হিল ভয়েস, ৩০ মার্চ ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: অতি সম্প্রতি কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং উক্ত সংগঠনের সশস্ত্র শাখা কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মী নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। এই সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াং, খুমী, ম্রো প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে জৌ জাতি হিসেবে বিবেচনা করে এবং জৌ জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বলে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ দাবি করছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জৌ জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই কেএনএফ/কেএনএ গঠন করা হয়েছে বলে কেএনএফ নেতৃবৃন্দ দাবি করে থাকলেও মূলত সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর মদদে ও পৃষ্টপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত বিভাজন ও সংঘাত উস্কে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই সংগঠনটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে যে, বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তি দ্বারা ব্যক্তিগত কায়েমী স্বার্থে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং এতে কথিত জৌ জাতিগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও সমর্থন নেই বললেই চলে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, ২০০৮ সালে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় নাথান বমকে সভাপতি এবং ভাঙচুনলিয়ান বমকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়ে কুকি-চীন ডেভেলাপমেন্ট অরগানাইজেশান (কেএনডিও) নামে এই সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে।
সংগঠনটির ভাষ্য মতে, গণতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায় সম্ভব না হওয়ায় পরবর্তীতে ২০১৬ সালে সেই সংগঠনটির নাম কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে নাম পরিবর্তন করা হয় এবং উক্ত সংগঠনের সশস্ত্র শাখা হিসেবে কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) গঠন করে সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। কেএনএফ-এর নেতৃবৃন্দের মতে, কেএনএফ-এর লক্ষ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জৌ জাতিগোষ্ঠী এবং খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসী অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
‘ভাঙলায়াইন’ নামক মিজোরাম ভিত্তিক পত্রিকা ২৩ মার্চ ২০২২ তারিখে মিজো ভাষায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, কেএনডিও ২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জৌ জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং জৌ জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দের জন্য বাংলাদেশে সরকারের কাছে দাবি জানায়। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার জৌ জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত ৯টি উপজেলাকে কুকি-চীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যও এই সংগঠনটি সরকারের কাছে দাবি জানায় বলে উক্ত পত্রিকার সংবাদে উল্লেখ করা হয়।
তবে অভিযোগ করা হয় যে, জৌ জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে কেএনএফ গঠন করা হয়েছে বলে কেএনএফ নেতৃবৃন্দ দাবি করে থাকলেও বস্তুত তাদের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলমান নেই।
সূত্র জানিয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও বিভাজন উস্কে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বানচাল করা, চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও হামলা, সর্বোপরি জুম্ম জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের হীনউদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর মদদে ও পৃষ্টপোষকতায় প্রথমে কেএনডিও নামে, পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে কেএনএফ ও কেএনএ গঠন করা হয়েছে।
বস্তুত সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের গোপন উদ্দেশ্যকে ধামাচাপা দিতে, নিজেদেরকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জায়েজ করতে, সর্বোপরি জৌ জনগোষ্ঠীর লোকজন থেকে সহজে সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যেই কেএনএফ/কেএনএ ৯টি উপজেলাকে কুকি-চীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি ও জৌ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের সস্তা শ্লোগান তুলে আসছে। বস্তুত তাদের সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোন কর্মসূচি লক্ষ করা যায়নি বলে স্থানীয় অধিবাসীরা জানিয়েছেন।
আবির্ভাব হওয়ার সাথে সাথে এই সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে এবং চাকমা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক প্রচারনা শুরু করে। কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টে ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রচার করা হয় যে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্মল্যান্ড নয়, এটি কুকি-চীন টেরিটোরি।” আরো বলা হয় যে, “পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি এবং তাদের গঠিত আঞ্চলিক পরিষদ কুকি-চীন জনগোষ্ঠীদের জন্যে নয়, এটা একটা চাকমা চুক্তি এবং চাকমা জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নমূলক পরিষদ মাত্র।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, কেএনডিও/কেএনএফ সদস্যরা মূলত সেনাবাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ৩নং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের ৬, ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের লুইসাং পাড়া, সৌলপি পাড়া, চৈক্ষ্যং পাড়া, তিঙদাউল্টে পাড়া ও থাইক্ষ্যং পাড়া ইত্যাদি বম জনগোষ্ঠী অধ্যূষিত গ্রামে অবস্থান করে থাকে। এই সমস্ত এলাকার নিকটবর্তী সেনাক্যাম্প হচ্ছে- লুইসাং পাড়া আর্মি ক্যাম্প, কেওক্রডং আর্মি ক্যাম্প, সুনসং পাড়া (বম পাড়া) আর্মি ক্যাম্প এবং বাগলাই পাড়া (বম+ত্রিপুরা) আর্মি ক্যাম্প। এগুলো রুমা সেনাজোনের ২৮ বীর রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায় যে, কেএনডিও/কেএনএফ সদস্যদের সাথে শামিম মাহফুজ-এর নেতৃত্বে ‘জামায়াতে আরাকান’ নামে একটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সশস্ত্র জঙ্গীরা অবস্থান করে বলে জানা যায়। শামিম মাহফুজ এককালে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং হরকাতুল জিহাদ-এর সদস্য ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য যে, জামায়াতে আরাকান জঙ্গী সংগঠনটির সাথে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইসলামিক জঙ্গী সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
কেএনডিও/কেএনএফ-এর সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ১০০ জন যারা সবাই বম জাতির মানুষ এবং তাদের সাথে থাকা ‘জামায়াতে আরাকান’-এর ১৫০ জনের অধিক জঙ্গী সদস্য রুমার রেমাক্রী প্রাংসা এলাকায় কেএনএফদের প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেএনএফ ও জামায়াতে আরাকান সদস্যদেরকে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। কেএনএফ/কেএনএ-এর সদস্যদের কয়েকটি দেশীয় গাদা বন্দুক, এসবিবিএল ও পয়েন্ট টুটু রাইফেল এবং কয়েকটি একে-৪৭ রাইফেল রয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বম জনগোষ্ঠীর একজন জনপ্রতিনিধি জানান যে, কেএনডিও/কেএনএফ’কে মূলত ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনী অর্থ যোগান দিয়ে থাকে । এছাড়া এই সংগঠন জনগণের কাছে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। তাদের উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণ এবং তাদের আন্দোলনের কোন কর্মসূচি চলমান না থাকায় এবং সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় স্থানীয় জনগণের কাছে তাদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই বলে জানা গেছে। কেএনডিও/কেএনএফ জনবিচ্ছিন্ন একটি সংগঠন বলে দাবি করেন উক্ত জনপ্রতিনিধি।
মিজোরাম সীমান্তে ৬ জন কেএনএফ সদস্য আটক:
গত ২৪ মার্চ ২০২২ সকাল ৬:৩০ টা সময় মিজোরাম সীমান্তে বিএসএফের ১৯৯নং পারভা ব্যাটালিয়ন কর্তৃক ৬ জন কেএনএফ/কেএনএ সদস্যকে আটক করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ত্রিসীমানা দিয়ে মিজোরামের লংটলাই জেলার চৌংতে মহকুমার পারবা’র বন্দুকভাঙ্গা এলাকার ১ নম্বর পিলার দিয়ে ভারতে প্রবেশকালে তাদেরকে আটক করা হয় বলে জানা গেছে। আটককৃত ব্যাক্তিরা নিজেদেরকে কেএনএফ/কেএনএ সদস্য বলে দাবি করেছে।
গত ২৮ মার্চ ২০২২ মিজোরাম ভিত্তিক দৈনিক ‘রোয়াথ্লা’য় মিজো ভাষায় প্রকাশিত সংবাদে আটককৃত ব্যক্তিদের নাম হচ্ছে- ১. লাল রামনি বম, ২. নুনসাং বম (৩৯), ৩. লালসাং রেম বম, ৪. লালসাং কুম বম (৩২), ৫. লিয়ান বাভি সাং বম (৩০), এবং ৬. রামোলিংলিয়ান বম (২০), পিতা- লালথান কুং। তারা সকলেই রুমা উপজেলার বান্দরবান জেলার বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়েছে।
আটককৃত ব্যাক্তিদের কাছ থেকে একটি চিঠির কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মির সভাপতি এবং চীফ অফ স্টাফ সীলমোহরসহ ভিএইচএফ সেট ১টি, কমান্ডো নাইফ ৩টি, মোবাইল ফোন, নগদ এক লক্ষ বাংলাদেশী মুদ্রা, ত্রিশ হাজার ভারতীয় রুপি, ৩টি ইউনিফর্ম (যা বাংলাদেশ আর্মির ব্যবহৃত ইউনিফর্ম-এর সাথে পুরোপুরি মিল রয়েছে) এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আটককৃতদেরকে ২৫ মার্চ ২০২২ তারিখে লংটলাই জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে আটককৃত ৬ জন কেএনএফ-এর সন্ত্রাসীদের লংটলাই জেলে রাখা হয়েছে।
কেএনএফের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ২৫ মার্চ ২০২২ তারিখে প্রচারিত একটি ভিডিও চিত্র থেকে জানা যায় যে, কেএনএফ/কেএনএ-এর কিছু সশস্ত্র সদস্য মিজোরামের লংটলাই জেলার অন্তর্গত পারবা ভিলেজ কাউন্সিলের নিকটবর্তী তৈচং ছড়ায় অবস্থান নেয়।
এসময় তাদের পক্ষ থেকে বন্দুকভাঙা এবং বর্ডারের মাঝামাঝি ‘ভূইচেক’ এলাকায় জুমচাষীদেরকে ধূপ্পানিছড়া, শিলছড়ি, শুকনোছড়ি ইত্যাদি ট্রাই-জংশন এলাকায় যেতে নিষেধ করেছে এবং জুম চাষীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ধান, ক্ষেতের শাকসবজি ও গবাদি পশু আদায় করছে।
বিশ্বস্ত সূত্র মতে, পারবার এলাকার অন্তর্গত বাংলাদেশ বর্ডার ঘেঁষা শুকনোছড়িতে অবৈধভাবে অবস্থানরত কেএনএ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভারতের বিএসএফ এবং আসাম রাইফেলস-এর পক্ষ থেকে অতিসত্তর ভারতীয় টেরিটোরি ত্যাগ করার জন্য কড়াকড়িভাবে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।