বাচ্চু চাকমা
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মতো একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিকে নিয়ে লেখার যথোপযুক্ত মালমশলা, ভাষা ও শব্দচয়ন আমার কাছে তেমন নেই। বিদেশের মাটিতে অবস্থান করে প্রিয় জন্মভূমির নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির জন্য স্বপ্ন বুনে ছিলেন, এবং বাস্তবে কথা ও কাজে সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, যেটা যার-তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনে বাস্তবে তা করে দেখালেন। তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, এবং জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে বর্হিবিশ্ব থেকে সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ের জন্য আজীবনই সংগ্রাম করে গেছেন।
জাতির জন্য দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর যে আত্মত্যাগ তা পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ তা জানতেই পারেনি। স্বাধীন দেশে পরাধীনতার গ্লানি ও যন্ত্রণা তাঁকে আমৃত্যু পর্যন্ত স্থিরভাবে থাকতে দেয়নি। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে অনেক জ্ঞানী-গুণীজন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্তব্য করেন এভাবেই যে, “ড. দেওয়ান একজন নিরহংকার, নিঃস্বার্থ ও নিরব প্রচার সৈনিক”। জুম্ম জাতির অধিকারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বহু দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচারাভিযান চালিয়ে গেছেন।
এই আজীবন সংগ্রামী মানুষটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছে কেবল তাঁর মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক অনলাইন স্মরণসভা শীর্ষক আলোচনায়, অনলাইন পোর্টাল হিল ভয়েসে প্রকাশিত সংবাদে “জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাক্ষাৎকারটি” পড়ে। গত বছরে জনসংহতি সমিতির প্রকাশিত “১০ই নভেম্বর স্মরণে” পুস্তিকা অধ্যয়ন করে আরও গভীরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সবচেয়ে যে বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে তা হল তিনি ছিলেন জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি আজীবনই দৃঢ় বিশ্বাসী। জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে একমাত্র কান্ডারী সংগঠন জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা, বিশ্বাস ও আনুগত্যতা দেখে তাঁর সম্পর্কে জানতে আমি আরও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম। সেকারণেই দুয়েক লাইন না লিখে চুপচাপ করে থাকতে পারলাম না। তাঁর আপোসহীন সংগ্রামী চেতনা ও জাতির জন্য আমৃত্যু পর্যন্ত নিঃস্বার্থতা আমাকে আরও বেশি পাগল করে তুলেছিল।
প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম বিষয়ে বিশেষ পাঠ নেওয়ার চেষ্টা করেছি বারবার, আজও তা চলমান রয়েছে। বর্তমান জুম্ম জনগণের একমাত্র আশা-ভরসার প্রতীক তথা জুম্ম জনগণের জীবন্ত কিংবদন্তী প্রিয়নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রামের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করলে আমাদেরকে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জোগায়। গত ২০২১ সালে ২৯ মার্চ ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুর পর আমার জীবনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আরও একজন অন্যতম নিঃস্বার্থ ও আপোসহীন সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়েছি। এই মহান মানুষটি আজীবন সংগ্রামী লারমা পরিবারের সঙ্গে শৈশব থেকেই বেড়ে উঠেছিলেন, আত্মীয়-পরিচয়ে তিনি প্রিয়নেতা সন্তু লারমাদের আপন ছোট মামা হন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম নিয়ে এই মহান মানুষটি অনেক গভীরে গিয়ে চিন্তা করেছিলেন, চিন্তার প্রতিফলন ঘটালেন কাজের মাধ্যমে এবং জুম্ম জনগণের স্বাধীকারের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জুম্মদের একজন অন্যতম দূত এবং নীরব প্রচার সৈনিক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূষিত হলেন। পাহাড়ের বুকে কতজন জুম্ম তরুণ-তরুণিইবা এই মহান মানুষটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ রাখেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাদপদ, ঘুণেধরা, রক্ষণশীল, পরনির্ভরশীল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামন্তীয় সমাজের মধ্যে বেড়ে উঠার পর পাহাড়ের সংকটময় পরিস্থিতিকে বদলানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে আজীবন লড়াই করে গেলেন তিনি। জুম্ম সমাজের তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত এলিট শ্রেণির দশের বাইরে গিয়ে এগার হওয়ার চেষ্টা করেছেন, আমৃত্যু সংগ্রাম করে রীতিমত সফলও হলেন তিনি। দুনিয়ার স্বার্থবাদী ও ভোগবাদী সমাজের দালালীপনা তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি, পুঁজিবাদের প্রাচুর্যের ভরপুর অন্যতম চাকচিক্যময় দেশ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারে বসবাস করেও খাওয়া-দাওয়া, চলনে-বলনে, পোশাক-পরিচ্ছদে অত্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে সাদা-সিধে জীবন যাপন করেছিলেন।
ভোগবাদী সমাজ ড. দেওয়ানকে কোনক্রমেই ভোগবাদী বানাতে পারেনি, এবং ভোগবাদী সমাজের দালালীপনাকে ঘৃণা করেছেন প্রতি পদে পদে। ব্যক্তি স্বার্থপরতা, দোদুল্যমানতা, উচ্চাভিলাষ, আত্মকেন্দ্রিকতা ও সুবিধাবাদীতা চলমান সমাজ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা সংগ্রাম বিরোধী চিন্তাধারাগুলো তাঁর লড়াই সংগ্রামকে একমুহূর্তের জন্যও থামিয়ে রাখতে পারেনি। শ্রী মঙ্গল কুমার চাকমার সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে, কৃচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে তাঁর ঘর থেকে ড. দেওয়ান বৈদ্যুতিক সংযোগও বিচ্ছিন্ন করেছেন। বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বাঁচিয়ে উক্ত টাকা দিয়ে তিনি জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্যাম্পেইন করেছেন। শীত প্রধান দেশে বিদ্যুৎ ছাড়া, হিটার বিহীন অবস্থায় কিভাবে জীবন কাটান বলে শ্রী ডক্টর দেওয়ানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান যে, জনসংহতি সমিতির সদস্যরা তীব্র শীতে রাত-বিরাতে জঙ্গলে ছড়াছড়িতে যদি থাকতে পারে ও যাতায়াত করতে পারে, তাহলে তিনি বিদ্যুৎ ও হিটার ছাড়া ঘরের মধ্যে থাকতে পারবেন না কেন, সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না কেন এমন উল্টো প্রশ্ন করে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান আন্দোলনের প্রতি বরঞ্চ দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাছ থেকে দেখার সুভাগ্য হয়নি, ঠিক তেমনিভাবে তাঁদের আপন মামা ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানকেও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। বাস্তবে দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও কিন্তু জুম্ম জনগণের প্রতি তাঁর যে গভীর ভালবাসা ও প্রাণের টান এসবের জন্য তিনি দূরপ্রাচ্যে অবস্থান করলেও কাছেরই মনে হয়। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কোন জগৎ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্মভূমি থেকে সুদূর পাশ্চাত্যে বসবাস করেও জুম্ম জনগণের প্রতি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রিয় জন্মভূমির প্রতি এতো প্রেম-প্রীতি, অনুরাগ, ভালবাসা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা কোথায় থেকে পেলেন? সত্যিকার অর্থে একজন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন না হলে জাতির জন্য এমনভাবে কাজ করা অসম্ভব।
তিনি সুদূর লন্ডনে বসবাস করলেও তাঁর মন-প্রাণ পড়ে থাকতো প্রিয় জন্মভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীতল ছায়ায়। প্রিয় জন্মভূমির উপর বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়নের ভয়াবহ নির্মমতাকে আপন করে নিয়ে ছিলেন, নিজের অন্তরে লালন করেছিলেন পাহাড়ের বুকে নিপীড়িত গরীব-দুঃখী মানুষের যন্ত্রণা ও কষ্টগুলোকে। প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে আজীবন হেঁটেছিলেন, এখনও হাঁটছেন-সে পথে তিনিও একজন সুদক্ষ সহযাত্রী ছিলেন তা বলা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারকামী জুম্ম জনতা ড. দেওয়ানের অসামান্য অবদানকে যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ করবে।
জুম্ম জাতির জন্য ড. দেওয়ান তাঁর জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন। অথচ তিনি সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন, জুম্ম জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর যে দমন-পীড়ন সেটার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে তাঁর সমস্ত জীবনটাই জুম্ম জাতির জন্য উৎসর্গ করেন। একটা ভাঙাচোরা টাইপ রাইটারে রিপোর্ট তৈরি করে আন্দোলনের কাজ চালিয়ে গেছেন এবং সেই রিপোর্টগুলো আমাদের জুম্ম জাতির নিকট এক একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল। তাঁর এই দলিল আগামী দিনের জন্য আমাদের আরও অনেক কাজে দেবে। তাঁর এই গুণগত সম্পূর্ণ রিপোর্টগুলো সাবমিট করে আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী বন্ধুদের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করতে আমাদের আরও সহজ হবে।
আমাদের জুম্ম জনগণের আন্দোলনের জন্য আভ্যন্তরীণ ভিত্তি প্রধান হলেও বাহ্যিক শর্তও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশ্বের বুকে অনেক দেশ ছিল, এবং অনেক অনেক নিপীড়িত ও বঞ্চিত জাতি ছিল, যারা বর্তমান সময়ে নিজের অধিকার, নিজের স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রতা নিয়ে নিজ ভূমিতে নিরাপদে বসবাস করছেন। কারণ, তাদের অধিকারের পক্ষে এক সময় তারা বাইরের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্বের অধিকাংশ মানবতাবাদী রাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংস্থা যদি জুম্ম জনগণের আন্দোলনের পক্ষে আওয়াজ তুলে তাহলে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর শোষণের ভিত অবশ্যই নড়ে উঠবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম জারী রাখতে পারলে অবশ্যই অবশ্যই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। তাইডক্টর দেওয়ান এর লিখিত দলিলগুলো আমাদের আন্দোলনের পক্ষে অনেক কাজে লাগবে, তাঁর দলিলগুলো আমাদের সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জুম্ম তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপোষহীন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে মানুষটি বয়সের শেষ-প্রান্তে এসেও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের কাছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। জুম্ম জনগণকে সাথে নিয়ে জনসংহতি সমিতির আন্দোলন সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। জুম্ম জনগণের ঐক্য-সংহতি অটুট রাখতে পারলে এবং সবাই একসাথে কাজ করতে পারলে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জিত হবেই হবে বলে লন্ডনে সফররত জনসংহতি সমিতির সদস্যদের সামনে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।
ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ানকে আমরা যেভাবে চিনেছি এবং জেনেছি, জুম্মদের হয়ে প্রথম তিনি পা রেখেছিলেন জাতিসংঘে এবং জুম্মদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলার কাজটা তিনিই প্রথম শুরু করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক জটিল সমস্যাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবশ্যই উচ্চস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি কেবল জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি ছিলেন না, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমার সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সৎ ছিলেন, সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সুদূর যুক্তরাজ্যে থেকেও নিজের দেশ ও স্বজাতির প্রতি তাঁর ভালবাসা ও প্রাণের টান আমাদের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সবচেয়ে অনুসরণযোগ্য হল এই যে, পাশ্চাত্য সমাজ জীবনে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নিজেকে কোনদিনই সঁপে দেননি এবং পাশ্চাত্য সমাজের চারিদিকে ভোগবাদী সংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে সাধারণ মানুষের ন্যায় তিনি সাধাসিধে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
ড. দেওয়ান একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে লড়াই করে নিজেকে একজন নিখাদ জুম্ম জাতীয়তাবাদী হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছেন, অপরদিকে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অন্তরের কথা, এবং ন্যায্য অধিকার না পাওয়ার বেদনা ও যন্ত্রণার কথাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরে বিশ্বের দেশে দেশে মানবতাবাদী মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা গড়েতুলেছেন বলে আমি মনে করি। কারণ, প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা-এই দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে আদর্শগত লড়াই সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল, সেই সংগ্রামে ডক্টর দেওয়ানও একজন অন্যতম পুরোধা। এদিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তিনি কেবল জুম্ম জাতীয়তাবাদী নন, আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসেবেও আমরা গর্ব করতে পারি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জুম্মদের পক্ষে ব্রাহ্ম-অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিলেন। জুম্ম জনগণের জন্য তাঁর ত্যাগ আমাদের জুম্ম জাতির নিকট অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁচে রইবেন। জুম্ম জাতির সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করে ব্যক্তি জীবনে ড. দেওয়ান বিয়েও করেননি। জুম্ম সমাজে পাশ্চাত্য উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ক’জন ব্যক্তিই এমন ত্যাগ স্বীকার করে জাতির মুক্তির কথা ভেবেছেন, এবং সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন, তা খুঁজলে কাউকে পাওয়া যাবেনা। কেবলমাত্র ডক্টর দেওয়ানও তা করে দেখিয়েছেন।তাঁর এই অমূল্য অবদানের জন্য জুম্ম জাতি যতদিন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে, ততদিন তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ করবে।
চেতনার যেমনি মৃত্যু নেই, তেমনি ডক্টর দেওয়ানেরও মৃত্যু হয়নি। জীবিত ডক্টর দেওয়ানের চাইতে আজ মৃত দেওয়ানই অধিক শক্তিশালী হয়ে জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর মৃত্যু জুম্ম জাতির ইতিহাসে একটা বাঁক হয়ে থাকবে। কেননা, তাঁর মৃত্যু কোন সাধারণ মানুষের মৃত্যু নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের কেওক্রাডং, ফুরোমোন ও আলুটিলা পাহাড়ের চেয়েও ভারী ডক্টর দেওয়ানের মৃত্যু। জুম্ম জাতির মুক্তির আন্দোলনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন ত্যাগী মানুষ দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই। অথচ, কি ছিল না তাঁর মধ্যে? জুম্ম সমাজের মধ্যে তাঁর যশ, খ্যাতি এবং জ্ঞান, বুদ্ধি, সততা ও জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষায় অদ্বিতীয় ছিলেন। সবমিলিয়ে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে পৃথিবীতে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিন্তু তাঁর সমগ্র জীবনের অর্জন সঁপে দিয়েছেন কেবল জুম্ম জনগণের মুক্তির জন্য। কাজেই ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ান কেবলমাত্র জুম্ম সমাজের জন্য আদর্শ দৃষ্টান্ত নয়, পুরো দুনিয়ার দেশে দেশে নিপীড়িত মানুষের কাছে তিনি একজন আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন।