হিল ভয়েস, ২৭ এপ্রিল ২০২২, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে আদিবাসী জুম্মদের জুমভূমি ও বাগানভূমি দখলে নিতে বহিরাগত রাবার কোম্পানির ভূমিদস্যুরা অবশেষে পাহাড়ে আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও বিভিন্ন ব্যক্তি ভূমিদস্যুদের কর্তৃক পাহাড়ে আগুন দেয়ার লাইভ ভিডিও ও স্থিরচিত্র শেয়ার করতে দেখা গেছে।
এই অবস্থায় ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত স্থানীয় তিন আদিবাসী গ্রামের ৩৯টি পরিবার এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের এক রাবার কোম্পানির মালিক ও উপ-পরিচালক ভূমিদস্যু মোঃ কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে বহিরাগত শ্রমিকরা ইতোমধ্যে কয়েক দফায় ওই আদিবাসীদের প্রায় ২৫০-৩০০ একর পরিমাণ জুমভূমির জঙ্গল ও বিভিন্ন প্রজাতির বনজ ও ফলদ গাছ কেটে দেয়। অবশেষে গতকাল ২৬ এপ্রিল ২০২২ সকালের দিকে ভূমিদস্যু মোঃ কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ৬০-৭০ জনের একদল বহিরাগত শ্রমিক আদিবাসীদের ওই পাহাড় এলাকায় আগুন দিয়েছে।
স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, গতকালও সকালে প্রথমে ভূমিদস্যু মোঃ কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে বহিরাগত শ্রমিকরা দা ও লাঠিসোটা নিয়ে ঐ এলাকায় আসে এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে দেয়। এক পর্যায়ে তারা সেগুলোতে এবং অন্যান্য এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আদিবাসীদের ওই ভূমি বেদখল সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই এই অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে অভিযোগ করেন আদিবাসীরা।
উক্ত ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মেনসিং ম্রো ও মেনরাও ম্রোসহ অনেকে অভিযোগ করেন, ভূমি বেদখলকারী লোকজন তাদের ভয়ভীতি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এ কাজ করছে। অথচ উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আদিবাসীদেরকে ১৫০ একর জায়গা ছেড়ে দেবে রাবার কোম্পানি। কিন্তু সেসব স্থান থেকে কাঠ, বাঁশ, লাকড়ি সংগ্রহ করতেও বাধা দিচ্ছে রাবার কোম্পানির লোকজন। সব গাছ ও জঙ্গল কেটে আজ মঙ্গলবার আগুন লাগিয়ে পুড়ে দিচ্ছে। জঙ্গল কাটার সময় রোহিঙ্গা শ্রমিকসহ লাঠিয়াল বাহিনী পাহারা দিয়ে থাকার পাশাপাশি মদ জুয়ার আড্ডা বসায় সেখানে।
তারা আরো জানান, কোম্পানি কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসীদের ভূমি জবরদখলের কারণে এখন আদিবাসীদের আছে শুধুমাত্র পাড়ার জায়গাগুলো। আদিবাসীরা পাড়ার বাইরে গরু-ছাগল চড়াতে গেলে কোম্পানির লোকজন বাধা দেয়। তারা প্রশ্ন করেন, জুমচাষ করতে না পারলে, চলাচল করতে না পারলে, গরু-ছাগল পালতে না পারলে খাব কী? নিরুপায় হয়ে কি পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে ?
স্থানীয় আরেক গ্রামবাসী অনারাম ত্রিপুরা বলেন, ৪৫ বছর ধরে ৩০৩নং ডলুছড়ি মৌজাস্থ নিজেদের জায়গায় জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। সেখানে ফলের বাগান চাষ করে আসছি। অথচ এত বছর পরে কোম্পানি এসে বলছে, এসব জায়গা তাদের।
তিনি আরও বলেন, জুমচাষ ছাড়া আমাদের চলার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। যে কোন মুহূর্তে কোম্পানির লোকজন আমাদের উপর হামলা করতে পারে। দখলকৃত জায়গা-জমির মধ্যে রোপিত বাঁশ-গাছ কাটা ও চাষাবাদের কাজে কোম্পানির লোকজন বাধা দিচ্ছেন।
লাংকম পাড়ার কার্বারি লাংকম ম্রো বলেন, যুগ যুগ ধরে পাড়াগুলোর আশপাশের জায়গাতে জুমচাষ করে আসছেন আমাদের পরিবারগুলো। এখন লামা রাবার কোম্পানি সেই জায়গাগুলো দখল করার চেষ্টা করছে। গত বছরও তারা ১০০ একরের মত দখল করেছে। এ বছরও প্রায় দখলের উদ্দেশ্যে ২৫০ থেকে ৩০০ একর জায়গার জঙ্গল ও গাছ কেটে পরিস্কার করেছে।
উল্লেখ্য যে, সরই ইউনিয়নে রাবার কোম্পানির নামে বহিরাগত মুসলিম বাঙালি ভূমিদস্যুদের কর্তৃক আদিবাসী জুম্মদের তিনটি গ্রামের প্রায় ৪০০ একর পরিমাণ ভূমি ও বাগান বেদখলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ৯ এপ্রিল ২০২২ সকাল ৯:০০ টার দিকে শতাধিক বহিরাগত বাঙালি লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঐ এলাকায় এসে জুম্মদের লাগানো শত শত গাছ কেটে দেয় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে। আদিবাসীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদেরকে হামলার চেষ্টা করে, মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং একজন আদিবাসী জুম্মকে মারতে পারলে তারা দশ লাখ টাকা পাবে বলেও উল্লেখ করে।
জানা গেছে, ঐ দিন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এর উপ-পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন জুম্মদের ভূমি দখলের জন্য নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি ও কক্সবাজার এলাকা থেকে ১০০ জনের অধিক সশস্ত্র রোহিঙ্গা ও বাঙালি মুসলিম নিয়ে আসেন। স্থানীয় জুম্মরা বাধা দেয়া সত্তেও ওই বহিরাগত ভূমিদস্যুরা জুম্মদের গাছ কেটে দেয় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে। জানা গেছে, এই ভূমি বেদখলের চেষ্টায় নেতৃত্ব দেয় লিডার নুরু নামের এক সন্ত্রাসী ও মস্তান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সরই ইউনিয়নের দুলুছড়ি মৌজার ৪নং ওয়ার্ডের লাংখুম ম্রো কার্বারি পাড়া, রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়ায় ৩৯ পরিবারের প্রায় ২০০ নারী-পুরুষ বসবাস করে আসছেন। তাদের গ্রামের প্রায় ৪০০ একর ভূমিতে তারা বংশপরম্পরায় জুমচাষ ও বাগান-বাগিচা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানী রাবার প্লটের নামে জুম্মদের ঐসব ভূমি দখলে নেয়ার অপচেষ্টা শুরু করে। এসময় গ্রামবাসীরা বাঁধা দিলে, কোম্পানির লোকেরা জুম্মদের মামলা, হামলা, খুন ও পুলিশের ভয় দেখায়। তখন থেকে কোম্পানির লোকেরা একাধিকবার শ্রমিক এনে জুম্মদের ঐ ভূমি বেদখলের চেষ্টা করে।
সরই মৌজা হেডম্যান দূর্যধন ত্রিপুরা ও মৌজা হেডম্যানের সাবেক মুহুরী হাজিরাম ত্রিপুরার মদদে রাবার কোম্পানি এসব জায়গা জবর দখলের সাহস পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন গ্রামবাসী। তবে অভিযুক্ত দূর্যধন ত্রিপুরা বলেন, আমি একজন হেডম্যান হয়ে কোম্পানিকে মদদ দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এ বিষয়ে ডলুছড়ি মৌজা হেডম্যান যোহন ত্রিপুরা জানান, লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজের লোকজন যে জায়গাগুলো পরিষ্কার করছে, মূলত সে জায়গাগুলো লাংকম কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া ও রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়াবাসীর। তারা বংশ পরম্পরায় ওই জায়গায় জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। মাঝখানে যখন আমার হেডম্যানশিপ ছিল না, তখন এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানি ওইসব জায়গা জবরদখল শুরু করেন।