হিল ভয়েস, ২৩ এপ্রিল ২০২২, ঢাকা: আজ ২৩ এপ্রিল ২০২২ ইং তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি নসরুল হামিদ মিলনায়তনে নাগরিক প্রতিনিধি দলের সাদামাটি পরিদর্শনোত্তর এক মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময়ে সরেজমিন পরিদর্শন দলের বক্তব্য উপস্থাপন করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে বিস্তারিত আলোচনা করেন সংস্কৃতিকর্মী ও আদিবাসী নেতা মতিলাল হাজং, আইনজীবী ও সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস, লেখক ও সাংবাদিক নজরুল কবির, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমীলা প্রমুখ। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন।
মতবিনিময় সভায় মতিলাল হাজং বলেন, দূর্গাপুরে সাদামাটির উত্তোলনের ফলে অনেক আদিবাসী গারো, হাজং ও হাদি জনগোষ্ঠীর লোকজন উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। আদিবাসীদের জমির কাগজপত্র নাই এই হইল দোষ, টিলায় থাকে কিন্তু কাগজপত্র নাই।
তিনি আরো বলেন অনেক কোম্পানী আছে যারা ৫০০ টনের অনুমতি নিয়ে ৫০০০ টন উত্তোলন করে যা কেউ তদারকি করেনা। আমি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাতে আমাকে নানানভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়েছে। তারপর ও আমি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় প্রতিবাদ ও মানবন্ধন করে গেছি।
আদিবাসী নেতা নু-মং বলেন, যারা পরিদর্শনে গেছেন তাদের জানানো ন্যায্য দাবি সরকারের আমলে নেয়া উচিত, নীতি নির্ধারকদের কাজ করা উচিত অবৈধভাবে সাদামাটির পাহাড় খননের বিরুদ্ধে।
সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস বলেন আমি জানতাম সাদামাটি উত্তোলনের প্রভাব সম্পর্কে, প্রতিনিধিদলের সাথে গিয়ে তা প্রত্যক্ষ করে আসলাম, আগে দেখেছি সোমেশ্বরীর পানি পরিষ্কার ছিলো, কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম তা ঘোলা হয়ে গেছে, এমনভাবে সেখানে বালু উত্তোলন হয় মনে হয় নদীর বুক-পিঠ-মাংস খুবলে খুবলে খেয়ে নিচ্ছে যেনো। এ কারনে কিন্তু পাড় ধসে পড়ছে। এরকম চলতে থাকলে আগামীতে নদীর তীরে যাদের বিশেষত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনের বাড়িঘর নাই হয়ে যাবে।
জাকির হোসেন বলেন, আমরা দেখছি যে দূর্গাপুরের যে সৌন্দর্য ছিলো তা আজ আর নেই। সাদামাটির পাহাড় আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদ হলেও স্থানীয়দের জীবন জীবিকা বসবাস ইত্যাদি গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আগামীতে দূর্গাপুরের অবৈধ বালু উত্তোলনের ব্যাপারেও কথা বলবো।
তিনি আরো বলেন একটা কমিটি করতে হবে যারা বালু উত্তোলন কিংবা সাদামাটির পাহাড় খননের কাজের মনিটরিং করবেন সে কমিটিতে স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের রাখতে হবে যাতে ভারসাম্য থাকবে যাতে করে কেউ আলাদা করে দুর্নীতি করতে না পারে। বর্তমান সময়ে সবখানেই নগদ লাভের আশায় কার্যক্রম চালানো হচ্ছে যেটা সমস্যাজনক।
উল্লেখ্য যে, গত ৮-১০ এপ্রিল ২০২২, ১০ সদস্যের এক নাগরিক প্রতিনিধি নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুরে ও ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়ায় কয়েকটি সাদামাটি আহরণস্থল পরিদর্শন এবং স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশে এর প্রভাব অবলোকন করেন। উক্ত দুটি উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়ে স্থানীয় হাজং, মান্দি ও বাঙালি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পাশাপাশি দূর্গাপুর প্রেসক্লাবে স্থানীয় সংবাদ কর্মীদের সাথে মতবনিমিয় এবং নেত্রকোণা জেলা প্রশাসকের সাথেও সাক্ষাৎ করেন । নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, আইনজীবী ও সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, সাংবাদিক নজরুল কবীর, সাংবাদিক ও গল্পকার রাজীব নূর, অনুবাদক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীব, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী অনামিকা আহমেদ ও নাগরিক উদ্যোগের প্রতিনিধি ফারহান হোসেন জয়।
প্রতিনিধি দলের দাবিসমূহ:
- পরিবেশগত সুরক্ষার প্রশ্ন বিবেচনায় নানিয়ে অপরিকল্পিত ও ধ্বংসাত্মক উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের যে আয়োজন তা বন্ধ করতে হবে। দূর্গাপুরের তিনটি মৌজায় বন্ধ হলেও পার্শ্ববর্তী ধোবাউড়ায় তা অবাধে চলছে। আমরা মনে করি পুরো অঞ্চলেই এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে হবে।
- সাদামাটি উত্তোলনের ফলে যেসব আদিবাসী ও বাঙালি পরিবার বাস্তচ্যুত হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে হবে।
- ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যক্তিবর্গের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
- পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্য ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করতে হবে এবং দায়িদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
- পরিবেশ ও জৈব বৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারসাম্যহীন উপায়ে যেভাবে খনন কাজ করা হয়েছে এবং খননের পর বিদ্যমান কোনো প্রটোকল নামেনে সংশ্লিষ্ট জায়গা যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছে, সেটা পুনরায় জীববৈচিত্র্যের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে এবং এর আর্থিক দায়ভার খননকারী প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।
- খননের ফলে সৃষ্ট খাদ বা খাদের পানিতে পরে বিভিন্ন সময় শিশুসহ বেশকিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমরা মনে করি অবিলম্বে সেখানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা যায় এবং এই পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন সেই সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- পাশাপাশি আমরা মনেকরি সোমেশ্বরী নদী হতে যেভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে সেটাও পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান ও প্রটোকল মেনে চলা উচিত। বালুর ট্রাক চলাচলের ফলে দূর্গাপুরবাসী প্রতিদিন যে দুর্ভোগ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হন তা লাঘব করার জন্য একটা বাইপাস সড়ক নির্মাণ খুব জরুরি।
- প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনজীবন ও প্ররিবেশের উপর যেন প্রতিকূল প্রভাব না পড়ে তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
- খনন কাজের সময় স্থানীয় পর্যায়ে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো মনিটরিং থাকেনা। মনিটরিং থাকা অত্যন্ত জরুরি। পর্যটন ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকাও খুব দরকার।
- মাটি উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি প্রাপ্তি এবং স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য বিদ্যমান আইএলও কনভেনশন একদমই মানা হচ্ছেনা। শ্রমিকদের এই স্বার্থের বিষয়টিও দেখার জন্য দাবি জানান।