রেং ইয়ং ম্রো
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়ার ভোগদখলীয় জুমভূমিতে গত ২৬ এপ্রিল আগুন দিয়েছে ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানি। কোম্পানির দখলকৃত জায়গায় যে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে সেখানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিকে ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্মিলিত রাবার চাষ প্রকল্প’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
কোম্পানিটির পরিচালক মো. কামাল উদ্দিনের নির্দেশে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল পূর্বোল্লিখিত জুমভূমিতে আগুন দেয়। এতে তিন গ্রামের আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০টি পরিবারের জীবিকার উৎস, জুমভূমি, ও শ্মশান পুড়ে যায়। অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয় আদিবাসীরা।
প্রায় সাড়ে তিনশ একর ফলজ বাগান ও বনভূমি পুড়িয়ে দেওয়ার পেছনে একটাই কারণ: ভূমির আসল মালিকদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ভূমি বেদখল করা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আদিবাসীদের ভোগদখলীয় জুমভূমি জমি জবরদখলের চেষ্টা করছে এই লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি। অনুসন্ধানে কোম্পানিটি কবে প্রতিষ্ঠিত হল, তার মূল অফিস কোথায়, অংশীজন কতজন সেসব সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। লামা উপজেলার ভূমি অফিস সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ‘বান্দরবান পার্বত্য জেলা রাবার এফ-২/৯৮/-৫৮৬ (২৪/১১/১৯৯৪ ইং)’ স্মারকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-কে অনিয়মের আশ্রয়ে-অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, মেরিডিয়ান প্রভৃতি কোম্পানির সাইনবোর্ড সামনে রেখে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য ও বেদখলের কর্মযজ্ঞ সেখানে বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে। অন্তত এক যুগ ধরে সেখানকার মানুষ মিথ্যা মামলা, প্রাণনাশের হুমকি, লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে ভয়ভীতিপ্রদর্শন, বন থেকে জীবিকা সংগ্রহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে উচ্ছেদের হুমকিসহ নানা সংকটের মাঝে জীবন যাপন করেছেন।নিজেদের পাড়া, ভিটেমাটি, জীবিকার সম্বল বন আর জুমভূমিগুলোকে রক্ষা করার জন্য পাড়াবাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন জনের কাছে আবেদনকরেছেন। আর্থিক টানাপোড়েনে জর্জরিত তিন কারবারি সমাধানের আশায় দিনের পর দিন হেঁটেছেন। কিন্তু সমাধান অধরাই রয়ে গেছে।
‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি’ স্থানীয় আদিবাসীদের যে জুমভূমিকে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে লিজ নেয়া কোম্পানির ভূমি বলে দাবি করছে তার কোনটিরও স্পষ্ট বৈধ মালিকানা তাদের নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, প্রথা, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী সেগুলোর প্রকৃত মালিকানা স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীর। যুগ যুগ ধরে যারা সেখানে বাস করে আসছেন ও বংশপরম্পরায় ভূমি ভোগদখল করে আসছেন।
এরপরেও পাড়াবাসীর শত বছরের ভোগদখলীয় বনভূমিকে নিজেদের ইজারা নেয়া ভূমি দাবি করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি পাড়াবাসীকে জুম চাষ ও বন থেকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংগ্রহে বাধা প্রদান করেছে। তারা পাড়াবাসীকে এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়েছে। মিথ্যা মামলা দায়ের করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সরল ও নিরীহ মানুষকে হয়রানি করেছে, পুলিশ ও মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের ভিটেমাটি থেকে হটিয়ে দিতে চাইছে।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ২০১৭ সালের ০৭ এপ্রিল জনৈক মকবুল আহামদ চাঁদাবাজি, অনধিকার প্রবেশ, মারধর, চুরি ও হত্যার হুমকি দানে’র মিথ্যা অভিযোগে স্থানীয় ১০ জন আদিবাসীর বিরুদ্ধে লামা থানায় মামলা করে। যার মামলার নাম্বার- ৬/৩৪। মামলার পাশাপাশি আদিবাসীদের আরও নানা উপায়ে হুমকি প্রদান করা হয়।
হয়রানির পরিমাণ বাড়তে থাকলে ২০১৭ সালের ৮ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বরাবর এই তিন পাড়া ছাড়াও নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়া পাড়ার বাসিন্দারা ‘ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে পাড়া থেকে উচ্ছেদের হুমকিতে আতঙ্কিত পাড়াবাসীকে রক্ষারআবেদন’ জানিয়ে একটি আবেদনপত্র লিখেছিলেন। সেখানে তারা লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি নামক ভূমিদস্যুর ভূমি বেদখল করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবেপাড়াবাসীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করার ও নানাভাবে হুমকিধামকি দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। আবেদনপত্রে তারা এটাও উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালের ৭ মার্চ দুপুরসাড়ে বারোটায় লামা আর্মি ক্যাম্প কমান্ডার তাঁদেরকে ডেকে এক সপ্তাহের মধ্যে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্যথায় বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করা হবে বলে আবেদনপত্রে এই হুমকির কথাও উল্লেখ করেছেন আদিবাসীরা।
এই আবেদনের পর সেবছরের ২৫ মে লামার নোয়া পাড়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, বান্দরবান জেলা প্রশাসক, লামা উপজলার নির্বাহী অফিসার, স্থানীয়গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও ভুক্তভোগী মানুষদের নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় প্রতিমন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয় মানুষদের ভূমিবেদখল করা হবে না এবং তাদের ভূমিতে তারা নিজেদের মত করে জীবন ধারণ করতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করা হয়। অভিযোগ ও আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্তের জন্যসহকারী ভূমি কমিশনার (ভূমি) ও কানুনগোর নিকট পাঠানো হয়।
এই প্রেক্ষিতে ১৫ জুনে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপারের নিকট জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই (নিরস্ত্র) মো. রফিকুল ইসলাম জামান তাঁর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলকরেন। তদন্ত প্রতিবেদনে উচ্ছেদের আতঙ্ককে হালকা করে লামায় উদ্ভূত পরিস্থিতিকে অনেকটা দায়সারাভাবে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক আগেথেকে ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজার নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়া পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা ৩/৪ শত একর ৩য় শ্রেণির জমিতে জুমচাষ, চাষাবাদ ও বাঁশ আহরণ করেজীবিকা নির্বাহ করে এসেছেন।
একইসাথে উক্ত জায়গার পাশে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩/৪ শত একর পাহাড়ি জমি সরকারিভাবে ইজারা নিয়েছে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এই দুই অবস্থানকে স্বীকার করে নেয়া হয়। তদন্তকারী তার প্রতিবেদনে আরও জানান, কোম্পানি ব্যবস্থাপক মো. আরিফ হোসেনউক্ত পাহাড়ে চাষাবাদ করতে স্থানীয়দেরকে নিষেধ করায় পাহাড় থেকে উচ্ছেদের আতঙ্ক কাজ করেছে। স্থানীয় মানুষদের সাথে প্রতিমন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরআলোচনা সভার পর উভয় পক্ষের দিক থেকেই শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
২০১৭ সালের ৩ অক্টোবরে উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো বিজয় শংকর চাকমা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিকট সরেজমিনে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানকরেন। উক্ত প্রতিবেদনে কোম্পানির দাবি অনুসারে তাদের লিজ নেয়া ভূমির প্রকৃত লিজ গ্রহণকারী ব্যক্তির পরিচয়ের অস্পষ্টতা ও লিজ চুক্তির শর্ত ভঙ্গের কথা উল্লেখকরা হয়েছে।
কোম্পানির দাবি করা ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজার রাবার/৮৫ নং হোল্ডিং এর ১০৫৫/২৪ নং দাগের ২৫ একর ভূমি ২৯/০৩/১৯৯৪ তারিখ হতে ৪০ বছরের জন্য লিজনিয়েছেন জনৈক মাহামুদুল হাসান, যার পিতা– আবু সৈয়দ চৌধুরী। রাবার/৯২ নং হোল্ডিং এর ১০৫৫/১৫ নং দাগের ২৫ একর করে ০৭/০৯/১৯৯৪ তারিখ থেকে ৪০বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন জনৈক হাফিজ শাহ নেওয়াজ সিদ্দিকী, পিতা– আলহাজ্ব মো. মোস্তফা। আবার কোম্পানির অংশীজন তালিকার ৩৫ নাম্বার অংশীজনের নাম মাহামুদুল হাসান থাকলেও তার পিতার নাম আবুল ময়ান লেখা হয়েছে। লিজ হোল্ডার ও এই অংশীদার মাহমুদুলের পিতার নাম ভিন্ন থাকায় তিনি একই ব্যক্তি কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলেও উল্লেখ রয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে এদের কারোরই অস্তিত্ব কিংবা প্রত্যক্ষ দর্শনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই দুই ব্যক্তির সাথে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির ব্যবস্থাপক মো. আরিফ হোসেন কিংবা পরিচালক মো. কামাল উদ্দিনের কী সম্পর্ক তাও স্পষ্ট নয়।
এছাড়াও বান্দরবান জেলার ২৪/১১/১৯৯৪ তারিখের স্মারক রাবার এফ-২/৯৪/-৫৮৬ তে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের অন্তর্ভুক্তির অনুমতিপত্রে ঘষামাজা করা হয়েছে বলেপ্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। লিজ গ্রহণের শর্তাবলীতে শুধুমাত্র রাবার চাষের জন্য এবং বরাদ্দ প্রাপ্তির পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্প কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেওবিগত ২৮ বছরে সেই ভূমিতে প্রকল্পের শুরু কিংবা শেষ করার কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি।
বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে ২০১৬ সালে বোমাং সার্কেলের কাছে ২০০০-২০১৬ সময়কালের ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ঘ খন্ডের ৮ নং ধারা অনুসারে, রাবার প্লান্টেশনের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমিতে জমি গ্রহণের ১০ বছরের মধ্যে জমির সঠিক ব্যবহার না করা হলে তাবাতিল করার বিধান রয়েছে। তারই আলোকে, ২০০৯ সালের ২০ জুলাই খাগড়াছড়িতে ও ১৮ আগস্ট রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয়স্থায়ী কমিটির সভায় এইরূপ বরাদ্দকৃত জমির ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে লিজের চুক্তি ভঙ্গের স্পষ্ট প্রমাণ, মালিকানার অস্পষ্টতা ও কাগজপত্রের বৈধতা নিয়ে সংশয় ইত্যাদি থাকার পরও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড স্রেফক্ষমতার দাপটে দস্যুপনা করে গেছে। শুধুমাত্র তাদের কাগজেকলমে দাবিকৃত অবৈধ লিজের ৫০ একর ভূমি নয়, এর বাইরেও প্রায় ৫০০ একরের মত ভূমি কোম্পানি লিজ নিয়েছে বলে ভূমির প্রকৃত মালিক স্থানীয় আদিবাসীদেরকে জানিয়েছেন কোম্পানি ব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন। কেবল তাই নয়, ভূমি জবরদখল করতে এর মধ্যেভাড়াটে বাহিনী এনে একরের পর একর বন কেটে উজাড় করেছে। এই ভূমি গ্রাস থেকে স্থানীয় আদিবাসী মানুষের ফলজ বাগান, জুমভূমি, চাষের জমি কিছুই রেহাই পায়নি।
৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির পরিচালক কামাল উদ্দিন ও মেরিডিয়ান এগ্রো লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপক মো: মেহেদী হাসান লামা উপজেলার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কোম্পানির লিজের জায়গায় অনধিকার প্রবেশ করে গাছ কেটে ফেলা এবং কাঠ চুরি করার অপরাধে ৮ জনপাড়াবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। যার মামলার নাম্বার জিআর ২৬/২০। এছাড়াও পরবর্তীতে কোম্পানির পক্ষ থেকে লামা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেপাড়াবাসীর বিরুদ্ধে ফৌজধারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করার আবেদন জানানো হয়।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর এই জবরদখলের প্রতিকার চেয়ে পুনরায় আবেদন করেন পাড়াবাসী। তারা সেখানে উল্লেখ করেন, ২২জানুয়ারি কোম্পানি বহিরাগত সন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গা লাঠিয়াল বাহিনী এনে তাদের বন কেটে সাফ করেছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
এর মধ্যে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি ও মেরিডিয়ান কোম্পানি মিলে স্থানীয় মানুষের ভোগদখলে থাকা শত শত একর বনভূমি কেটে সাফ করে জবরদখল করেছে। গত বছরের ১৫ জুন এই বেদখল ঠেকাতে ও চুক্তি ভঙ্গ করা লামা রাবার কোম্পানি ও মেরিডিয়ান কোম্পানির বরাদ্দকৃত সকল রাবার প্লট বাতিল করতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বরাবর আবারও আবেদনপত্র লেখেন পাড়ার বাসিন্দারা।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে লামা রাবার কোম্পানির ব্যবস্থাপক মো. আরিফ হোসেন ১৫০ জন রোহিঙ্গা শ্রমিক নিয়ে ৯নং ওয়ার্ড সরই ইউনিয়ন লামা উপজেলা লাংকম ম্রো পাড়ার দশ পরিবারের ১ম শ্রেণির জমির পাশে একাশিয়া গাছের বাগান, কলার বাগান, আম বাগান ও আনারস বাগান কেটে ফেলার হুমকি দেন। প্রতিকার পাওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও আঞ্চলিক পরিষদ বরাবর আবেদনপত্র লেখেন পাড়াবাসী।
কিন্তু তাঁদের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরং প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার পাড়াবাসীর সাথে কোম্পানির সমঝোতা বৈঠকের আয়োজনকরা হয়েছে। প্রতিবারই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও থানার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা পাড়াবাসীকে তাঁদের জমি বেদখল না হওয়ারআশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু সেই আশ্বাস আশ্বাসই রয়ে গেছে।
কোম্পানির বেপরোয়া দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এ বছরের ২০ মার্চ বান্দরবানে মানববন্ধন করেছেন তিন পাড়ার বাসিন্দা। এর কিছুদিন পর বহিরাগতসন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গা লাঠিয়াল বাহিনীদের দিয়ে পুনরায় জঙ্গল কেটেছে কোম্পানি। কেটে ফেলা বিশাল আকারের ভূমিতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামাল উদ্দিনের নির্দেশে ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল আগুন দিয়েছে তারাই।
এই আগুনে স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীর শুধু ভূমি নয়, সেইসাথে পুড়ে গেছে জীবন-জীবিকা। আগুনের কারণে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হওয়া মানুষগুলো এখন খাদ্য সংকটে ভুগছেন। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হল তারা তাদের পুড়ে যাওয়া জুমভূমির দখল ফেরত পাবেন কিনা সেই সংশয়, আশঙ্কা ও ভয় এখনও কাটেনি।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, “এই জমি লিজ নেওয়া হয়েছে। সেখানে রাবার চারা ও কাজু বাদাম লাগানোর জন্য জঙ্গল কেটে আগুন লাগানো হয়েছিল। এতে পাড়াবাসীর কারো কোনো ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সবার ঘর অক্ষতই আছে।” অথচ পাড়াবাসীদের ইতিপূর্বেকার আন্দোলন কর্মসূচি ও আবেদনগুলো থেকেও পরিস্কার যে আগুন লাগানো এই কোম্পানির তৎপরতার একটি ধাপ মাত্র, এর আগেও তারা এলাকাবাসীর ওপর নিপীড়ন, হুমকি-ধামকি ও হয়রানি করে আসছে। অন্যদিকে বনভূমিতে আগুন লাগার ফলে পরিবেশের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার পাশাপাশি বনের ওপর নির্ভরশীল আদিবাসীদের জীবন-জীবিকাও অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এই সব কিছুই করা হচ্ছে আদিবাসীদের জমি জবরদখলের উদ্দেশ্যে।
ত্রাণ নয়, পাড়াবাসী প্রতিকার চান
এর আগেও লামার পাড়াবাসীদের এই সংকট নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হয়েছে। কোম্পানির দ্বারা শত শত একর ভূমি বেদখল হওয়ার খবর ও স্থানীয় মানুষের হাহাকারের চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু তাতে কি কোম্পানির আগুন ঠেকানো গেল? তাহলে ওখানকার আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার কী হাল হবে? আপনার আমার পাঠানো সহযোগিতায় কতদিন টিকে থাকবেন তারা? বলে রাখা ভাল, এই তিন পাড়ায় প্রায় ৭০ পরিবারের মত ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এখানে থাকতেন। ২০১৭ সালের উচ্ছেদের হুমকির পর আতঙ্কিত হয়ে অনেক পরিবার ইতিমধ্যেই আশেপাশের গ্রামে সরে গিয়েছেন।
এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সহায় সম্বলহীন অবশিষ্ট মানুষদেরও নিশ্চিতভাবেই উচ্ছেদ হয়ে যেতে হবে। লিজের শর্ত পূরণ না করার পরও সে লিজ বাতিলকরণে মন্ত্রী ব্যর্থতা, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সমস্যার সমাধানে জেলা প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসী দস্যুপনার সাথে ক্ষমতাবানদের সম্পর্ক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অস্বচ্ছ অবস্থান, এমনকি কোম্পানির কাগজপত্র যাচাই না করে ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করা বোমাং সার্কেল– প্রত্যেকেই এই সরল ও নিরীহ মানুষগুলোর চরম দুর্দশার জন্য দায়ী।
এই ভাবে উচ্ছেদ ও দখল অব্যাহত থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কোনো জঙ্গল আর অবশিষ্ট থাকবে না, তা পরিণত হবে রাবার আর বাদামের কৃত্রিম বাগানে। এই সবুজ অরণ্য ও আদিবাসীদের সুরক্ষা দিতে হলে অবিলম্বে কোম্পানির ইজারা প্লট বাতিল ঘোষণা করে স্থানীয় মানুষের ভূমি ফিরিয়ে দিতে হবে।প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনা উস্কানিতে আগুন দিয়ে স্থানীয় মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করার জন্য কোম্পানিকে ও এর সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এই জুমের ওপর আদিবাসী নাগরিকদের ঐতিহাসিক অধিকারনিশ্চিত করতে হবে, ক্ষতিপূরণ আর ত্রাণের আওয়াজ তুলে অধিকারের প্রসঙ্গকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।
সূত্র: দৃকনিউজ