকেনি। কল্পনা অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ২৭ জুন ১৯৯৬ বাঘাইছড়িসহ রাঙ্গামাটি জেলায় অর্ধদিবস সড়ক অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। দাবি মূলত একটিই, ‘কল্পনা চাকমার মুক্তি চাই এবং অপরাধীদের শাস্তি চাই’। শান্তিপূর্ণ এই অবরোধ চলাকালে আবার বাঘাইছড়ি সেনা কর্তৃপক্ষের মদদে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবুপাড়া ও মুসলিম ব্লক এলাকায় গুলি করে রূপন চাকমাকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুকেশ চাকমা, মনোতোষ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তারা চারজনই ছিলেন সেই এলাকার সম্ভাবনাময় তরুণ। এই চারজনকে হত্যার ঘটনা ঘটে দিনের প্রথম ভাগে, একেবারে দিবালোকে প্রকাশ্যে। কিন্তু, না, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাউকেই গ্রেফতার করেনি বা করতে পারেনি। গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়েছে বলেও জানা যায়নি।
অপহরণকারী কারা এবং কেন
বাঘাইছড়ি উপজেলার কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস (সম্পূর্ণ নাম মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এর নেতৃত্বেই যে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ এবং তার দুই ভাইকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা খোদ কল্পনা চাকমার বড় ভাইয়েরা শুরু থেকে বলে আসছেন। তারা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী এবং প্রাণে বেঁচে যাওয়া সাক্ষী।
১২ জুন, ঘটনার পর ভোর হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কল্পনার খোঁজখবর নিয়েও কোন হদিশ না পাওয়ায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমার কাছে গিয়ে বিষয়টি জানান। এরপর তাদেরকে সাথে নিয়ে কালিন্দী কুমার চাকমা বাঘাইছড়ির টিএনও’র (বর্তমানে ইউএনও) নিকট গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন। বাঘাইছড়ির তৎকালীন টিএনও-র কাছে জবানবন্দীতে ও সংশ্লিষ্টদের কাছে অপহরণকারীদের মধ্যে স্পষ্টতই টর্চের আলোতে কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন বলে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, কল্পনা চাকমার বড় ভাইরা আগে থেকেই লেঃ ফেরদৌস এবং নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদকে চিনতেন। কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের দূরত্ব কল্পনা চাকমাদের বাড়ি থেকে বড় জোর একশ থেকে দুইশ গজের মধ্যে। অপরদিকে নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদদের বাড়িও কল্পনা চাকমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ফলে রাতের অন্ধকারে সামান্য আলোতেও কল্পনার ভাইয়েরা সুস্পষ্টভাবে অপহরণকারী তিন জনকে চিনতে সক্ষম হন।
শুধু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা বলছেন বলে নয়, ঘটনার পরম্পরা এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীও এই অপহরণ ঘটনার জন্য লেঃ ফেরদৌসের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেষ করে। এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় যে, নিজের গ্রাম লাল্যাঘোনাসহ বাঘাইছড়ির পুরো উপজেলায় ব্যক্তি হিসেবে এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কল্পনা চাকমার পরিচিতি যেমনি ছিল, তেমনি ছিল জনপ্রিয়তা। নিজের গ্রাম-এলাকায় কারো সাথে কোন শত্রুতা বা মনমালিন্য ছিল না। এমনকি বাঘাইছড়ি এলাকার সাধারণ কোন বাঙালির সাথেও তার ব্যক্তিগত কোন দ্বন্দ্ব বা ঝগড়ার কথা শোনা যায়নি। ফলে, সাধারণ কোন জুম্ম বা বাঙালির দ্বারা এত রাতে সুপরিকল্পিতভাবে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করার ঘটনা কোনোভাবে ঘটতে পারে না।
তবে, একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট এবং সেসময় অনেকেই জানতেন যে, কজইছড়ি ক্যাম্পের কম্যান্ডার লেঃ ফেরদৌস দলবল নিয়ে মাঝে মাঝে কল্পনা চাকমাদের বাড়িতে আসতেন। কল্পনা চাকমার সাথে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলতেন। কল্পনা চাকমাও কোন কোন সময় লেঃ ফেরদৌসের সাথে তর্ক করতেন এবং লেঃ ফেরদৌসের নিকট বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরতেন ও প্রতিবাদ জানাতেন। জানা যায়, একবার কল্পনাদের এলাকার পাশে কিছু জুম্ম বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং এজন্য সেনাবাহিনী ও নিকটবর্তী সেটেলার বাঙালিদের দোষারোপ করা হয়। এনিয়েও কল্পনা চাকমার সাথে লেঃ ফেরদৌসের একবার কড়া বাকবিতন্ডা হয়। ফলে এটা ধারণা করা কঠিন নয় যে, সেনা অফিসার হিসেবে অহংকারী লেঃ ফেরদৌস তার সাথে সাধারণ পরিবারের এক জুম্ম নারী কল্পনা চাকমার তর্ক করা, তর্কে হার না মানা বা উল্টো প্রতিবাদ করাকে সহজেই গ্রহণ করতে পারেননি। বিপরীতে তিনি হয়েছেন ক্ষুব্ধ, আক্রোশপূর্ণ এবং প্রতিশোধ পরায়ণ। তার এই সংকীর্ণ মানসিক অবস্থাই তাকে এহেন জঘন্য অপহরণকান্ডের দিকে ধাবিত করে।
শুধু কল্পনা চাকমার সাথেই যে লেঃ ফেরদৌসের এই আচরণ ছিল তা নয়। সেই সময় কজইছড়ি ক্যাম্পের নিকটবর্তী জুম্ম এলাকায় তিনি প্রায়ই জনগণকে নানাভাবে হয়রানি করতেন এবং নিপীড়ন চালাতেন। বলতে গেলে, ঐ এলাকায় তৎসময়ে তার কুখ্যাতি ব্যতীত সুখ্যাতির কথা জানা যায় না।
এটাও বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য যে, যেদিন ভোররাতে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়, সে দিনই, অর্থাৎ ১২ জুন, দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেসময় পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলেও নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। খুব সম্ভবত সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলছিল। কল্পনাদের বাড়ি কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের যেমনি নিকটবর্তী, তেমনি বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর থেকেও খুব বেশি দূরে নয়। ফলে এলাকাটি সেনাবাহিনী ও সাধারণ প্রশাসনের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই অবস্থিত। সাধারণ মানুষ সবাই পরের দিন নির্বাচনের চিন্তাভাবনা নিনেই যে যার বাড়িতেই ঘুমিয়েছিল। এহেন অবস্থায় সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র ব্যক্তি ছাড়া, অর্থাৎ লেঃ ফেরদৌস ও তার দল ছাড়া কোনভাবে ও কারো পক্ষে এই অপহরণ ঘটনা ঘটনো সম্ভব হতে পারে না।
উল্লেখ্য, অপহরণ ঘটনার পরদিন সকালে কল্পনার ভাইয়েরা সেসময় ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা এবং গুলি রাখার বেন্ডলি (কোমর বন্ধনী) খুঁজে পান এবং পরবর্তীতে প্রশাসনের নিকট জমা দেন বলেও খবর পাওয়া যায়।
আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, সব অপরাধী অপরাধ স্বীকার না করলেও তার অভিব্যক্তিতে বা আচরণে অপরাধীর চিহ্ন ধরা পড়ে। অপহরণ ঘটনার পর এর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝর ওঠে এবং কল্পনার ভাইয়েরা ও জনগণ শুরু থেকেই লেঃ ফেরদৌসকেই অভিযুক্ত করতে থাকে। কিন্তু লেঃ ফেরদৌসকে এব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি করতেও দেখা যায়নি এবং অস্বীকার করতেও দেখা যায়নি। এতবড় ঘটনার পর তার যে আচরণ ও ভূমিকা সেটাও আভাস দেয় যে, তিনিই এই ঘটনার হোতা।
অপরদিকে, সামান্য একজন লেফটেন্যান্টকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী ও সরকারের যে পক্ষপাতিত্ব, অথচ এতবড় নিন্দনীয় ও ভাবমূর্তি ধ্বংসকারী ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারে সরকারের দায়হীন ও এড়িয়ে চলার যে ভূমিকা সেটাও অভিযোগের সত্যতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। দোষ যদি কিছুই না থাকে, ফেরদৌস যদি দায়ীই না হয়, তাহলে সেনাবাহিনী ও সরকার কেন নিরপেক্ষভাবে ঘটনার বিচারের ব্যবস্থা করে না?
কেন কল্পনা চাকমাকে সেই রাতেই অপহরণ করা হল
কিছু বিষয় যদি বিবেচনায় আনা যায়, তাহলে বুঝতে সহজ হয় যে, লেঃ ফেরদৌস কেন ১২ জুনের দিবাগত রাতে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেন। বস্তুত আক্রোশপূর্ণ ও প্রতিশোধপরায়ণ লেঃ ফেরদৌসের জন্য ঐ সময়টাই ছিল মোক্ষম সময়। যেহেতু নির্বাচনী প্রস্তুতির শেষ মুহূর্ত, এসময় সাধারণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও জনগণের মধ্যে থাকে পক্ষ-বিপক্ষ একটা আবহ। আর ঘটনাটি ঘটালেও হয়ত নির্বাচনের উৎসবের জোয়ারে তত মাথাচাড়া দিতে পারবে না বলেই তিনি মনে করেছিলেন। আর গোটা পার্বত্য অঞ্চলে সাধারণভাবে সামরিক কর্তৃত্বতো আছেই। তদুপরি, এ ধরনের ঘটনা যেহেতু অতীতেও ঘটেছে, তাই তিনি হয়ত এর প্রভাবকেও মামুলি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। অথবা ক্রোধে অন্ধ হয়েই তিনি শেষ পর্যন্ত এই গর্হিত ও কলঙ্কজনক ঘটনাটি ঘটান।
আরও একটি বিষয় কাজ করতে পারে। স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানের পর ধীরে ধীরে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও তার হাওয়া লেগেছে। ছাত্র-যুব সমাজ ও জনগণ আগের চেয়ে অনেক সচেতন, সাহসী ও সংগঠিত হয়ে উঠছে। পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ইস্যুটি আগের চেয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এর মধ্যে বিরোধী দল আওয়ামীলীগ পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আসন্ন নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা, তথা পার্বত্য সমস্যা সমাধানের পথে যাওয়ার একটি অনুকূল বাস্তবতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হয়ত এই সম্ভাবনার পরিস্থিতিটাই তাকে হতাশ করেছে এবং ধৈর্য্যহীন করে ঐদিনই তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার দিকে চালিত করেছে।
তদন্ত ও বিচার কি প্রহসন
১৯৯৬ সালের ১২ জুন ভোর হওয়ার পর কোথাও কল্পনার হদিশ না পাওয়ায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ির টিএনওর নিকট গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন। বাঘাইছড়ি টিএনওর কাছে বর্ণিত বিবরণই বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং থানায় তা মামলা নং ২, তারিখ ১২/০৬/৯৬, ধারা ৩৬৪ দ: বি: হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অপরদিকে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে পড়ে সরকার ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. অনুপম সেন ও চট্টগ্রামের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারকে নিয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। জানা যায়, চার শতাধিক লোকের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে তদন্ত কমিটি সরকারের নিকট একটি রিপোর্টও পেশ করে। কিন্তু বিগত ২৬ বছরেও এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা জানা যায়নি।
অপরদিকে ১২ জুন ১৯৯৬ বাঘাইছড়ি থানায় কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা গৃহীত হলেও ৬ মাস পর্যন্ত তার কোন কার্যক্রমেরা কথা জানা যায়নি। মামলা গ্রহণের প্রায় ৬ মাস পর ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৭ তারিখে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা শাখা, রাঙ্গামাটি’র নিকট হস্তান্তর করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ তারিখ হতে মামলার তদন্ত কার্যক্রম পুনরায় বাঘাইছড়ি থানায় স্থানান্তর করা হয়।
অপহরণ ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হয়, যাতে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ আদালত বাদীর দাখিলকৃত নারাজির উপর শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পুনরায় সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ জনৈক তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চট্টগ্রাম জোন সিআইডির পক্ষ থেকে চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্টেও অপহৃত কল্পনার কোন হদিশ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় এবং অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা লেঃ ফেরদৌসসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখান করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানান।
এমতাবস্থায় ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ রাঙ্গামাটিস্থ জজ আদালত স্বয়ং পুলিশ সুপার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাকে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার দায়িত্ব প্রদান করেন। এই প্রতিবেদনও অপহরণ ঘটনা ও দোষীদের ব্যাপারে সঠিক কোন দিশা দিতে পারেনি। উপরন্তু অপহৃত কল্পনার কোন হদিশ প্রাপ্তি ব্যতিরেকেই তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৩ কল্পনার ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের আদেশ প্রদান করেন। এ প্রেক্ষিতে গত ৬ মার্চ ২০১৪ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা তাদের ডিএনএ পরীক্ষামূলক নমূনা সংরক্ষণের আদেশকে হয়রানিমূলক বলে অভিহিত করে তা প্রত্যাহার করার আবেদন করলেও ঐ আদেশ বহাল রাখা হয়। এরপর গত ২০ জুলাই ২০১৪ রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার উপর রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করলেও বাস্তবে তদন্তে কোন কিছুই অগ্রগতি ঘটেনি।
কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা ও মামলার বিশ বছর ও পাঁচ মাসের অধিক সময় পর গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তাঁর রিপোর্টেও প্রকৃতপক্ষে দোষীদের ও অভিযুক্তদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয় এবং ‘…সার্বিক তদন্তে লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি নূরুল হক ও পি.সি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে দাবি করা হয়। এমনকি রিপোর্টে ‘কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়’ বলে স্বীকার করা হলেও ‘দীর্ঘ ২০ বৎসর ৩৯ জন তদন্তকারী অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমাকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ’ বলে দায়িত্বহীন ও হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ‘ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে’ বলে প্রকারান্তরে মামলার কার্যক্রম বা তদন্ত কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়।
বলাবাহুল্য, এরপরও কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা উক্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের উপর আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। এবিষয়ে আদালত গত ৮ জুন ২০১৭ প্রথম শুনানির আয়োজন করেন এবং নারাজির উপর পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে আদালত একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে সময় চাইতে থাকেন। বস্তুত পুলিশ, গঠিত তদন্ত কমিটি, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, আদালত, বিচার বিভাগ, সরকার তথা রাষ্ট্র কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার যথাযথ বিচারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আসল অভিযুক্ত ও অপরাধীদের অপরাধের দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রচেষ্টাই ফুটে উঠেছে প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনে। তাহলে ঘটনার পর থেকে তদন্ত কমিটি গঠন, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃক মামলা গ্রহণ ও পরিচালনা এবং তদন্ত কার্যক্রম, বিচারকার্য-এইসব কি কেবলই প্রসহন এবং দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে ধোকা দেয়ার প্রচেষ্টা?
প্রচার-অপপ্রচারের ব্যর্থ চেষ্টা
কল্পনা চাকমাকে কে বা কারা অপহরণ করেছে-এ নিয়ে একটি মহল কর্তৃক শুরু থেকে ভিত্তিহীন নানা কাহিনী সৃষ্টি ও প্রচার করতে লক্ষ্য করা যায়। এমনকি আদৌ অপহরণ করা হয়নি-এই ধারণাও তারা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা এটা সচেতনভাবেই করেছেন, যাতে মানুষ আসল ঘটনা বা অপরাধীদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বা সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ভিত্তিহীন কাহিনী শুনে শুনে ধাঁধার চক্করে ঘুরপাক খেতে থাকেন।
সেই সময় সেনাবাহিনী এবং তাদের মদদপুষ্ঠ একটি মহল থেকে অপহরণ ঘটনাকে নিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যা ও ভিত্তিহীন নানা বানোয়াট কাহিনী বানিয়ে অপপ্রচার করা হয়। প্রথমে তৎকালীন সেনা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে ‘গুজব’, ‘প্রেমঘটিত ব্যাপার’, ‘ত্রিপুুরায় দেখা গেছে’ বলে অপপ্রচারের চেষ্টা চালানো হয়। এক পর্যায়ে বদনামের বোঝা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে তৎকালীন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অপরহরণকারীর সন্ধান দিলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণাপূর্বক লিফলেট প্রকাশ করে হেলিকপ্টার দিয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়।
বছর দুয়েক আগে পার্বত্যনিউট.কম এর সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশ কর্তৃক শেয়ারকৃত ইউটিউবের এক ভিডিওতে বলা হয়, কল্পনা চাকমা স্টুডেন্ট হয়েও তার বাড়িতে নাকি কোন বই পাওয়া যায়নি, এমনকি তার পরিধেয় কোন পোশাকও পাওয়া যায়নি। কল্পনা চাকমার মা নাকি বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের নিকট স্বীকার করেন যে, কথিত অপহরণ ঘটনার পর দুইবার তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ হয়। মায়ের সাথে কথা বলার সময় কল্পনা চাকমা নাকি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে থাকার কথাও স্বীকার করেন। ভিডিওতে ইত্যাদি উদ্ভদ, ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট নানা কাহিনী ফেঁদে অবশেষে সেনাবাহিনী এই অপহরণের ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলেই প্রমাণ করার হাস্যকর ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এই অপপ্রচার যেন সেই ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদটির মত। ঘটনা ঘটিয়ে তারাই আবার খুব তৎপরতার সাথে এই হয়েছে, সেই হয়েছে, সেই করেছে, তারা করেছে-বলে নানান কথা, কাহিনী, খবর, প্রতিবেদন প্রচার করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন।
কিন্তু মানুষ বুঝে নিয়েছে যে, আসল ঘটনা কী এবং কে বা কারা এই জঘন্য অপহরণ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আর নিঃসন্দেহে বলা যায়, যারা এই নিয়ে অপপ্রচার চালিয়েছে এবং ঘটনাটি অস্বীকার করেছে, তারাও ভালো করে বুঝতে পেরেছেন যে, এটা কে বা কারা করেছে। বুঝতে পেরেছেন বলেই তারা এই অপহরণ ঘটনার যথাযথ বিচার করার সাহস পায় না এবং এর স্বপক্ষে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াতে পারে না।
বিচারহীনতা ও বৈষম্যের ২৬ বছর
কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু। এটি যেমন একটি মানবাধিকারের বিষয়, তেমনি এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন, সুবিচারের প্রশ্ন, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির প্রশ্ন এবং সরকার, রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কলঙ্ক মোচনের প্রশ্ন। তবে এটা সত্য যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি আজ ২৬ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এই রাষ্ট্র, সরকার, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সকলেই কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে, অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এটি দেশ, রাষ্ট্র, সরকার, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের জন্য চরম লজ্জাজনক।
উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্বকাল পর্যন্ত সরকারের উগ্রজাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী নীতির কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সেটেলার বাঙালীদের কর্তৃক অন্তত ৫০০ এর অধিক জুম্ম নারী খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, অপহরণের পর জোরপূর্বক বিবাহ, হয়রানিমূলক মামলা ও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসেনি। ফলে এর পরেও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও বাঙালি সেটেলারের দ্বারা অন্তত তিন শতাধিক জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
দেখা যায় যে, সমতল অঞ্চলে নারীর উপর সহিংসতার সকল ঘটনার বিচার না হলেও অথবা বিচারে বিলম্ব হলেও বেশ কিছু ঘটনায় সুবিচার পাওয়ার উদাহরণ দেখা যায়। অথবা চলমান কোন মামলায়ও সুবিচার পাওয়ার একটা আশা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের উপর সহিংসতার ক্ষেত্রে কোন একটি ঘটনারই সুবিচারের দৃষ্টান্ত বা দোষীদের শাস্তি পাওয়ার উদাহরণ পাওয়া যায় না। সে কারণেই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা কর্তৃক এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আর রাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকে বলেই ফেরদৌসকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। আর এদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীর জন্য যেন সাতখুন মাফ। বস্তুত কল্পনা অপহরণ ঘটনার বিচার হয়নি বলেই চুক্তির পরও শত শত জুম্ম নারীর উপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সরকার ও প্রশাসনের বিচারহীনতার ভূমিকায় দুস্কৃতিকারীরা উৎসাহিত হয়েছে, সাহস পেয়েছে এবং বারবার মানবাধিকার, আইন ও বিচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। এখানেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের উপর রাষ্ট্র, সরকার, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের চরম বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
পরিশেষে এটাই বলবো, কল্পনা চাকমা এখন এক চিরঞ্জীব ইস্যু, আলোচ্য বিষয় কিংবা দাবি ও স্মরণীয় ব্যক্তির নাম। যতদিন এই অপহরণ ঘটনার বিচার নিশ্চিত না হচ্ছে ততদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র এর দায় থেকে মুক্তি পাবে না। এমনকি বিচার নিশ্চিত হওয়ার পরও কল্পনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পৃথিবীর বুকে সেনাশাসন, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং আদিবাসী মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাসে এক সাহসী, প্রতিবাদী, আপোষহীন তারুণ্যদীপ্ত সংগ্রামী নেত্রী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। কেননা কল্পনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী আদিবাসী জুম্ম নারী সমাজের এক অগ্রসৈনিক। পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচালিত সকল জাতিগত সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা, নারী ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কন্ঠস্বর। কল্পনার চেতনার মৃত্যু নেই।
আমরা আশাও করতে পারি না, এই সরকার, রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনী কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার বিচার করবে বা করতে পারবে। কারণ এই ঘটনার বিচার করার জন্য যে নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা, সততা, সাহস ও উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধের দরকার, এই সরকারের তা আছে তার ছিটেফোঁটা লক্ষণও আমরা দেখতে পাই না। তবু আমরা কল্পনা চাকমা অপহরণ এবং রূপন চাকমা, সুকেশ চাকমা, মনোতোষ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমাকে হত্যার বিচার চাই, এবং চাইব। বহু বছর আগের স্বাধীনতা বিরোধী ও ধর্ষকদের, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এবং পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণের পর হত্যার শিকার দিনাজপুরের ইয়াসমিনের বিচার হতে পারে, তাহলে ফেরদৌসদের কেন বিচার হতে পারবে না! দেশের মানুষের এবং রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতি নির্ধারকদের ন্যায়বোধের জাগরণ হলে অতি সহসা এর বিচার হওয়া সম্ভব বলে বিবেচনা করা যায়।