হিল ভয়েস, ৩০ এপ্রিল ২০২২, আন্তর্জাতিক ডেস্ক:পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি মিজ অগাস্টিনা চাকমা গতকাল শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২১তম অধিবেশনে বলেন, আদিবাসী জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রানাধিকার নিশ্চিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা জরুরি।
মিজ অগাস্টিনা চাকমা এজেন্ডা আইটেম-৪: “আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র, আদিবাসী বিষয়ক বিশ্ব সম্মলনের আউটকাম ডকুমেন্ট এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর প্রেক্ষিতে স্থায়ী ফোরামের ছয়টি এখতিয়ার ক্ষেত্র (অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকার)”-এর উপর আলোচনা করতে গিয়ে এই দাবি উত্থাপন করেন।
“আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছাড়া আদিবাসীদের টেকসই উন্নয়ন অর্জিত হতে পারে না এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয় মর্মে মতামত তুলে ধরে অগাষ্টিনা চাকমা তার বক্তব্য শুরু করেন।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, জেলা পর্যায়ে তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সংস্থা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য।
কিন্তু পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকারের গড়িমসির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো এ ধরনের স্বশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। গত ২৫ বছরে এসব পরিষদকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
গত ২৫ বছরেও এসব পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনের লক্ষ্যে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের নির্বাচন বিধি ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলস্বরূপ এই পরিষদগুলি এখন পর্যন্ত অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকার অনুপস্থিতির কারণে আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব এবং তাদের জন্মভূমির অস্তিত্ব, তাদের সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকা, মানবাধিকার এবং এ অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে।
বর্তমান সরকারও আগের স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক পন্থা অনুসরণ করে চলছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সামরিক শাসন-এর অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণরূপে সেনাবাহিনীর কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে । ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। আদিবাসী জুম্ম জনগণ এখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে নিয়োজিত জনসংহতি সমিতি কর্মী ও সমর্থকদের ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’ এবং ‘সশস্ত্র দুর্বৃত্ত’ ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী ব্যাপক প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে।
পরিশেষে আদিবাসী জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার নিশ্চিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সামরিক শাসন ‘অপারেশন উত্তোরন’ সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং পার্বত্য পরিষদগুলোর হাতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী ন্যস্ত করার জন্য যথাযথ ভূমিকা পালন করতে এবং ২০১১ সালে গৃহীত পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত স্থায়ী ফোরামের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নিতে মিজ চাকমা স্থায়ী ফোরামকে আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২১তম অধিবেশন এখন ২৫ এপ্রিল থেকে ৬ মে ২০২২ পর্যন্ত নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদর দফতরে ব্যক্তিগত উপস্থিতি (ইন-পার্সন) এবং অনলাইনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অধিবেশনের প্রতিপ্রাদ্য বিষয়- ‘আদিবাসী জনগণ, ব্যবসা, স্বায়ত্তশাসন এবং মুক্ত ও পূর্বাবহিত সম্মতিসহ মানবাধিকারের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের নীতি’, এবং আদিবাসী ভাষার আন্তর্জাতিক দশক ২০২২-২০৩২ শুরুর সাথে স্থায়ী ফোরামের ২১তম অধিবেশন চলছে।
বাংলাদেশ থেকে, জনসংহতি সমিতির প্রীতিবিন্দু চাকমা এবং বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের চঞ্চনা চাকমা, যথাক্রমে অনলাইন এবং ব্যক্তিগত উপস্থিতির মাধ্যমে স্থায়ী ফোরামের এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন।