হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২২, রাঙ্গামাটি: আজ রাঙ্গামাটি জেলা শহরের পৌরসভা প্রাঙ্গণে আদিবাসী জুম্মদের আসন্ন সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রান ২০২২ এর তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, আমাদের জুম্ম সমাজের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সংরক্ষণ ও বিকাশ করতে চাইলে আমাদের অধিকারের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের অধিকারকে সমুন্নত রেখেই আমাদের জীবনধারাকে উজ্জীবিত করতে হবে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে।
আজ সকাল ৯:০০ টার দিকে ‘জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ, বিকাশ এবং অধিকার নিশ্চিতকরণে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসুন’ এই প্রতিপাদ্যকে নিয়ে ‘বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রান ২০২২ উদযাপন কমিটি’র উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সন্তু লারমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামেরও সভাপতি।
উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমার (অবঃউপসচিব) সভাপতিত্বে ও বিজ্ঞান্তর তালুকদারের সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী, জেলা পরিষদ সদস্য ঝর্ণা খীসা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পঞ্চানন ভট্টাচার্য, সিএইচটি হেডম্যান এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা প্রমুখ।
উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি সন্তু লারমা বলেন, আজকে এখানে জুম্ম সমাজের সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশের কথা বলা হয়েছে। আমরা অবশ্যই আমাদের সংস্কৃতি ও জীবধারাকে সংরক্ষিত করতে চাইবো এবং বিকশিত করতে চাইবো। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে চাই এবং তার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে চাই তাহলে আমাদের অধিকারের প্রয়োজন রয়েছে। আজকে তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মরা কি তাদের সংস্কৃতি ও অধিকার নিয়ে টিকে থাকতে পারছে সেই প্রশ্নটি সর্বাগ্রে সামনে এসে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, আমাদের জুম্ম সংস্কৃতি ও জীবনধারা যদি সংরক্ষণ ও বিকশিত করতে চাই তাহলে আমাদের অধিকার নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের অধিকারকে সমুন্নত রেখেই আমাদের জীবনধারাকে উজ্জীবিত করতে হবে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে।
সন্তু লারমা আরও বলেন, জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি ও জীবনধারা আজ নানা কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেখানে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ, অর্থনৈতিক কারণ, সামাজিক কারণ, সাংস্কৃতিক কারণ এবং রয়েছে জাতিগত, লিঙ্গগত, শ্রেণিগত নানা কারণ। তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে আমাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে কিনা তা আমাদের নিরীক্ষণ করা উচিত।
তিনি বলেন, এখানে আদিবাসীদের ভাষা হারিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দেখা যায় নিজের মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট মনোযোগী নয়। তবে ভাষা টিকিয়ে রাখতে গেলে অধিকারের প্রয়োজন হয়। কোনো জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের যদি স্বীকৃতি না থাকে তাহলে অন্যান্য বৃহত্তর জাতির ভাষার প্রবল চাপ তার মাতৃভাষাকে হারিয়ে ফেলতে তাকে বাধ্য করবে। সমাজে নানা বৈষম্যের কারণে এপর্যন্ত অনেক জাতি ও ভাষা হারিয়ে গেছে এবং এখনও হারিয়ে যাওয়ার পথে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে এখানে বৈষম্যযুক্ত সমাজব্যবস্থা বিরাজমান রয়েছে।
বিশেষ অতিথি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমিও পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন চাই। মাননীয় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা, তিনিও প্রতিনিয়ত দাবি করে আসছেন শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হোক। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, তিনিও চান শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন হোক, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন হোক। আমাদের মাননীয় পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর, তিনিও চান এবং আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার এমপি, তিনিও চান শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হোক।
তিনি বলেন, শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন সরকারের পক্ষে একজন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগণের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন আজকের প্রধান অতিথি ও আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান। তাহলে দুই পক্ষই চান শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হোক। এবং আমি মনেকরি দুই পক্ষই আন্তরিক। তাই আমি মনেকরি, আজকে আমাদের প্রত্যাশা হোক, সকলে এক সাথে আলোচনার মাধ্যমে কোথায় বাধা আছে তা বের করে যেন এই চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সকাল ১১:৩০ টার দিকে রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালিটি শহরের প্রধান সড়ক ধরে রাজবাড়িস্থ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসে সমাপ্ত হয়। র্যালিতে অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষ, শিশু, ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশই স্ব স্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে আসেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে- ১০ এপ্রিল ২০২২, ভাষা প্রতিযোগিতা (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা) ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিকাল ৩:০০ টায়, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ, সন্ধ্যা ৬:০০ টায়, রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমিতে; ১১ এপ্রিল ২০২২, আদিবাসী জুম্ম খেলাধুলা, সকাল ১০:০০ টায়, বলী খেলা, বিকাল ৩:০০ টায়, কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সন্ধ্যা ৬:০০ টায়, স্থান-রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়াম; ১২ এপ্রিল ২০২২, ফুল ভাসানো অনুষ্ঠান, সকাল ৬:৩০ টায়, স্থান-রাজবনবিহার পূর্বঘাট এবং গরিয়া নৃত্য পরিবেশনা, সকাল ১০:০০ টায় (বিশিষ্ট জনের বাড়িতে)।