হিল ভয়েস, ২২ মার্চ ২০২২, বান্দরবান: আজ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাজস্থলী উপজেলার সীমান্তবর্তী বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নে প্রতিপক্ষের সাথে বন্দুক যুদ্ধে সেনামদদপুষ্ট আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) ও মগপার্টির ৩ সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
আজ ২২ মার্চ ২০২২ সকাল আনুমানিক ৯:০০ টার দিকে জামছড়ি ইউনিয়নের অন্তর্গত ৩৩০নং হ্নারা মৌজার থাংখ্রুই পাড়া এলাকায় এই বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। ঘটনায় এএলপি’র ২ জন ও মগ পার্টির ১ সদস্য নিহত হওয়ার খবর জানা যায়।
নিহত মগ পার্টির সদস্যের নাম অংথোয়াই মারমা (৪৫), পীং-থুইখইঞো মারমা। তার বাড়ি হ্নারা মৌজার থাংখ্রী পাড়ায় বলে জানা গেছে। অপরদিকে, নিহত এএলপি সদস্যদের নাম জানা যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এএলপি মূলত মিয়ানমারের আরাকান ভিত্তিক একটি বিদ্রোহী দল। এই দলের একটি গ্রুপ কিছু সময় আগেও সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের ছত্রছায়া ও পৃষ্টপোষকতায় বান্দরবান ও রাজস্থলীতে অবস্থান করত। প্রশাসনের নাকের ডগায় তারা চাঁদাবাজি, গ্রামবাসীদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাত।
পরে ২০২০ সালের শেষের দিকে এএলপির অধিকাংশ সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে গেলেও আরেকটি অংশ রাজস্থলী এলাকায় থেকে যায়। এএলপি’র ঐ অংশটিই এক পর্যায়ে মারমা লিবারেশন পার্টি বা মগ পার্টি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। যে মগ পার্টি সম্প্রতি রাজস্থলী ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের মদদে ও পৃষ্টপোষকতায় জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মীসহ স্থানীয় নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এএলপি’র নামের সাথে যেহেতু ইহা একটি বিদেশী দল হিসেবে পরিচিতি রয়েছে, সেহেতু সেনাবাহিনীর পরামর্শেই পরে অবশিষ্ট এএলপি’র সদস্যদের দিয়ে এবং আরও কয়েকজন স্থানীয় যুবককে অন্তর্ভুক্ত করে মারমা লিবারেশন পার্টি বা মগ পার্টি গঠন করার ঘোষণা দেয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, সম্প্রতি সেনাবাহিনীর নির্দেশনায় মগ পার্টির সদস্যরা নিজেদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড জোরদার করার লক্ষে অন্য এএলপি দলের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। ধারণা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের সহযোগিতায় মোটা অংকের আর্থিক পুরস্কারের বিনিময়ে নতুন করে পুরনো এএলপি সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হচ্ছে। মগ পার্টির সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষে উক্ত এএলপি সদস্যদের রাজস্থলীতে মগ পার্টির ঘাঁটি এলাকায় আনা হচ্ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ারমার-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিসীমানা থেকে এএলপি কমান্ডার মেজর সাংথোয়াইন-এর নেতৃত্বে এএলপির ৯ জন সদস্য ১৮টি অস্ত্রসহ বান্দরবানের রুমা উপজেলার দিকে রওয়ানা দেয়। তাদেরকে অস্ত্রসহ গত ১৪ মার্চ ২০২২ রুমার বগালেকের মেনদৌই (ম্রো পাড়া) পাড়াতে দেখা গেছে। এরপর রুমা খালের পাশে অডিরাম পাড়ায়ও তাদেরকে দেখা যায়। সর্বশেষ ১৭ মার্চ ২০২২ সকালের দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় এএলপি সদস্যদের একটি সশস্ত্র দলকে দেখা গেছে।
যতটুকু জানা যায়, সাংথোয়াইন ছিলেন বর্তমান মগপার্টির প্রধান খইলাং-এর জুনিয়র। এসময় সাংথোয়াইন রুমার পানতলা এবং নাইতং এলাকায় ছিলেন। চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণের টাকাসহ সেনাবাহিনী এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ক্যাশৈহ্লার প্রদত্ত অর্থ দিয়ে উক্ত ১৮টি অস্ত্র মগপার্টির সন্ত্রাসীরা কিনে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ১৯ মার্চ ২০২২ শনিবার রুমার মুয়ালপি পাড়ায় মগ ও এএলপিরা মিলিত হয়। মগপার্টির সন্ত্রাসীরা মুয়ালপি পাড়ায় অপেক্ষায় ছিলেন আর এএলপি সন্ত্রাসীরা মৌদং ম্রো পাড়া থেকে মুয়ালপি পাড়ায় এসে একত্র হয়।
অপরদিকে ১৭ মার্চ ২০২২ মগ পার্টির ২০-২৫ জনের একটি দল প্রায় দশটি মোটর সাইকেল যোগে রুমায় যায়। সূত্রটির মতে, এএলপি সদস্যদের রাজস্থলীতে আনার জন্যই মগ পার্টির সদস্যরা সেখানে যায়।
আরো উল্লেখ্য যে, আজ (২২ মার্চ) গোলাগুলির ঘটনার ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে সকাল ৬:৪৫ টার দিকে বান্দরবান সদরের বালাঘাটা এলাকায় উক্ত এএলপি সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় বলে একটি সূত্র জানায়।
জানা গেছে, আজ সকালের দিকে এএলপি ও মগ পার্টির সদস্যরা একসঙ্গে বান্দরবান সদরের বালাঘাটার মিনঝিরি পাড়া থেকে রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়ার দিকে যাচ্ছিল। পোয়াইতু পাড়া হচ্ছে মগ পার্টির প্রধান ঘাঁটি এলাকা। এএলপি ও মগ পার্টির সদস্যরা প্রথমে কিছুদূর গাড়িযোগে যায়। এরপর তারা পায়ে হেটে যাচ্ছিল। এমন সময় বান্দরবানের জামছড়ি ইউনিয়নের থাংখ্রুই পাড়া এলাকায় পৌঁছলে অজ্ঞাতপরিচয় প্রতিপক্ষ দল এএলপি ও মগ পার্টির সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে উভয়পক্ষের বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে ঘটনাস্থলে এএলপি ও মগ পার্টির তিন সন্ত্রাসী নিহত হয় বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য পার্বত্য জেলায় সেনামদদপুষ্ট সন্ত্রাসী দল ‘মগ পার্টি’কে কিভাবে আরও ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট মহলকে নিয়ে একাধিক ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠক করেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া যায়। উক্ত বৈঠকে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী ও বিজিবি’র কর্মকর্তাগণ ছাড়াও, জেলা আওয়ামীলীগ, মগ পার্টি, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), পার্বত্য নাগরিক পরিষদ এর প্রতিনিধি এবং সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবাহী কিছু জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান ও ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।
বৈঠকে বান্দরবান সদর ও এর আশেপাশের এলাকায় যাতে পার্বত্য চুক্তির পক্ষের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কোনো প্রকার আনাগোনা এবং কার্যক্রম না থাকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। মগ পার্টির সশস্ত্র তৎপরতার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেনা অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়।
শুধুমাত্র বিগত দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২২) এইসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ৩ ব্যক্তি খুন, ১৫ ব্যক্তি সাময়িক অপহরণ ও অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ৪ জন হুমকি ও মারধরের শিকার, ১ জনকে হত্যার চেষ্টা এবং ৪টি বাড়ি তল্লাসীর শিকার হওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ গত ৫ মার্চ ২০২২ সকাল আনুমানিক ১১:০০ টার দিকে মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের গুলিতে রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নে উনুমং মারমা (৪৭) নামে এক নিরীহ গ্রামবাসী হত্যার শিকার হন।
তবে, ঐ দিনই দুপুর ২:০০ টার দিকে প্রতিপক্ষের গুলিতে রোয়াংছড়ি-রুমা সীমানার সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী ফালংক্ষ্যং নামক জায়গায় মগ পার্টির অন্তত ৪ হতে ৬ জন সশস্ত্র সদস্য নিহত হয় বলে জানা যায়।