হিল ভয়েস, ৪ এপ্রিল ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: শামীম মাহফুজের নেতৃত্বে ইসলামী জঙ্গী সংগঠন ‘জামায়াতে আরাকান’ এবং সেনা-মদদপুষ্ট কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর মধ্যে এক ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বান্দরবান জেলার সদর উপজেলার সারণ পাড়া (৭ মাইল এলাকা) নামক বম গ্রামে ২০২০ সালে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদনে সেনাবাহিনীর দিক নির্দেশনা ছিল বলে জানা গেছে।
সম্পাদিত এই চুক্তিতে সমঝোতা হয়েছে যে, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লংটলাই জেলার চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় বম বসতির কাছাকাছি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করবে এবং ‘জামায়াতে আরাকান’ ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ত্রিসীমানায় ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেবে।
সম্পাদিত সমঝোতা অনুসারে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যদের মধ্যে যারা মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে, সেসব প্রশিক্ষিত সদস্যরা ইসলামী জঙ্গী সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালে কেএনএফের ৪০ জন সদস্য সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে কাচিন প্রদেশে যায়। তন্মধ্যে সেখানে ২ জন মারা যায় আর ১২/১৩ জন সদস্য প্রশিক্ষণ থেকে পালিয়ে আসে।
তৃতীয়ত এই মর্মে আরো সমঝোতা হয়েছে যে, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের মাধ্যমে জামায়াতে আরাকানের জঙ্গীরা চোরা পথে অস্ত্র ও গোলাবারূদ ক্রয় ও সংগ্রহ করবে এবং ক্রয়কৃত উক্ত অস্ত্র থেকে জামায়াতে আরাকান নির্দিষ্ট পার্সেন্টিজ অনুসারে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে অস্ত্র ও গোলাবারূদ ভাগ দেবে।
চুক্তিতে আরো রয়েছে যে, জামায়াতে আরাকান মাসে ৫ লক্ষ টাকা করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে অর্থ সহায়তা প্রদান করবে। এছাড়া ক্যাম্প নির্মাণ, প্রশিক্ষণ, খাদ্য-সামগ্রী, চিকিৎসা ইত্যাদি সংক্রান্ত যাবতীয় খরচও ইসলামী জঙ্গীরা বহন করবে।
এই চুক্তি সম্পাদনের সময় সারণ পাড়ার অধিবাসী ফেনখুপ বম, চেওসিম বম ও তলয়াংথন কার্বারী, বেথানি পাড়ার অধিবাসী ভানলালরুয়াত ম্রু এবং ফারুক পাড়ার অধিবাসী রুয়াতসাং বম উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। তারা সকলেই কেএনএফের বান্দরবান ডিভিশন কমিটির সদস্য বলে জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে যে, কেএনএফের অধিকাংশ সভা বা সম্মেলন সাধারণত এই সারণ পাড়াতেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
আরো উল্লেখ্য যে, নাথান বম সারণ পাড়াতে আসলেই একটি সাদা গাড়িতে করে দাঁড়িওয়ালা একজন মুসলিম ব্যক্তি সারণ পাড়াতেই এসে থাকেন। উক্ত দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি ‘জামায়াতে আরাকান’-এর শামীম মাহফুজ বলে প্রত্যক্ষদর্শী অনেক স্থানীয় ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের দিকে রুমা উপজেলার এডেন রোডে কেএনএফ-এর অফিসটি তখনকার বান্দরবানের ব্রিগেড কমান্ডার নকিব আহমেদ চৌধুরী উদ্বোধন করেছিলেন। সূত্রে আরো জানা যায় যে, সেনাবাহিনীর এজেন্ডা অনুসারেই মূলত কেএনএফ ও জামায়াতে আরাকানের মধ্যে এই ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর দিক নির্দেশনা অনুসারে কেএনএফ কর্তৃক মিজোরামের পারবায় ও জামায়াতে আরাকান কর্তৃক ত্রিসীমানায় ক্যাম্প স্থাপন, জামায়াতে আরাকান কর্তৃক কেএনএফ’কে মাসোয়ারা অর্থ প্রদান এবং কেএনএফের মাধ্যমে ইসলামী জঙ্গীদের অস্ত্র ও গোলাবারূদ ক্রয় ও সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয়গুলো চুক্তিতে আনা হয়েছে।
উক্ত চুক্তি অনুসারে এযাবত কেএনএফের প্রশিক্ষিত সদস্যরা জামায়াতে আরাকানের সশস্ত্র জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে এবং রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা এলাকায় একসাথে অবস্থান করে আসছে। তবে চুক্তির উক্ত পরিকল্পনা অনুসারে মিজোরামের পারবায় গিয়ে সম্প্রতি (২৪ মার্চ ২০২২) বিএসএফ কর্তৃক কেএনএফের ৬ জন সদস্য গ্রেফতার এবং ২০/২৫ জনের অপর আরেকটি সশস্ত্র গ্রুপকে পারবা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কেএনএফের সদস্যদের গ্রেফতার করা ও আরেকটি গ্রুপকে তাড়িয়ে দেয়ার ফলে সেই ষড়যন্ত্রের চুক্তি বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছে এবং তাতে করে কেএনএফের সদস্যসহ ষড়যন্ত্রকারী মূলহোতাদের অনেকেই হতাশ হয়েছে বলে জানা গেছে।
আরো জানা গেছে যে, ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জামায়াতে আরাকানের জঙ্গীরা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সভাপতি নাথান বম এবং সাধারণ সম্পাদক ভানচুংলিয়ান বমকে প্রথম কিস্তিতে এক কোটি টাকা দিয়েছে। পরে দ্বিতীয় বার আরো তাদের হাতে ৮০ লক্ষ টাকা এবং তৃতীয় কিস্তিতে ৭৫ লক্ষ টাকা অস্ত্র ও গোলাবারূদ ক্রয়ের জন্য কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ইসলামী জঙ্গীরা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এভাবে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট অনেকটা অর্থের বিনিময়ে ইসলামী জঙ্গীদের একপ্রকার ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করছে বলে বম জনগোষ্ঠীর স্থানীয় অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে যে, ইসলামী জঙ্গীদের প্রদত্ত এসব অর্থ দিয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সভাপতি নাথান বম ও সাধারণ সম্পাদক ভানচুংলিয়ান দু’জনে তিনতলা বিশিষ্ট দু’টি বিল্ডিং নির্মাণ করছেন। উক্ত বিল্ডিং দু’টির নির্মাণ কাজ একই সময়ে শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এভাবে পাকা বাড়ি নির্মাণ করার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেয়া দিয়েছে। তারা দু’জনেই পাকা বাড়ি নির্মাণ করছেন, আর সাধারণ সৈনিকরা অপরিসীম দু;খ-কষ্ট ভোগ করছেন মর্মে সৈনিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ফলে বিল্ডিং নির্মাণের কাজ কিছু দিনের জন্য নাকি বন্ধও ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সালে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় নাথান বমকে সভাপতি এবং ভাঙচুংলিয়ান বমকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়ে কুকি-চীন ডেভেলাপমেন্ট অরগানাইজেশান (কেএনডিও) নামক সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে সেই সংগঠনটির নাম কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে নাম পরিবর্তন করা হয় এবং উক্ত সংগঠনের সশস্ত্র শাখা হিসেবে কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) গঠন করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াং, খুমী, ম্রো প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে কেএনএফ গঠন করা হয়েছে বলে এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ দাবি করে থাকলেও বস্তুত সেনাবাহিনী ও ইসলামি জঙ্গীদের মদদে ও পৃষ্টপোষকতায় বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ও সেনা দালাল শ্রেণির ব্যক্তি কর্তৃক এই সংগঠনটি গঠন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে ।
অভিযোগ রয়েছে যে, এই সংগঠনটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীর এজেন্ডা অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও বিভাজন উস্কে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বানচাল করা, চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও হামলা, সর্বোপরি জুম্ম জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করা।
এই সংগঠনের সশস্ত্র সদস্যদের সাথে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের প্রাক্তন সদস্য শামীম মাহফুজ-এর নেতৃত্বে ‘জামায়াতে আরাকান’ নামে একটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সশস্ত্র জঙ্গীরা রুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করে বলে জানা যায়। বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইসলামিক জঙ্গী সংগঠনের সাথে এই জামায়াতে আরাকান জঙ্গী সংগঠনটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে।
রুমা সেনাজোনের ২৮ বীর রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন রুমা উপজেলার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের লুইসাং পাড়া আর্মি ক্যাম্প, কেওক্রডং আর্মি ক্যাম্প, সুনসং পাড়া আর্মি ক্যাম্প, বাগলাই পাড়া আর্মি ক্যাম্প প্রভৃতি সেনা ক্যাম্পের সংলগ্ন লুইসাং পাড়া, সৌলপি পাড়া, চৈক্ষ্যং পাড়া, তিঙদাউল্টে পাড়া ও থাইক্ষ্যং পাড়ায় কেএনএফ ও জামায়াতে আরাকান সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অবস্থান করে বলে জানা গেছে।