হিল ভয়েস, ৪ মে ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ বর্বরোচিত লংগদু গণহত্যাকান্ডের ৩৩ বছর। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও অবৈধ অনুপ্রেবশকারী মুসলিম বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক আদিবাসী জুম্মদের উপর সংঘটিত অন্যতম মানবতাবিরোধী ভয়াবহ গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। ১৯৮৯ সালের এই দিনে প্রায় সন্ধ্যার দিকে এই গণহত্যাকান্ড ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা শুরু হয়। ৪ মে শুরু হয়ে ৬ মে পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এই পাশবিক ধ্বংসলীলা। শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ ৩২ জন জুম্ম নিহত হয় এই গণহত্যায়, আহত হয় অন্তত ১১ জন এবং লংগদু সদরসহ লংগদুর আশেপাশের ৯টি গ্রামের ১০১১টি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হয় এবং লুটপাট চালানো হয়। একটি সরকারি প্রাথমিক ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৬টি বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয় এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। অনেকেই প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
ঘটনার সূত্রপাতঃ
৪ মে ১৯৮৯ বিকাল আনুমানিক ৪:০০টা হতে ৫:০০টার দিকে লংগদু সদর এলাকায় কে বা কারা লংগদু উপজেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সেটেলার বাঙালিদের নেতা আব্দুর রশিদ সরকারকে গুলি করে হত্যা করে। ধারণা করা হয়, পরবর্তী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ নিয়ে বাঙালি সেটেলারদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের জের ধরে আব্দুর রশিদ সরকারকে হত্যা করা হয়।
উক্ত ঘটনার কোনোরূপ তদন্ত না করে তৎকালীন সামরিক সরকার ও সেনাবাহিনী এই ঘটনাটিকে জুম্মদের উপর ষড়যন্ত্রমূলক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর একটি অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করে। জানা যায়, তাৎক্ষণিকভাবে লংগদু উপজেলার মাইনীমুখ সেনা জোনের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জাকির হোসেন ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িক রং দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে গ্রাম প্রতিরক্ষা পার্টি (ভিডিপি) ও অনুপ্রবেশকারী বাঙালি সেটেলারদের নেতাদের ডেকে জুম্মদের উপর হামলা চালানোর নির্দেশ দেন।
গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগঃ
মেজর জাকির হোসেনের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে সন্ধ্যা আনুমানিক ৬:১৫টার দিকে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সশস্ত্র ভিডিপি সদস্য ও বাঙালি সেটেলাররা সংগঠিত হয়ে জুম্মদের উপর হামলা শুরু করে। প্রথমে লংগদু সদরের জুম্ম অধ্যুষিত টিনটিলা এলাকায়, এরপর কয়েক মাইলব্যাপী একে একে মানিকজোড় ছড়া, বাত্যাপাড়া, লংগদু বড়াদম, মহাজন পাড়া, সোনাই, বামে আটরকছড়া, ডানে আটরকছড়া ও করল্যাছড়ি- মোট ৯টি গ্রামে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। ১৯৮৯ সালে ১৫ জুলাই জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত একটি ইংরেজি প্রতিবেদনে এই গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩২। কোনো কোনো তথ্যে এই সংখ্যা অন্তত ৫০ বলে উল্লেখ করা হয়।
হামলার মূল হোতা ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা হলেনঃ
(১) মেজর জাকির হোসেন, ১৪ ই বি আর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, মাইনীমুখ সেনা জোন হেডকোয়ার্টার্স, লংগদু, (২) ইউসুফ আলী (সেটেলার), ঠিকানা- ইসলামাবাদ (সেটেলার বসতি), সোনাই এলাকা, লংগদু, (৩) রুহুল আমিন (সেটেলার), মেম্বার, মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ, সোনাই এলাকা, লংগদু, (৪) নূরুল ইসলাম তালুকদার, ঠিকানা- সোনাই এলাকা, (৫) সিরাজ (সেটেলার), চেয়ারম্যান, আটরকছড়া ইউনিয়ন পরিষদ, লংগদু।
গণহত্যার শিকার ব্যক্তিগণঃ
(১) মিসেস অমিতা চাকমা (৩৮), স্বামী-অনিল বিহারী চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, (২) মুরতি মোহন চাকমা (৩৫), পীং-হেম চন্দ্র চাকমা, গ্রাম-মানিক্যা কার্বারি পাড়া, তিনি অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে গুলিতে নিহত হন এবং তিনি একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন, (৩) সজল চাকমা (৯), পীং-মুরতি মোহন চাকমা, ঠিকানা-ঐ, (৪) সুন্দয্যা চাকমা (৬০), পীং-পালঙ্যা চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, তিনি অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যার শিকার হন, (৫) জয় কুমার চাকমা (৭০), পীং-মৃত ইন্দ্রমনি চাকমা, গ্রাম-ঐ, তিনিও অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যার শিকার হন, (৬) মিসেস এমফলি চাকমা (৬৫), স্বামী-জয় কুমার চাকমা, গ্রাম-ঐ, তিনিও তিনিও অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যার শিকার হন, (৭) সূর্যমনি চাকমা (৩৮), পীং-অজ্ঞাত, গ্রাম-বগাচতর, তিনিও অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যার শিকার হন, (৮) সুষমা রঞ্জন চাকমা (৫৮), পীং-মৃত ধনেশ্বর চাকমা, গ্রাম-মহাজন পাড়া, বগাচতর ইউনিয়ন, তিনিও অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যার শিকার হন, (৯) জগত বসু চাকমা (৩৫), পীং-চিত্র রঞ্জন চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১০) মিসেস কালিন্দী চাকমা (৩০), স্বামী-জগত বসু চাকমা, গ্রাম-ঐ, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১১) মিসেস কিশোরী বালা চাকমা (৬০), স্বামী-চিত্ত রঞ্জন চাকমা, গ্রাম-ঐ, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১২) ভাগ্যদেবী চাকমা (২০), পীং-চিত্ত রঞ্জন চাকমা, গ্রাম-ঐ, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১৩) রাবেন্দু চাকমা (১২), পীং-সুভাষ বসু চাকমা, গ্রাম-ঐ, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১৪) সমর বিকাশ চাকমা (৮), পীং-সুভাষ বাবু চাকমা, গ্রাম-ঐ, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১৫) মিসেস নমিতা চাকমার তিন বছরের শিশুকন্যা, গ্রাম-ঐ, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (১৬) নব কুমার চাকমা (৫৫), পীং-তগলক্যা চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, (১৭) জাগরণ চাকমা (১৪), পীং-মৃত বিজয় শীল চাকমা, গ্রাম-মেরুং, দীঘিনালা উপজেলা, খাগড়াছড়ি, তাকে অনিল বিহারী চাকমার বাসভবনে গুলি করে হত্যা করা হয়, (১৮) শান্তি রঞ্জন চাকমা (১৪), পীং-লক্ষনা চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, তাকে টিনটিলা বাজারে গুলি করে হত্যা করা হয়, (১৯) মিসেস চারুবালা চাকমা (৫৫), স্বামী-মনজাঙ্গ্যা চাকমা, গ্রাম-ঐ, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২০) ঈশ্বর চাকমা (৪৫), পীং-সুবর্ণ চাকমা, গ্রাম-বাত্যাপাড়া, তাকে মাইনীমুখ বাজারে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২১) মিসেস আকপালি চাকমা (৭৩), স্বামী-রিজাপ্যা চাকমা, গ্রাম-লংগদু বড়াদম, তাকে বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, (২২) মিসেস তরুলতা চাকমা (৭০), স্বামী-ধলাচান চাকমা, গ্রাম-পয়সারাম মহাজন পাড়া, তাকেও বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, (২৩) বলরাম চাকমা (৭৫), পীং-মৃত কান্দারা চাকমা, গ্রাম-সোনাই, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২৪) মিসেস বুড়ি চাকমা (৭৫), স্বামী-মৃত কৈলাশ চন্দ্র চাকমা, গ্রাম-সোনাই, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২৫) মিসেস নন্দরানী চাকমা (৭৫), স্বামী-গোলক ধন চাকমা, গ্রাম-সোনাই, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২৬) মিসেস পয়সাবি চাকমা (৭৫), স্বামী-কুলুক্যা চাকমা, গ্রাম-সোনাই, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২৭) প্রিয় চাকমা (৬৫), পীং-উল্লেয়্যা চাকমা, গ্রাম-করল্যাছড়ি, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২৮) ক্যমং মারমা (৫৫), পীং-হ্লা সাথুয়াই মারমা, গ্রাম-হারবাং, কক্সবাজার, তাকে করল্যাছড়ি বাজার থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (২৯) রাঙা মং মারমা (৫০), গ্রাম-ঐ, তাকেও করল্যাছড়ি বাজার থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (৩০) জয়ন্ত চাকমা (৬০), পীং-সূর্য মোহন চাকমা, গ্রাম-ডানে আটরকছড়া, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (৩১) কমল কৃষ্ণ কার্বারি (৬৫), পীং-কাল্যা চাকমা, গ্রাম-ইউরেংছড়ি, তাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, (৩২) মিসেস অমিয় তারা চাকমা (৪৫), স্বামী-সুধাংশু বিমল চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, তিনি ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে কর্মচারী, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গুরুতর আহত ব্যক্তিরা হলেনঃ
(১) সুধাংশু বিমল চাকমা (৫০), পীং-মৃত চন্দ্রনাথ চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা, তিনি একজন কৃষি বিভাগের সরকারি কর্মচারী, (২) মিসেস লক্ষণাদেবী চাকমা (৩০), স্বামী-প্রভাত চাকমা, গ্রাম-বগাচতর, (৩) মিসেস পূর্ণশোভা চাকমা (৩৫), স্বামী-মৃত বিজয় শীল চাকমা, গ্রাম-মেরুং, দীঘিনালা, (৪) পবন চাকমা (৩৬), পীং-অজ্ঞাত, তিনি অনিল বিহারী চাকমার বাসায় হামলা আহত হন, (৫) মিসেস ডলি চাকমা (২১), স্বামী-ধন চাকমা, গ্রাম-খেদারমারা, বাঘাইছড়ি, (৬) আঁখি চাকমা (৯), পীং-চিত্ত রঞ্জন চাকমা, গ্রাম-বগাচতর, মহাজনপাড়া, (৭) হোলি চাকমা (৩), পীং-চিত্ত রঞ্জন চাকমা, গ্রাম-ঐ, (৮) মিসেস রূপালী চাকমা (২৭), স্বামী-স্নেহ রঞ্জন চাকমা, গ্রাম-ঐ, (৯) শান্তি বিকাশ চাকমা (৩৬), পীং-শরৎ কুমার চাকমা, গ্রাম-লংগদু বড়াদম, (১০) গলই চাকমা (৬৫), পীং-কালাচান চাকমা, গ্রাম-বাত্যাপাড়া, (১১) মিসেস নমিতা চাকমা (১৯), স্বামী-মঙ্গল চন্দ্র চাকমা, গ্রাম-টিনটিলা।
আক্রান্ত বৌদ্ধ বিহারসমূহঃ
(১) টিনটিলা বনবিহার, (২) মনোরমা বৌদ্ধ বিহার, আটরকছড়া, (৩) দশবল ধর্মরত্ন বৌদ্ধ বিহার, সোনাই, (৪) সোনাই বৌদ্ধ বিহার, সোনাই, (৫) করল্যাছড়ি বৌদ্ধ বিহার, করল্যাছড়ি, (৬) বড়াদম বৌদ্ধ বিহার, লংগদু বড়াদম।
অগ্নিদগ্ধ স্কুলসমূহঃ
(১) সরকারি প্রাথমিক স্কুল, সোনাই ও (২) লংগদু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বড়াদম।
লংগদু গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাসহ তিন পার্বত্য জেলা ও দেশের সকল আদিবাসী জুম্মদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে এবং চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তখনও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সামরিক শাসন চলছে। অপরদিকে সারাদেশে সমতল অঞ্চলে এরশাদবিরোধী আন্দোলনও চলছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন সামরিক শাসকদের প্রবল দাপট। মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধ। তারপরও ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী, বিবেকবান ও সচেতন মানুষ চুপ করে থাকতে পারেনি এমন পাশবিক বর্বরতায়।
৭ মে ১৯৮৯ লংগদু উপজেলার জুম্ম জনগণ এই গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্টের বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। তারা ঘটনার তদন্ত ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানান।
৯ মে ১৯৮৯ চাকমা সার্কেল চীফ ও রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, সাবেক সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, সাবেক সংসদ সদস্য সুদীপ্তা দেওয়ানসহ ২২ জন নেতৃস্থানীয় জুম্ম লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন যে, গত ৫ মে ১৯৮৯ লংগদু উপজেলার টিনটিলায় রাঙামাটির ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার শাফাত ও রাঙ্গামাটি শহরের কিছু জুম্ম নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অনুপ্রবেশকারী বাঙালি মুসলিম সেটেলার ও কিছু জুম্ম জনগণকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় জনৈক মুসলিম সেটেলার চিৎকার করে বলেন যে, আমরা এ পর্যন্ত কোনো কিছু (গণহত্যা) ঘটাইনি, যদিনা আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ ও নির্দেশনা না পাই এবং আমরা আরও কোনো কিছুই ঘটাব না যদি না আরও নির্দেশ ও নির্দেশনা না পায়। উক্ত মুসলিম সেটেলারের বক্তব্য থেকেও লংগদু গণহত্যা কিভাবে, কারা করেছিলো তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
স্মারকলিপিতে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, শ্বেতপত্র প্রকাশ, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, লংগদুসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি সেটেলারদের প্রত্যাহার, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়।
২১ মে ১৯৮৯ সদ্য গঠিত বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে গণহত্যার প্রতিবাদে মৌন মিছিলের আয়োজন করা হয়। ঢাকায় বিভিন্ন জাতীয় ছাত্র সংগঠনসমূহও সংহতি প্রকাশ করে মৌন মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবরে ৬ দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
এছাড়াও দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ও মহলের উদ্যোগে নানাভাবে উক্ত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝর ওঠে।
কিন্তু এরপরও এবং এখনও পর্যন্ত লংগদু গণহত্যার বিষয়ে কোনো প্রকার তদন্ত এবং দোষীদের উপযুক্ত শান্তি প্রদানের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহকেও যথাযথ ক্ষতিপূরণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক সংঘটিত ১৫টি গণহত্যার মধ্যে লংগদুতে এই ৪ মে ১৯৮৯ এর গণহত্যা ছাড়াও, আরও দুটি লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩০ জুলাই মুসলিম সেটেলাররা লংগদুর বটতলায় একটি গণহত্যাকান্ড ঘটায়। ঐদিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রজনীকান্ত চাকমাসহ ৯ জুম্ম গ্রামবাসী মাইনীমুখ বাজার থেকে বোটে বাড়ি ফেরার পথে বটতলা নামক স্থানে সেটেলাররা হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে। অপরদিকে আরেকটি গণহত্যাকান্ড হল ১৯৯২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সেটেলার বাঙালি ও ভিডিপি কর্তৃক সংঘটিত বাঘাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী লংগদুর মাল্যা হত্যাকান্ড। এ ঘটনায় ১৪ জুম্মকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এইসব গণহত্যা ছাড়াও লংগদুতে বহুবার সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়, শত শত বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বহু জুম্ম নারী হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়।
বলাবাহুল্য, এসব কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি এবং দোষীরা শাস্তির সম্মুখীন হয়নি। সামরিক সরকারের কথা বাদ, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারই এব্যাপারে কোনো ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসেনি। এমনকি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দল ও সরকার হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ বা মহাজোট সরকারও এইসব মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের সুবিচার নিশ্চিত করতে কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দেখায়নি। এইভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হয়ে চলছে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা। নেতা, নেতৃত্ব, সরকার, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্র কারোরই যেন দায় নেই, বিবেক নেই, অনুশোচনা নেই। যেন তাদেরই সম্মতিতে এইসব গণহত্যা, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখলসহ জুম্মদের ধ্বংস করার আয়োজন চলছে নিরন্তরভাবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রাষ্ট্র ও সরকারের এহেন অবস্থা বড়ই করুণ, বড়ই লজ্জাজনক বলতে হয়।