পার্বত্য চুক্তি নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপপ্রচার ও অপতৎপরতার শেষ নেই!

বাচ্চু চাকমা

সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলী পাহাড়কে আরও জটিল ও ভয়াবহ করে তুলছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি’র বক্তব্য উস্কানিমূলক। তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি যুদ্ধ করতে চান, আসুন, যুদ্ধ করি। এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার নিয়ে আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চান, আধা-ঘন্টাও টিকতে পারবেন না। ৩০ মিনিট যুদ্ধ করতে পারবেন না, আসুন জায়গা ঠিক করি।’বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তা ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির মুখে এধরনের বক্তব্য সত্যিই দেশের জন্য হতাশাব্যাঞ্জক।

আচ্ছা, আপনারা উস্কানিমূলক কথা বলতেই থাকবেন আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ কি শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে? বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী যদি মনে করে পাহাড়ের আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীকে আজীবনই শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভূমিতে ভগবান-ঈশ্বর কিংবা আল্লাহ তাদেরকে পাঠিয়েছে; তাহলে ধরে নিন, এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় ঘনিয়ে আসছে। এরকম হলে পরে এক সময় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে এই জিওসিকে ফিরে যেতে হবে।

জিওসি আরও ‘আজকের বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেই ৮০ দশকের কিংবা ৯০ দশকের সেনাবাহিনীর নয়’বলে যে দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছেন, সেই শক্তি তিনি কাকে দেখাচ্ছেন? সেনাবাহিনীর একজন জিওসি’র এতোটাই বালকসূলভ বক্তব্য কেমনে হতে পারে! পরিবেশ পরিস্থিতি ও বাস্তবতা না বুঝে কথা বলা এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তা পাওয়ার জন্য তো বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ করেনি এবং এজন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন ও রক্ত ঢেলে দেয়নি! সেনাবাহিনীর এই জিওসি যতই গায়ের জোর দেখাক না কেন, তারপরও আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি, আমাদেরও যুদ্ধ বিজয়ের ইতিহাস রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যেকোন মূল্যে পাহাড়ের বুকে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। জুম্ম জাতির জাতীয় জীবনে বারে বারে সংকট নেমে এসেছিল ঠিক, কিন্তু জাতির দুর্দিনে সংকট মোকাবেলায় অসীম সাহস নিয়ে পাহাড়ের বুকে আমাদের জুম্ম জাতির বীর সেনানীরা এগিয়ে এসেছিল। তাঁদের মেধা, ঘাম, রক্ত ও জীবন দিয়ে গড়ে উঠেছে জুম্ম জাতির সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি তথা বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে কেন্দ্র করে মনগড়া, একদেশদর্শী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা ভাবতেও পারি না, একটি দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও পুলিশ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার মুখ থেকে এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য কী করে বের হয়? কোনো সভ্য সমাজের মানুষ এধরনের মিথ্যাচার ও কেবলই মনগড়া কথাবার্তা গ্রহণ করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম তরুণ সমাজ তথা সমগ্র দেশে-বিদেশে জুম্ম জনগণসহ অপরাপর অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ব্যক্তি ও সংগঠন ক্ষমতাসীন দুই মন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির বক্তব্যকে নানাভাবে ধিক্কার ও নিন্দা জানিয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র দেশে-বিদেশে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তমনা মানুষের সঙ্গে আমিও একমত পোষণ করে মিথ্যাচারীদের বিরুদ্ধে কলম না ধরে থাকতে পারলাম না। কোনো সভ্য সমাজে, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এধরনের গোয়েবলসীয় প্রোপাগাণ্ডা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি এইসব মন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তার দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র বলতে লেশমাত্র নেই। আমাদের সুস্থভাবে জীবন যাপন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনিশ্চিত ও নিরাপত্তাহীন জীবনকে সাথে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জুম্ম জনগণ পাহাড়ের বুকে দিনাতিপাত করছে। পাহাড়ের এই নির্মম বাস্তবতা, ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য কেবল সেনাবাহিনী ও সরকার দায়ী।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন ও সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় ইসলামীকরণ বন্ধ হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। বিপরীত পক্ষে সরকার একদিকে ইসলামীকরণ নীতি বাস্তবায়ন এবং অপরদিকে জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি একেবারে বিলুপ্ত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন তথা সামরিকায়ন অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮০ সালে প্রবর্তিত ‘অপারেশন দাবানল’ এর পরিবর্তে ২০০১ সাল থেকে ‘অপারেশ উত্তরণ’ প্রতিস্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একপ্রকার সামরিক শাসন জারী রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে ও সহায়তায় সমতল ভূমি থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী ও মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহতভাবে অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। বহিরাগত সেটেলার বাঙ্গালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জিওসির আকাশ-কুসুম কল্পনা বলে জুম্ম জনগণকে গায়ের জোর দেখিয়ে চেঁচিয়ে গেলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জিওসি বরঞ্চ পাহাড়ের সমস্যাকে দিন দিন ঘোলাটে করার হীন উদ্দেশ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী সকল অস্থায়ী সামরিক, আনসার এবং ভিডিপির ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা বলা আছে। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস থাকতে পারবে, তার মধ্যে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান তিন জেলায় তিনটি আর আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালাসহ ৬টি। সরকারের মতে, প্রায় ৫০০ এর অধিক অস্থায়ী ক্যাম্প হতে ২৪০টি ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির মতে, তিন দফায় মাত্র ১০০টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো ৪০০-এর অধিক অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। ক্যাম্প প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া ২০০৯ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। উপরন্তু চুক্তি লংঘন করে ইতোমধ্যে আরো বেশ কিছু নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার জিওসি কিংবা মন্ত্রী কাউকে দেওয়া হয়নি।

এবার আসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে। রাঙ্গামাটিতে বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য পাহাড়ের মানুষ কিভাবে নিয়েছে? পার্বত্য চট্টগ্রামের কার্বারী, হেডম্যান, তিন পার্বত্যাঞ্চলের রাজা, জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তার সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য অনুসারে বলা যায়, এই এলাকার মুরুব্বিদের একটা অনুরোধ ছিল, এই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির জন্য নানান ধরণের পরামর্শ দিয়েছেন পার্বত্যাঞ্চলের হেডম্যান, রাজা ও জনপ্রতিনিধিরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা বলেছেন, চাঁদাবাজির কথা বলেছিলেন, সন্ত্রাসের কথা বলেছেন, দল-উপদলের মধ্যে মারামারির কথা বলেছিলেন-এটাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছে। আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের সেনাবাহিনী দীর্ঘকাল ধরে শান্তির জন্য কাজ করছেন, তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে এবং আমাদের শান্তি চুক্তি যে হয়েছিল-সেই চুক্তিকে সামনে রেখে সেই চুক্তির একটা শর্ত ছিল, সেনাবাহিনীর যে ক্যাম্পগুলো পরিত্যক্ত ছিলো সেগুলোকে আমরা পুলিশ দ্বারা পরিপূরণ করবো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রনোদিত যা চুক্তির সাথে সম্পূর্ণভাবেই সাংঘর্ষিক। চুক্তির ১৭(খ)-ধারাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।’ সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোর স্থানে চুক্তিতে কোন খন্ডে কিংবা কোন ধারায় পুলিশ দ্বারা পূরণের কথা বলা হয়েছে তা আমার জানা নেই। মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যাতে করে ঐ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা অব্যাহত থাকে সেই লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে একসাথে নয়, ধীরে ধীরে আর্মড পুলিশ মোতায়েন করতে যাচ্ছি। লক্ষ্য একটাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে শান্তির সুবাতাস বইতে পারে, এই এলাকায় সবার প্রচেষ্টায় শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করবো।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান ও স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। এযাবতকালে সরকারের কোন ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা দেখা যায়নি। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ করলে স্পষ্ট হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জিইয়ে রেখে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করতেই তিনি আগ্রহী।

সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত জিওসির বক্তব্য প্রসঙ্গে কিছু কথা না বললে নয়। জিওসি তার বক্তব্যে সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত করে জেএসএসকে দায়ী করেছেন। তার এই বক্তব্য পক্ষপাতমূলক ও চরম উস্কানিমূলক বলা যায়। সেনাবাহিনীর সিনিয়র একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বক্তব্য এধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতেও কষ্ট লাগে! যে পাহাড়ের বুকে বসবাস করা জুম্ম জনগোষ্ঠীর মানুষজন যুগ যুগ ধরে শত বঞ্চনা ও অবহেলার স্বীকার, বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, নিপীড়নের স্বীকার হয়ে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, এধরনের অসহায় জুম্ম জাতি ও মানুষের সাথে উগ্র জাত্যাভিমানের দাম্ভিকতা দেখিয়ে গায়ের জোরে কিংবা শক্তির জোরেই পাহাড়ের মানুষকে দমন-পীড়ন করতে আগ্রহী, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির বক্তব্যেই স্পষ্ট প্রমাণ হয়ে গেল। যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করে দেখা কিংবা ছোট করে দেখা এবং প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা একজন সেনানায়কের অযোগ্যতারই বহিঃপ্রকাশ।

দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সদস্যরা প্রমাণ করে দেখিয়েছে, যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের নিয়ন্ত্রক কেবলই মানুষ, অস্ত্র নয়। আত্মবিশ্বাসের জোরে, যুদ্ধ জয়ের অদম্য দৃঢ়তা, নৈতিক মনোবল তথা জ্ঞান, বুদ্ধি ও কৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে কাবু বানিয়েছিলো এবং এক সময় আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিলো। এবিষয়ে জিওসির যদি কিঞ্চিৎ ধারণা থাকতো তাহলে জুম্ম জনগণের সংগ্রামকে নিয়ে এধরনের বেফাঁস মন্তব্য করতেন না। ঠাট্টা-তামাশা করে জুম্ম জনগণের সংগ্রামকে উড়িয়ে দিতেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে ছোট-বড় যে যুদ্ধ হয়েছে তা শক্তি আর গায়ের জোরে হয়নি, যুদ্ধ করতে হলে দরকার অদম্য দৃঢ়তা, ধৈর্য্য, সাহস ও নৈতিক মনোবল। অনিয়মিত যুদ্ধ আর নিয়মিত যুদ্ধ যে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা বুঝতে পারে না, তারমধ্যে এমন গায়ের জোরই প্রাধান্য পাবে তা স্বাভাবিক!

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সকল সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন। তৎকালীন সময়ে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীও বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিলো, একটা সুচ পর্যন্ত রেখে আসেনি জেএসএস। তারপরও সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি সকল অস্ত্র ও গোলা-বারুদ জমা দেওয়া হয়নি বলে জনসংহতি সমিতিকে দোষারোপ করেছেন।

জিওসির ভাষ্যমতে, চুক্তিতে সরকারের শর্ত পালনের জন্য অনেকগুলো ধারা ছিল আর জনসংহতি সমিতির পালনযোগ্য ছিল মাত্র দুটি ধারা। খ-খন্ডের অনুচ্ছেদ ১৩ ও অনুচ্ছেদ ১৪, যেখানে বলা আছে-জনসংহতি সমিতি তাদের সকল অস্ত্র সমর্পণ করবে এবং তাদের সকল আর্ম ক্যাডার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। এই দুটি ধারার মধ্যে জনসংহতি সমিতি একটাও বাস্তবায়ন করেনি বলে জিওসি মিথ্যাচার করে গেলেন। চুক্তি বাস্তবায়নের গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেকে নির্লজ্জের মতো আওয়ামী লীগের তাঁবেদার কিংবা লেজুড় হিসেবে জুম্ম জনগণের সামনে প্রমাণ করলেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করবে নাকি নিজস্ব একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে যাবে? বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন আওয়ামী লীগ দলের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছে তারই স্পষ্ট প্রমাণ হল ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির বক্তব্য। সদিচ্ছা কার নেই? এমন প্রশ্ন করতে জিওসির গলায় একটুও আটকায়নি! সদিচ্ছার অভাব জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের নয়, সদিচ্ছার অভাব প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগ সরকারের তথা সেনাবাহিনীর।

জিওসি জনসংহতি সমিতিকে ইঙ্গিত করে আরও বলেন, একটি দল হতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভাগ করে নিয়েছেন নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের জায়গা হিসেবে, নীরবে চাঁদাবাজি আদায় করছেন যাতে অতিরিক্ত অস্ত্র কিনতে পারেন- জিওসির এমন মনগড়া বক্তব্য সম্পূর্ণ উস্কানিমূলক। কোটা প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, কোটা কেন দরকার আর কোটা কেন প্রয়োজন হয়? তার কোন সম্যক ধারণা আপনার নেই। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিশেষ কোটার প্রয়োজন হয়, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ সমতল অঞ্চলের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাথে শিক্ষার ক্ষেত্রে, চাকরির ক্ষেত্রে কিংবা অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারে না বলে জুম্মদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেও কোটা বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। জুম্মদের কোটা বিষয়েও জিওসির এলার্জি রয়েছে, তা স্বীকার করে নিজের সংকীর্ণতাকে চেপে রাখতে পারেননি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন তত্বাবধায়ক সরকারসহ দলীয় রাজনৈতিক সরকার বহুবার অদলবদল হয়েছে, কিন্তু কোন সরকার আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাশাসন হতে মুক্তি দিতে পারেনি। কোন সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের উপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, অত্যাচার, অবিচার থামাতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ সেনাশাসনকে বৈধতা দিয়ে জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনকে দিন দিন হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মূলত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ফ্যাসীবাদী কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামিক সম্প্রসারণবাদ কার্যকর করতেই প্রত্যেকটি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের নীতি অব্যাহতভাবে গ্রহণ করে এসেছে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কোন বিকল্প নেই।

More From Author