হিল ভয়েস, ১৩ মার্চ ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: বিগত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক জুম্ম জনগণের উপর কমপক্ষে ২৮টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সংঘটিত করেছে। যার মধ্যে ২৫ জন জুম্মকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া সেনামদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ৩ ব্যক্তি খুন এবং ১৫ ব্যক্তি সাময়িক অপহরণ ও অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার (১২ মার্চ) বিগত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী সামরিক স্বৈরশাসকদের ন্যায় সামরিক উপায়ে ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত সমাধানের ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করে চলেছে, তা আজ দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির কোনো মৌলিক বিষয় সরকার বাস্তবায়ন করেনি এবং বাস্তবায়নের জন্য কোনো আন্তরিক উদ্যোগ বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। দীর্ঘ ১৩ বছরের অধিক কাল ধরে একনাগাড়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। অথচ সরকার গোয়েবলসীয় কায়দায় উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে প্রতিনিয়ত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করে চলেছে ও পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়নের জোয়ার অব্যাহত রেখেছে বলে প্রচার করছে। শুধু তাই নয়, সরকার পক্ষ বর্তমানে অব্যাহতভাবে চুক্তির বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনসহ চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। চুক্তির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুকে পদদলিত করে জনস্বার্থ বিরোধী সড়ক নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জুম্মদের ক্রমাগত স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস ও অধিকতর প্রান্তিকীকরণসহ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদন আরো উল্লেখ করা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ বিস্ফোরন্মুখ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। দীর্ঘ ২৪ বছরেও জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকারের সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে এবং জুম্মদের অধিকার পদদলিত করে তাদেরকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক দল সৃষ্টি করে তাদেরকে আজ জুম্ম জনগণ ও চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধেমুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এক সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। অপরদিকে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেফতার, হয়রানি, হুমকি দিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়েছে। ফলে তাদেরকে আবারো ঠেলে দেয়া হচ্ছে আত্মগোপনের পথে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এক অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
গত দুই মাসেও (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২২) নিরাপত্তাবাহিনী তথা সেনাবাহিনীর আগ্রাসনমূলক সামরিক অভিযান, আধিপত্য, নিপীড়ন, নির্যাতনমূলক কার্যক্রম বহাল তবিয়তে অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে সেনাবাহিনী কমপক্ষে ২৮টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সংঘটিত করেছে। এসব ঘটনার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম অধুষিত এলাকায় অন্তত ৮টি সামরিক টহল ও তল্লাসী অভিযান, ৩ ব্যক্তি খুন, ১৭ নিরীহ ব্যক্তি মারধর/নির্যাতন, জনপ্রতিনিধিসহ ৭ ব্যক্তি গ্রেপ্তার, ১৮ ব্যক্তি সাময়িক আটক, ১ ব্যক্তি আহত, ১১ জন হুমকি ও হয়রানি, ১০টি বাড়ি তল্লাসী, ২২ জন মিথ্যা মামলার শিকার, ২টি বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
গত দুই মাসেও (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২২) নিরাপত্তাবাহিনীর আগ্রাসনমূলক সামরিক কার্যক্রমসহ সরকারের বিশেষ মহল ও নিরাপত্তাবাহিনীর সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও মগ পার্টি প্রভৃতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন লেলিয়ে দিয়ে জনসংহতি সমিতি সদস্য ও চুক্তি সমর্থকদের উপর খুন, অপহরণ, মুক্তপণ আদায় ও নির্যাতন, নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সেনামদদপুষ্ট এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ৩ ব্যক্তি খুন, ১৫ ব্যক্তি সাময়িক অপহরণ ও অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ৪ জন হুমকি ও মারধরের শিকার, ১ জনকে হত্যার চেষ্টা এবং ৪টি বাড়ি তল্লাসীর শিকার হওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া যায়। খুন, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর জন্য ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাজস্থলী উপজেলা থেকে একদল মগপার্টি সশস্ত্র সদস্যকে রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নে নিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক পৃথক দুটি ঘটনায় ৩ নিরীহ জুম্ম মারধরের শিকার ও একটি ভূমি বেদখলের চেষ্টার ঘটনা ঘটে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ২ বৌদ্ধ ভিক্ষু হামলার শিকার হয়, এদের মধ্যে এক ভিক্ষু খাগড়াছড়িতে নৃশংসভাবে খুন হন, আরেকজন চট্টগ্রামে হামলায় আহত হন। মুসলিম সেটেলার বাঙালি ও ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠী কর্তৃক এই হামলা সংঘটিত হয় বলে সন্দেহ করা হয়।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংলগ্ন বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নে সক্রিয় রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গী সশস্ত্র গ্রুপ, আরসা ও আরএসও কর্তৃক ঘুমঘুম ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় জুম্ম অধিবাসীদের উপর নানা ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার ফলে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত জুম্ম অধিবাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও এই সময়ে বান্দরবানের আলিকদমে ও উপজেলা সদরে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক বেআইনীভাবে অবাধে বালু, পাথর উত্তোলন এবং অবৈধভাবে কাঠ পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়। যথাযথ চিকিৎসা সেবা অভাবের কারণে জানুয়ারি মাসে তিন পার্বত্য জেলায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অন্তত ১৫ শিশুর মৃত্যু হওয়ার খবর জানা যায় বলে জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।