নিপন ত্রিপুরা
বর্তমান কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম বান্দরবানের বম সমাজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অন্যতম এক বম ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বিএনপি’র সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এমাজউদ্দীন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন মেয়াদের শেষ বছরে ১৯৯৬ সালে একবার বান্দরবন জেলা সফর করেন। সফরে তিনি ম্রো, চাক, খুমী, বম আদিবাসীদের সাথে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময় সভাতে এমাজউদ্দিন চাকমা জাতির বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। তিনি এও ওয়াদা করে আসেন যে, খিয়াং, লুসাই, ম্রো, বম জাতিগোষ্ঠী থেকে যে সকল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফর্ম তুলতে পারবে তাদের সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন।
এমাজউদ্দিনের দেয়া ওয়াদাটির বিষয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) নেতৃবৃন্দ অবগত ছিলেন। ঠিক সে বছরই নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আবেদন করতে পারলেও ভর্তি পরিক্ষায় পাশ করতে পারেননি। পিসিপি’র নেতৃবৃন্দ নাথান বমের বিষয়টি তুলে ধরে ভিসি এমাজউদ্দীনকে তাঁর দেয়া ওয়াদা পুরণ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন এবং ভিসি এমাজউদ্দীন নাথান বমকে চারুকলা অনুষদে ভর্তি করার সুপারিশ করেন। পিসিপি’র নেতৃবৃন্দদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নাথান বম পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটি’র একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কোয়ারের পাশে মহান নেতা এম এন লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম শিল্পী/কারিগর ছিলেন তিনি নিজেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাজনীতির অধ্যায় শেষ করে শাসকগোষ্ঠীর খপ্পরে পরে ২০০৮ সালে বম, লুসাই, পাংখোয়া, খিয়াং, খুমী, ম্রো প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর তথাকথিত অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কুকি-চীন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন গঠন করেন। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি ও ভাঙচুনলিয়ান বম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
নাথান বম কর্তৃক কুকি-চীন ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন গঠনের পর তার সাথে একাধিকবার পার্টির তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয় এবং আলোচনার চেষ্টা করা হয়। কেবল পাংখোয়া, খুমী, খিয়াং, ম্রো, লুসাই জাতিসত্তার অধিকারের জন্য আলাদা সংগঠন গঠন না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য তাকে আহবান জানানো হয়। তিনি কেবল জৌ জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলে জাতিগত বিভাজনের অভিযোগ বারে বারে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন তিনি এসব কাজে নাই।
অবশেষে রাষ্ট্রীয় বিশেষ বাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠীর মদদে সেই নাথান বম ২০১৬ সালে রুমা থেকে প্রায় ৩০ জনের বম যুবককে বম জাতির জন্য আলাদা রাজ্য গঠনের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে মিয়ানমারের চিন স্টেটে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ১০-১২ জনের বম যুবক বাড়িতে ফেরত আসেন। বাকিরা নাথান বমের সাথে থেকে যায়।
অতি সম্প্রতি এই সংগঠনের নাম বদল করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং উক্ত সংগঠনের সশস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। পাংখোয়া, খুমী, খিয়াং, ম্রো, বম ও লুসাই জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্দ করার জন্য প্রচার করা হয় যে, তাদের লক্ষ্য শাসকগোষ্ঠীর তাঁবেদার হয়ে তিন পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রুমা, আলিকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা- এই ৯টি উপজেলা নিয়ে কুকি-চিন রাজ্য গঠন করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কার্যকলাপে বুঝা যাচ্ছে, তাদের আসল লক্ষ্য শাসকগোষ্ঠীর তাঁবেদারি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র কার্যক্রম ও চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করা, এবং শাসকগোষ্ঠীর ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির এজেন্ডা বাস্তবায়নে জাতিগত বিভাজন তৈরি করা।
উল্লেখ্য যে, পাংখোয়া, খুমী, খিয়াং, ম্রো, বম ও লুসাই আদিবাসী জাতিসত্তার অধিকারের কথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে লিপিবদ্ধ আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অধিকার নিশ্চিত করার পথ উন্মুক্ত হবে। সর্বোপরি, জনসংহতি সমিতি জন্মলগ্ন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাসকারী শোষিত-বঞ্চিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষাসহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে আন্দোলন করে আসছে। তার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরোধী আলাদা কোন সংগঠনের প্রয়োজন ও বাস্তবতা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, ম্রো, পাংখোয়া, খুমী, বম, লুসাই, খিয়াং প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বুঝদার ও সচেতন লোকেরা কখনো শাসকগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুক্ত হবে না।
মারমা জাতির নাম ভাঙিয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্ররোচনায় যেভাবে ও যে উদ্দেশ্যে দালাল গোষ্ঠী তথাকথিত মগ পার্টির সৃষ্টি, ঠিক তেমনি করে সৃষ্টি করা হয় তথাকথিত আলাদা রাজ্য গঠনের নাম করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। নব্য সৃষ্ট কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর সদস্যদের সাথে ইসলামী জঙ্গী সংগঠন ‘জামায়াতে আরাকান’ নামে একটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে যোগসূত্র রয়েছে। জামায়াতে আরাকান ও কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সংগঠনকে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলো ঢাকার এক বম ছেলের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করা হয়ে থাকে এমন অভিযোগ রয়েছে।
শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র থেকে সৃষ্ট কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কখনোই অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত হতে পারবে না। কারণ রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও কায়েমি স্বার্থবাদী মহল এই সংগঠনগুলো সৃষ্টিই করেছে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষ্য নিয়ে। এই সংগঠনও মগ পার্টির ন্যায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুটপাট ও চাঁদবাজি করে নিজের পকেট ভারি করবে আর এলাকায় সন্ত্রাসেরই প্রসার ঘটাবে। তাই শাসকগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সৃষ্ট দালাল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও তথাকথিত মগ পার্টিকে বর্জন করুন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হউন।