মিতুল চাকমা বিশাল
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্রযন্ত্র আবারো সামরিকায়ন, শক্তি প্রয়োগের নীতি এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের উল্টো পথে হাঁটছে। সত্যি বলতে আমরা এমন এক দেশে বসবাস করছি, যেখানে রাষ্ট্রের অখন্ডতা এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্য থাকা সত্ত্বেও নিজের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে নিজ দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আর সন্ত্রাসীর খেতাব পেতে হয়। বাস্তবিকপক্ষে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা কি, সেটাই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। অতি সম্প্রতি মন্ত্রী-আমলাদের যতসব আজগুবি কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, পাহাড়ে এখন যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শুরু করতে পারলেই রাষ্ট্র বাঁচে। তাদের এহেন যুদ্ধংদেহী মনোভাবই বলে দেয় যে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে তারা কতটা আন্তরিক ও সচেষ্ট।
পাহাড়ের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সেকাল এবং একাল বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পাহাড় ভালো নেই। শান্তির প্রত্যাশায় ২৫ বছর পূর্বে সই করা পার্বত্য চুক্তি এখনও অন্ধকারেই রয়েছে, যা হতাশাজনকও বটে। ধুমধাম করে দেশের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পাহাড়ে এসে আইন-শৃঙ্খলা সভা করে গেলেন, মোটা করে সংবাদ মাধ্যমকে কিছু সাক্ষাতকারও দিয়ে গেলেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যতে পাহাড়ে শান্তি আনয়নে, চুক্তি বাস্তবায়নে, পার্বত্য অঞ্চলের জনমানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন নাম-গন্ধই নেই। তাদের বক্তব্য যেন হিংসার একেকটি ঝর্ণাধারা। তাদের মুখনিঃসৃত শব্দাবলী এতটাই বিদ্বেষ-প্রসূত যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে কিংবা ৯৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে পাহাড়িদের থাকার কোন যৌক্তিকতাই নেই, অধিকার সে তো অনেক দূর।
জিওসি সাইফুল আবেদীন যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির উপরে তার অগভীর এবং অপর্যাপ্ত জ্ঞানের প্রভাব এবং একজন অযোগ্য সেনানায়কের উদ্ভট কথন মাত্র। তিনি এটা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন যে, এই চুক্তি কেবল এক সামরিক চুক্তি নয়, নয় কেবল অর্থনৈতিক কিংবা কোন সামাজিক-সাংস্কৃতিক একটি চুক্তি। এটি একটি রাজনৈতিক চুক্তি। জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের চুক্তি এটি। সুতরাং এই চুক্তির একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য এবং তাৎপর্য আছে। অতএব, এই চুক্তিকে কেবল শক্তির ভারসাম্যের মাপকাঠি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করার অর্থ হচ্ছে, পাহাড়ের সমস্যাকে অনুধাবন করতে না পারার ব্যর্থতা এবং সমস্যাকে জিইয়ে রাখার মানসিকতা ধারণ করা।
প্রসঙ্গত, সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিসনের জিওসি তার বক্তব্যে বলেছেন যে, জনসংহতি সমিতি তার পালনীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। তিনি আরো বলেছেন, জনসংহতি সমিতি তার সব অস্ত্র জমা দেয়নি, চুক্তির ঐ ধারাগুলো নাকি বাস্তবায়ন করা হয়নি। স্মর্তব্য যে, ঐতিহাসিকভাবে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ নং ধারায় উল্লেখ আছে যে, “জনসংহতি সমিতি ইহার সশস্ত্র সদস্যসহ সকল সদস্যের তালিকা এবং ইহার আয়ত্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিবরণী এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে সরকারের নিকট দাখিল করিবেন। এবং সরকার ও জনসংহতি সমিতি যৌথভাবে ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের জন্য দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করিবেন এবং তালিকাভুক্ত সকল সদস্যদেরকে পরিবারবর্গের সাথে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের জন্য সব রকমের নিরাপত্তা প্রদান করা হইবে। ঐ নির্ধারিত সময়ে যারা অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দিবেন, তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা এবং মামলা থাকলে সেগুলো প্রত্যাহার করা। এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে কেহ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমাদানে ব্যর্থ হইলে তার প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।”
উল্লেখ্য যে, জনসংহতি সমিতি চুক্তির কথামত ৪৫ দিনের মধ্যে তালিকা প্রস্তুত করে সরকারের কাছে দাখিল করেছে এবং তার মধ্যেই অস্ত্র-গোলাবারুদ জমাদানের দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করে মোট ১৯৪৭ জন সশস্ত্র সদস্য তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেছে। তাদেরকে সরকার চুক্তির ১৬(ক) অনুসারে পরিবার প্রতি ৫০,০০০ টাকা প্রদান করেছে। এছাড়া জেলে অন্তরীণ থাকা ১৯ জন জনসংহতি সমিতির সদস্যকে সরকার মুক্তি দিয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকেও উক্ত ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়েছে। তবে উল্টোদিকে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও আজ অবধি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত কোন গেজেট জারী করা হয়নি।
জিওসি আরো বলেছেন, অউপজাতীয়দেরকে বাদ দিয়ে পাহাড়ে শান্তি স্থাপন কোনভাবেই সম্ভব নয়। এটি নাকি একটি আকাশ কুসুম কল্পনা। এমনকি এই দাবি যারা করে, তাদেরকেও তিনি এই দাবি থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান।
উল্লেখ্য যে, এই চুক্তিটি লিখিত এবং অলিখিত উভয়ভাবেই সম্পাদিত। লিখিত অংশের ১ম ধারাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে একটি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে এবং এর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করা হবে মর্মে চুক্তিতে লেখা হয়েছে। অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য অউপজাতীয়দের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জিওসি নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন, বর্তমানে পাহাড়ে পাহাড়ি-বাঙালি অনুপাত ৫১:৪৯। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য কিভাবে সংরক্ষিত হবে, সেটা আমাদের বোধগম্যতার বাইরে। একইভাবে অলিখিত বিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে, ১৯৭৯ সাল থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুনর্বাসিত সকল বহিরাগত বাঙালি মুসলিম মুসপরিবারগুলোকে সম্মানজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাইরে পুনর্বাসন করা। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে অনেক প্রচেষ্টা করে, বার বার বলা হয়েছিল বিষয়টি চুক্তিতে লিপিবদ্ধ করানোর জন্য। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বড় গলায় বলেছিলেন, তার উপর ভরসা রাখতে।
অপরদিকে অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা নির্ধারণে পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা’ বলিতে যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা-জমি আছে এবং পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণতঃ বসবাস করেন, তাহাকে বুঝাইবে এবং এই লক্ষ্যে একই খন্ডের ৪নং ধারার ‘ঘ’ উপধারাতে উল্লেখ আছে যে, কোন ব্যক্তি অউপজাতীয় কিনা এবং হইলে তিনি কোন সম্প্রদায়ের সদস্য তাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেট দাখিল সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ স্থির করিবেন এবং এতদসম্পর্কে সার্কেল চীফের নিকট হইতে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট ব্যতীত কোন ব্যক্তি অউপজাতীয় হিসেবে অউপজাতীয় সদস্য পদের জন্য আবেদন করিতে পারিবেন না। এবং পার্বত্য এলাকায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে, নাগরিককে অবশ্যই ‘পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা’ হতে হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো এতদঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের অন্যতম রক্ষাকবচ। সুতরাং জিওসির বক্তব্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং তার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে সেটেলারদেরকে পাহাড়ে বৈধতা দেওয়ার পক্ষে।
তিনি আরও বলেছেন যে, পাহাড়িরা আজ অনেক শিক্ষিত এবং সেটা রাষ্ট্রের দেওয়া ‘কোটা’ নামক অনুগ্রহ ও করুণার ভিত্তিতে। আমি এখানে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, রাষ্ট্র সেবায় নিয়োজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও বাংলাদেশের আইনের বিষয়ে কিঞ্চিৎ ধারণাটুকুও তার নেই। যা আমাদের দেশের জন্য এবং সমগ্র বাংলাদেশীদের জন্য লজ্জাজনক এবং অপমানজনক। জিওসিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার নামক তৃতীয় ভাগের ২৮নং অনুচ্ছেদের ৪নং ধারায় সুস্পষ্ট করে বলা আছে যে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।’
আর এটাও সত্য যে, এই অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ একটি এককক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ তথা এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্য ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’ প্রদান স্বরূপ ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্র জনসংহতি সমিতির সাথে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। এবং এটিও স্মতর্ব্য যে, এই চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১০নং ধারাতে তাই সুস্পষ্ট করে লেখা হয়েছে যে, ‘চাকরী ও উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সমপর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত সরকার উপজাতীয়দের জন্য সরকারি চাকরী ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখিবেন।’
সুতরাং এই কোটা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের করুণা হিসেবে পাহাড়িরা ভোগ করছে না। বরং বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও এর সংবিধান এবং পাহাড়িদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্যদিয়ে পাহাড়িরা এই সুবিধা ভোগ করছে। অতএব এটি কারোর করুণা নয়, এটি নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের নায্য অধিকার। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যে সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর এবং শোষিত ও নিপীড়িত, সেটা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সংবিধান অন্তত সেকথাই স্বীকার করে এবং তার জন্যেই এই চুক্তি। সমাজের মধ্যে নারীরা পিছিয়ে থাকার কারণে নারীদের জন্যও চাকরী, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, যা সংবিধানেও উল্লেখ রয়েছে। নারীদের এই অধিকারও কারো করুণা বা অনুগ্রহের নয়, এটা তাদের মৌলিক অধিকার। কতটা অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসীবাদী ও প্রগতি বিরোধী হলে এভাবে মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে অনুগ্রহ ও করুণা হিসেবে আখ্যায়িত করে তা জিওসি বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি অনুসারে জনসংহতি সমিতির যা পালনীয় তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। অনেকের মতে চুক্তি অনুসারে জনসংহতি সমিতির যা কিছু পালনীয় তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করানোটা ছিল একধরনে ভুল। কেননা চুক্তি মোতাবেক করণীয় অনুসারে সকল অস্ত্র ও গোলাবারূদ জমা দেয়া এবং সকল সশস্ত্র সদস্য স্বাভাবিক ফিরে আসার পর সরকার তথা রাষ্ট্রীয় বাহিনী বেঈমানী করতে শুরু করেছে। অস্ত্র ও গোলাবারূপ জমা নেয়ার পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের সময়-সীমা নির্ধারণ করার বিধান থাকলেও সেনাবাহিনী তথা সরকার যেমনি তা পালন করেনি, তেমনি চুক্তির প্রতিশ্রুতি বরখেলাপ করার বেঈমানী শুরু করে।
জনসংহতি সমিতি যদি সকল অস্ত্র ও গোলাবারূদ জমা না দিত এবং সকল সশস্ত্র সদস্য স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন না করতো, তাহলে সেনাবাহিনী তথা সরকার বেঈমানী করতে গিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবতো। আজকে যদি চুক্তি অনুসারে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প ও সেনাশাসন প্রত্যাহারসহ চুক্তির প্রতিটি ধারা বাস্তবায়িত হতো, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হতো না। বস্তুত সেনাবাহিনী তথা সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে সশস্ত্র তৎপরতার দিকে ধাবিত করেছিল বলে নি:সন্দেহে বলা যায়। সেই অপকর্মকে ঢাকতে গিয়েই সেনাবাহিনী তথা সরকার কখনো জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে এধরনের প্রলাপ বকতে শুরু করে। জিওসির এহেন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য সত্যিই জুম্ম জনগণসহ দেশবাসীকে হতবাক না করে পারে না।
অপরদিকে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাহাড়ে আসলেই নানা সব উদ্ভট কথাবার্তা তথা প্রলাপ বকতে শুরু করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে তার ঘন ঘন সফর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে তার আগা-গোড়াহীন বক্তব্য, সত্যিই আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। পার্বত্য অঞ্চলে সফরে আসলেই তিনি কেবল সন্ত্রাসের কথা বলে চলেন এবং ক্যাম্প সম্প্রসারণ ও পরিত্যক্ত ক্যাম্পের জায়গাগুলোতে কখনও নতুন করে ক্যাম্প স্থাপন, কখনও পুলিশ, কখনও বা আধূনিক পুলিশ, আবার কখনও র্যাব মোতায়েনের কথা জানিয়ে দিয়ে যান। অবশেষে গত ২৬ মে এপিবিএন-এর সদর-দপ্তরও তিনি উদ্বোধন করে গেলেন। এটি নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির লঙ্ঘন। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে এবং প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এসব বক্তব্য বড়ই হাস্যকর আর অযৌক্তিক ঠেকে।
পার্বত্য চুক্তির ১৭ নং ধারাতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, (ক) সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর, বর্তমান বিজিবি) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দিঘীনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন। এবং (খ) সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।
কিন্তু অত্যান্ত দুঃখের বিষয় এই যে, চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ দুইযুগ পেরিয়ে গেলেও এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনামুক্ত করা হয় নি, এমনকি এর জন্যে কোন সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয় নি। ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ৭০টি এবং ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হলেও অধিকাংশ ক্যাম্পই আবার পুনর্বহাল করা হয়েছে। তার মধ্যে বিগত করোনা মহামারী সময়ে ২০টির অধিক অস্থায়ী সেনাক্যাম্প নতুন করে স্থাপন করা হয়েছ। এছাড়া এটিও স্মরণযোগ্য যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরই সেনাক্যাম্পের পরিত্যক্ত জায়গাসমূহে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের কথা বলেন। বাস্তবিকপক্ষে এটি সম্পূর্ণরূপে পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন।
পার্বত্য চুক্তির কোন ধারা-উপধারাতে উল্লেখ নাই যে, পরিত্যক্ত জায়গাসমূহে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। বরং চুক্তিতে উল্লেখ আছে যে, পরিত্যক্ত জায়গাগুলো প্রকৃত মালিকদের নিকট হস্তান্তর করা অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা। তাছাড়া এটিও স্মরণযোগ্য যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এপিবিএন, আধুনিক পুলিশ ইত্যাদির কথা হর-হামেশাই বলে চলেন। বাস্তবিকপক্ষে এতদসম্পর্কে পার্বত্য চুক্তিতেও কোথাও কোনো উল্লেখ নেই। বরং চুক্তিতে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা এবং পার্বত্য জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও তদনিম্ন
স্তরের সকল সদস্য পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক নিয়োগ করার কথা উল্লেখ আছে। তদনুসারে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য জেলার পুলিশ বাহিনী গঠন করাই হচ্ছে চুক্তি ও আইনসম্মত।
চুক্তির সেই ধারা অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায়ও পুলিশ বিষয়টি কার্যাদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা পালন করা হয়নি। অথচ চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সেই সিদ্ধান্তকে পদদলিত করে গত ১৩ এপ্রিল ২০২২ আর্মস পুলিশ ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়াটার থেকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৫ম বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের’ দোহাই দিয়ে “সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারকৃত ২৪০টি ক্যাম্পের পর্যায়ক্রমে পুলিশ মোতায়েন করা হবে। প্রাথমিকভাবে ৩০টি ক্যাম্প পুলিশ মোতায়েন করা হবে।” মর্মে এক আদেশ জারি করা হয়, যা ছিল পার্বত্য চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। বস্তুত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে বর্তমান সরকারের এটা হচ্ছে স্বৈরাচারী চুক্তি বিরোধী পদক্ষেপ।
সবশেষে, জিওসি সাইফুল আবেদীন সমগ্র পাহাড়িদেরকে যুদ্ধের আহবান দিয়ে দিলেন এবং ৩০ মিনিট সময় নির্ধারণও করে দিলেন। এমনকি তিনি এই বলেও সতর্কতা জারী করে দিলেন যে, এখনকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই ১৯৭৪ আর ৯০ দশকের সেনাবাহিনী নেই। অপরদিকে আইজিপি বেনজীর আহমেদ বলে দিলেন যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা আহম্মকের কাজ। বেনজীর আহমেদের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ছিল আহম্মকের কাজ! তাই অনেক ক্ষেত্রে বেনজীব আহমেদ ও জিওসি সাইফুল আবেদীনের মধ্যে পাকিস্তানী প্রেতাত্মা কাজ করছে বলে সন্দেহ হয়।
অপরদিকে জিওসি তার মত করে মুক্তিকে দুই ভাগে ভাগ করে দিলেন, প্রথমত চাহিদার মুক্তি, দ্বিতীয়ত ভয় থেকে মুক্তি। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি চায়। নিজেরাই নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার চায়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি, জাতীয় পরিচিতি ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়। রাজনৈতিক মুক্তি পেলে আমাদের চাহিদা কিংবা নিরাপত্তাহীনতা, কোনটারই আর অস্তিত্ব থাকবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্র সীমানার অভ্যন্তরে থেকে আমরা আমাদের মত করে থাকতে চাই এবং বাংলাদেশের অপরাপর ১৮ কোটি মানুষের সাথেই আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, আমরা পাহাড়ের মানুষ শান্তিপ্রিয়। শান্তি চাই বলেই আমরা আমাদের মত করে স্বাধীনভাবে, আলাদা স্বাতন্ত্র্যতা ও স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। এমনকি এটাও পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে, আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না, এই সত্যকে আমরা জানি এবং বুঝি। জিওসির বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, তারা এখনও আমাদেরকে আপন করে নিতে পারেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা, এই সত্যকে রাষ্ট্রযন্ত্র কাগজে-কলমে স্বীকার করলেও বোধবুদ্ধি ও অন্তর দিয়ে এখনও স্বীকার করতে নারাজ। বাস্তবিকপক্ষে পাহাড়ের সমস্যাকে সমাধান করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন সদিচ্ছাই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। যা অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র দেশের জন্য কখনই শুভ ফল বয়ে আনবে না। আমরা কখনই যুদ্ধের পক্ষে ছিলাম না, আমরা বরাবরই যুদ্ধের বিপক্ষে এবং শান্তির পক্ষে ছিলাম এবং এখনও আছি। কিন্তু রাষ্ট্র বরাবরই আমাদের উপর তথা সমগ্র পাহাড়িদের উপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে এসেছে এবং এখনও চাপিয়ে দিতে চাইছে। তদূপুরি পাহাড়িরা বরাবরই ধৈর্য্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি পাহাড়িদেরকে আবারও বাধ্য করে, তাহলে রাষ্ট্রকে এটাও স্মরণে রাখতে হবে যে, পাহাড়িরাও এখন আর সেই ১৯৭৩-এর পাহাড়ি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, আমরা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা কখনই বলিনি। বরং বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামের ভেতরে থেকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি।
ইতিহাসে যুদ্ধ দুইভাগে বিভক্ত। একটি ন্যায় যুদ্ধ, অপরটি অন্যায় যুদ্ধ। আমরা ন্যায় যুদ্ধের পক্ষে। বীর পার্বত্য চট্টলার এই পাহাড়িরাও সর্বদা ন্যায় যুদ্ধের পক্ষে এবং বিজয় আমাদেরই হবে।