হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদকঃ আজ লোমহর্ষক লোগাং গণহত্যার ৩০ বছর পূর্ণ হলো। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্মদের উপর সংঘটিত অন্যতম জাতিগত বর্বরতার নিদর্শন। এটা কেবল গণহত্যা নয়, ঐদিন সেখানে জুম্মর শত শত বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়। ১৯৯২ সালের এই দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার লোগাং জুম্ম গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত হয় এই পাশবিক গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অন্যতম বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর (বর্তমানে ‘বিজিবি’) ও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মুসলিম বাঙালি সেটেলারদের যৌথ ষড়যন্ত্র ও অংশগ্রহণে সংঘটিত হয় এই গণহত্যা। গণহত্যায় নারী-শিশুসহ ২ শতাধিক জুম্ম গ্রামবাসী নিহত হয় এবং ৫ শতাধিক বাড়িঘর অগ্নিসংযোগের ফলে ভস্মীভূত হয় বলে গ্রামবাসীর সূত্রে জানা যায়। তবে সরকার পক্ষ ১২ জন জুম্ম নিহত, ১৩ জন জুম্ম আহত হয় এবং ২ জন নিখোঁজ হয় বলে স্বীকার করে। অপরদিকে, জুম্মদের ৫৫০টি বাড়ি ভস্মীভূত হয় বলে স্বীকার করে।
ঘটনার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে পরে সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করলেও কমিটির সেই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সরকার কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। ঘটনার কোনো বিচার হয়নি, দোষীদের শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্লেখ্য, ঘটনার সময় দেশে ছিল খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি’র শাসনামল। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের কার্যত শাসনকর্তা ছিল সামরিক বাহিনীই।
১৯৯৩ সালের ২১ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান কর্তৃক তৈরী করা এক রিপোর্টের সূত্রে জানা যায়, সামরিক বাহিনী আশেপাশের জুম্ম গ্রামগুলি থেকে প্রায় ১৫০০ জুম্ম পরিবারকে জোরপূর্বকভাবে লোগাং গুচ্ছ গ্রামে স্থানান্তর করে, যা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছাড়া কিছু নয়। অপরদিকে সামরিক বাহিনী জুম্মদের পূর্বপুরুষদের গ্রাম ও জমিজমাসমূহ বিনা পয়সায় অনুপ্রবেশকারী বাঙালি সেটেলারদের নিকট বন্টন করে দেয়। এই সময় সামরিক বাহিনী কর্তৃপক্ষ ওই জুম্মদের সেখান থেকে তাড়াতে একটি ষড়যন্ত্র করে। ১০ এপ্রিল ১৯৯২ সামরিক বাহিনীর কর্তৃপক্ষ দাও ও ছুরি নিয়ে দুই বাঙালি সেটেলারকে কয়েকজন জুম্ম নারীকে ধর্ষণের জন্য পাঠায়, যে জুম্ম নারীরা গুচ্ছগ্রামে গরু চড়াচ্ছিল। ওই বাঙালিরা ধর্ষণের চেষ্টা করলে জুম্ম নারীরা নিজেদের রক্ষার জন্য চিৎকার করা শুরু করে। তখন এক জুম্ম গ্রামবাসী সেখানে আসে এবং বাঙালি সেটেলারদের জুম্ম নারীদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু বাঙালি সেটেলাররা চলে যাওয়ার পরিবর্তে ওই জুম্ম গ্রামবাসীকে আক্রমণ করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ধস্তাধস্তিতে এক বাঙালি সেটেলারও সামান্য আহত হয়।
ওই জুম্ম গ্রামবাসীকে হত্যার পর বাঙালি সেটেলাররা সোজা পার্শ্ববর্তী বিডিআর ক্যাম্পে চলে যায়। এসময় বিডিআর কর্তৃপক্ষ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না করে তারা বরং ধর্ষণের চেষ্টাকারী জনৈক বাঙলি সেটেলার আহত হওয়ার ঘটনাকে ষড়যন্ত্রের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। তারা শান্তিবাহিনীর হামলায় ওই বাঙালি সেটেলার আহত হয়েছে বলে প্রচার শুরু করে। এরপরপরই শান্তিবাহিনী খুঁজে বের করার অজুহাতে সামরিক বাহিনী ও বাঙালি সেটেলাররা যৌথভাবে জুম্মদের লোগাং গুচ্ছগ্রামে হামলা চালায়। এসময় সশস্ত্র বিডিআর সদস্যরা গুলি করে এবং বাঙালি সেটেলাররা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জুম্মদের হত্যা করে এবং অনেককে আহত করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হামলাকারীরা অনেক জুম্ম নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বাধ্য করে এবং বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তাদের পুড়িয়ে মারে। লোগাং গুচ্ছ গ্রাম এবং আশেপাশের অনেক জুম্ম পরিবার তখন পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
বরাবরের মতো সামরিক বাহিনীর কর্তৃপক্ষ লোগাং গণহত্যার ঘটনাটি যথাসম্ভব ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। তারা পূর্বপরিকল্পিত এই গণহত্যা চালানোর পর অচিরেই পুরো লোগাং গুচ্ছগ্রামকে ঘিরে ফেলে। এমনকি খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টের কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমীরণ দেওয়ানকে ঘটনার দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বাধা প্রদান করে।
ঘটনাক্রমে ঐ সময় জুম্মদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুতে যোগদানের উদ্দেশ্যে মানবাধিকার কর্মী, সংসদ সদস্য, আইনজীবী, সাংবাদিক, প্রফেসর, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ও পশ্চিমা মানবাধিকারকর্মী রোজালিন কোস্টাসহ ২৩ জনের একটি দল ঘটনাস্থল লোগাঙের নিকটবর্তী খাগড়াছড়ি সদরে অবস্থান করছিলেন। সেনা কর্তৃপক্ষ ওই ভ্রমণকারী দলকেও ঘটনাস্থলে যেতে অনুমতি দেয়নি। তবে তারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও সামরিক কর্তৃপক্ষের অনেকের কাছ থেকে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
ড. আর এস দেওয়ানের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, উক্ত ভ্রমণকারী দলের প্রতিবেদন অনুসারে সামরিক বাহিনীর ট্রাকের চালকরা মৃতদেহ ও আহতদের একটি গোপন স্থানে নিয়ে যান এবং সেগুলোকে একসঙ্গে পোড়ান। ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বৈশিষ্ট্য মুনি চাকমা তার স্ত্রীর লাশের দাবি জানাতে ১১ এপ্রিল ১৯৯২ লোগাং গুচ্ছগ্রামে ফিরে আসেন এবং তিনি তার ভস্মীভূত বাড়ির চতুর্দিকে ৩৯টি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। কিন্তু অন্তোষ্টিক্রিয়ার জন্য তার স্ত্রীর মৃতদেহ সরিয়ে নিতে তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। ১১ এপ্রিল ১৯৯২ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমীরণ দেওয়ান লোগাং গ্রামের একটি ক্ষুদ্র অংশ পরিদর্শন করতে সক্ষম হন এবং তিনি ১৩৯টি মৃতদেহ গণনা করেন। এরপর গ্রামের বাকী অংশে পরিদর্শন করতে তাকে বাধা দেওয়া হয়।
ঐ সময় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২৩ ভ্রমণকারী দলটি ১৯ এপ্রিল ১৯৯২ একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ৪ শতাধিক বাড়ি ভস্মীভূত হয় এবং ২ শতাধিক শিশু, নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। তৎসময়ে তাদের এই বিবৃতি লোগাং গণহত্যা সম্পর্কে জানতে বিশ্ব সমাজকে সাহায্য করে। ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার লোগাং গণহত্যার বিষয়টি গোপন করতে সক্ষম হয়নি।
জানা গেছে, ঐ গণহত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দেয় বিডিআরের ২৪তম ব্যাটালিয়নের সুবেদার হাবিবুর রহমান, নায়েক সুবেদার সারোয়ার হোসেন, স্থানীয় ভিডিপি কম্যান্ডার কেরামত আলী, ভিডিপি প্লাটুন কম্যান্ডার সিদ্দিকুর রহমান, আনসার সদস্য মোহাম্মদ নূর মিয়া, আনসার সদস্য হাবিলদার জলিল, আনসার সদস্য লোকমান, লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সিরাজুল ইসলাম, লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কাজী হানিফ, লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাবিব উল্লাহ, মুসলিম সেটেলার মোহাম্মদ মকবুল মিয়া, মুসলিম সেটেলার মোঃ ইদ্রিস মিয়া, মুসলিম সেটেলার সুলতান কাজী, মুসলিম সেটেলার মোহাম্মদ ইলিয়াস, মুসলিম সেটেলার জল্যা মিয়া, মুসলিম সেটেলার মোহাম্মদ জামাল খান, মুসলিম সেটেলার মোহাম্মদ জামসেদ ভূঁইয়া।
বলাবাহুল্য, বিগত ৩০ বছরেও কোনো সরকার অন্যান্য গণহত্যার ন্যায় এই গণহত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুবিচারের উদ্যোগ নেয়নি। এইসব গণহত্যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার সাথেই তুলনীয়। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ঐ গণহত্যায় সহযোগিতাকারী রাজাকারদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করলেও এই সরকারও জুম্মদের উপর সংঘটিত এইসব পাশবিক গণহত্যার বিচারের লক্ষে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
বলাবাহুল্য, এইসব মানবতাবিরোধী গণহত্যার বিচারের দায় কোনো সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না এবং পারবে না। এটা অবশ্যই সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক ও কলঙ্কজনক যে, সরকার ও রাষ্ট্র এখনও এর সুবিচার নিশ্চিত করতে পারেনি।