হিল ভয়েস, ৩০ মে ২০২২, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও হেডম্যান-কার্বারীরা এক বিবৃতিতে মাটিরাঙ্গা-পানছড়ি-দীঘিনালা সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও পানছড়ির শনখোলা পাড়ায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
আজ ৩০ মে ২০২২ প্রদত্ত এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে ১৮৪ জন বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান ও কার্বারী এই দাবির কথা জানান।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা, লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয় কুমার চাকমা, পানছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা, লতিবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও হেডম্যান ভূমিধর রোয়াজা, চেঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা, সাবেক চেয়ারম্যান সমর বিকাশ চাকমা, চেঙ্গী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অনিল চন্দ্র চাকমা, সাবেক চেয়ারম্যান অসেতু বিকাশ চাকমা ও কালা চাঁদ চাকমা, ২৪৪ নং মৌজার হেডম্যান সুবধন রোয়াজা, বড় পানছড়ি মৌজার হেডম্যান চারু বিকাশ রোয়াজা, প্রস্তাবিত যুগলছড়ি মৌজার হেডম্যান ধনঞ্জয় রোয়াজা প্রমুখ।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা উন্নয়নের নামে বন ও পরিবেশ এবং জননিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর মাটিরাঙ্গা-পানছড়ি-দীঘিনালা সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও উক্ত সড়ক নির্মাণের জন্য পানছড়ির শনখোলা পাড়ায় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানাচ্ছি’।
বিবৃতিতে উক্ত সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও সেনা ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবির স্বপক্ষে নিম্নোক্ত যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়:
প্রথমত, এই সড়ক নির্মাণ করা হলে এলাকায় বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা ও আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যেদিকে পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, সেদিকের প্রাকৃতিক বন উজার হয়ে গেছে। অর্থাৎ পরিবেশগত দিক বিবেচনা না করে যত্রতত্র বনের ভেতর দিয়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ।
দ্বিতীয়ত, উপরোক্ত সীমান্ত সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এলাকায় তার কীরূপ পরিবেশগত প্রভাব পড়বে তার কোন গবেষণা বা জরিপ করা হয়নি। গত কয়েক দশকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে অনেক বন উজার হয়ে গেছে। বনের ভেতর দিয়ে শত শত কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হলে বর্তমানে যে বন অবশিষ্ট রয়েছে তাও চিরতরে হারিয়ে যাবে। সীমান্ত সড়ক কিংবা অন্যান্য সড়ক হলে যাতায়াতসহ কিছু সুবিধা অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু পরিবেশগত ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির তুলনায় তা কিছুই নয়।
তৃতীয়ত, সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে স্থানীয় জনগণের কোন মতামত ও সম্মতি নেওয়া হয়নি। অথচ আদিবাসী বিষয়ক বিভিন্ন দলিল মোতাবেক এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে স্থানীয় জনগণের পূর্ব সম্মতি নেওয়া সরকারের জন্য বাধ্যতামুলক। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা গত ১৯ মে ২০২২ পানছড়ি বিজিবি জোনে স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে ডেকে সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পরই কেবল জনপ্রতিনিধি ও জনগণ এ ব্যাপারে অবহিত হন। কাজেই স্থানীয় জনগণকে অন্ধকারে রেখে সরকার একতরফাভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
চতুর্থত, এই সড়ক অনেক পাহাড়ির জমি ও বাগান বাগিচার মধ্য দিয়ে যাবে। ফলে এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অথচ আইন মোতাবেক তাদের জমি অধিগ্রহণ কিংবা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়নি। জনগণের উন্নয়নের জন্য জনগণকে পাশ কাটিয়ে ও ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করে এবং কোন ধরনের আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়ে এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা আমাদের কাছে একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
পঞ্চমত, এই সীমান্ত সড়ক নির্মিত হলে বহিরাগত সেটলারদের আনাগোনা, ভূমি বেদখল, ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাবে। এক কথায় পাহাড়িদের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে।
ষষ্ঠত, সীমান্ত সড়ক হলে বিজিবি তথা নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ও রেইডের নামে পাহাড়িদের উপর নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী প্রায় সব সময় পাহাড়িদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, অপরদিকে বরং তারাই পাহাড়িদের নিরাপত্তা হরণ করে থাকে।
সপ্তমত, উক্ত সড়ক নির্মাণের কাজ পরিচালনার জন্য শনখোলা পাড়ায় চার পাহাড়ির জমি বেদখল করে একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে সেখানে বন ও পাহাড় ধ্বংস করে সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।