প্রীতিবিন্দু চাকমা
গত ২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বান্দরবানের রুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কথিত সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানায় সেনাবাহিনীর চোরাগুপ্ত হামলা পরিচালনা করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার পদবীর একজন ক্যাম্প কম্যান্ডার মারা যান এবং আরেকজন সৈনিক আহত হন। এই বন্দুকযুদ্ধে কথিত সশস্ত্র গ্রুপের তিনজন সদস্যও মারা যান বলে জানা যায়।
এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ (আইএসপিআর) পরিদপ্তর ৩ ফেব্রুয়ারি তাৎক্ষণিকভাবে এক প্রেসবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। উক্ত প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে সেনাবাহিনীর সাথে সংঘটিত উক্ত বন্দুকযুদ্ধ “সন্তু লারমা সমর্থিত জেএসএস মূল দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের” সাথে সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
পক্ষান্তরে জনসংহতি সমিতিও এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে “উক্ত ঘটনার সাথে জনসংহতি সমিতি বা সমিতির কোন সদস্য জড়িত নয়” মর্মে উল্লেখ করে আইএসপিআরের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা এবং জনসংহতি সমিতির উপর দমন-পীড়নের হীনলক্ষ্যে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে উক্ত ঘটনার সাথে জনসংহতি সমিতিকে জড়িত করা হয়েছে বলে জনসংহতি সমিতি উক্ত প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে।
সংবাদ মাধ্যমকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর আরো উল্লেখ করে যে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অনুচ্ছেদ ঘ এর ধারা অনুযায়ী সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার মাধ্যমে তৎকালীন শান্তিবাহিনী সকল সদস্যের আত্মসমর্পণের শর্ত থাকলেও জনাব সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস তা ভঙ্গ করে চুক্তি সম্পাদনের পরবর্তী সময় হতেই সশস্ত্র সন্ত্রাসী লালন করে আসছে। যদিও প্রায়শ সন্তু লারমা ও তার দল সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিচুক্তির শর্ত ভঙ্গ ও বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ করে থাকে।”
আইএসপিআরের এই অভিযোগ অনেকটা ‘চোরের মায়ের বড় গলা’-এর মতো। সেনাবাহিনী গোড়া থেকেই নিজেরাই পার্বত্য চুক্তি ভঙ্গ করে চলেছে, চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে, সর্বোপরি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে চুক্তি বিরোধী একের পর এক ষড়যন্ত্র। অথচ সেই সশস্ত্রবাহিনীর মুখপাত্র আইএসপিআর উল্টো জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছে। কি সেলুকাস!
পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্যাঞ্চলের বেসামরিকীকরণ এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা, আনসার, ভিডিপি ও এবিপিএনের সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ৫৪৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল, জনসংহতি সমিতির তথ্য মতে, উক্ত ক্যাম্পের মধ্যে তিন দফায় মাত্র ১০১টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরদিকে ২০০৯ সাল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এমনকি প্রত্যাহারকৃত অনেক ক্যাম্প পুনরায় স্থাপন করা হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে উঠে এসেছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন সময় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি স্বয়ং প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্প পুনরায় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ থেকে নি:সন্দেহে কে চুক্তি ভঙ্গ করছে কিংবা সেনাবাহিনী নাকি সন্তু লারমা চুক্তি ভঙ্গ করছে তা সহজে বুঝা যায়। মোদ্দা কথায় নি:সন্দেহে বলা যায়, সেনাবাহিনীই এখানে চুক্তি ভঙ্গ করছে। চুক্তি মোতাবেক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে সেনাবাহিনীই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
সেনাবাহিনীর এই চুক্তি বিরোধী ভূমিকা এখানেই থেমে নেই। পার্বত্য চুক্তির অন্যতম স্পিরিট ছিল পার্বত্যাঞ্চলে জনগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। এলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা, বিশেষ শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার স্বশাসন কায়েম করাই ছিল চুক্তি মূল চেতনা। কিন্তু চুক্তির এই মূল চেতনাকে লঙ্ঘন করেই সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সরকার কর্তৃক চুক্তি-উত্তর কালে ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে এক প্রকার সেনাশাসন জারি করা হয়। উক্ত ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, উন্নয়ন কার্যক্রম, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ হেন বিষয় নেই যা সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ করছে না। তাহলে কে পার্বত্য চুক্তি ভঙ্গ করছে?
পার্বত্য চুক্তিতে বিধান ছিল তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড, তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা ও উন্নয়ন, পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদসমূহ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ এনজিওদের কার্যাবলী, ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়সমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করবে। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সেই সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা ও উন্নয়ন কার্যক্রম কার অঙ্গুলী হেলনে পরিচালিত হচ্ছে? ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনীর অঙ্গুলী হেলনেই বস্তুত সেসব বিষয়াদি পরিচালিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আজ কার্যত সেনাবাহিনীর হাতে বর্গা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের (যেমন পর্যটন শিল্প) জন্যই আজ জুম্মদের হাজার হাজার একর জায়গা-জমি জবরদখল করছে, আদিবাসী জুম্মদেরকে স্ব স্ব ভূমি ও গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করছে, পার্বত্যাঞ্চলের বনাঞ্চল ও জীব-বৈচিত্র্যতা ধ্বংস করছে। তাহলে কারা চুক্তি বিরোধী ভূমিকা পালন করছে? আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা নাকি সেনাবাহিনী চুক্তি বিরোধী কাজ করছে এখানে তা আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের বিভিন্ন সময়ে ইস্যুকৃত পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম-বিদ্বেষী নির্দেশনা দেখলেই তা সহজে বুঝা যায়। গত ২৯ আগষ্ট ২০২১ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের পক্ষে মেজর এইচ এম মোহাইমিন বিল্লাহ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত এক সার্কুলেশনে জুম (হলুদ/আদা) চাষ বন্ধে পার্বত্যবাসীর জীবন-জীবিকা বিরোধী নির্দেশনা প্রদান করা হলো সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের এধরনের সর্বশেষ অপতৎপরতা। এর আগে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্যোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও বর্ণবাদী ১১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। পার্বত্য চুক্তির অব্যবহিত পর থেকে সেনাবাহিনী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে অনেক সেনা অফিসার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে থাকেন। তার অন্যতম উদাহরণ হলো ২৪তম আর্টিলারি ব্রিগেড এবং গুইমারা রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ তোফায়েল আহমেদ, পিএসসি, চাকরিরত অবস্থায় পার্বত্য চুক্তি এবং জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, যা জুলাই-আগস্ট ২০১৫ সালে দৈনিক পূর্বকোণ, বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং যায় যায় দিন ইত্যাদি জাতীয় দৈনিক প্রকাশিত হয়েছিল।
জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর সকল সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন। শান্তিবাহিনীও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে অত্রাঞ্চলে ইনসার্জেন্সী শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীই রাষ্ট্রীয় অস্ত্র শক্তির জোরে ‘শান্তকরণ প্রকল্প’ নামে চুক্তি-পূর্ব সময়ের কাউন্টার-ইনসার্জেন্সী কার্যক্রম চুক্তি-উত্তর সময়েও চালু রেখেছে। এই প্রকল্পের অধীনে সেনাবাহিনী প্রতিবছর ১০,০০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য পেয়ে থাকে। কাউন্টার-ইনর্জেন্সীর কার্যক্রম হিসেবে উক্ত খাদ্যশস্যের টাকা দিয়ে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জুম্মদের মধ্যে কিছু তাবেদারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ভরণ-পোষণ, আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে থাকে। উক্ত প্রকল্পের টাকা দিয়ে সেটেলার বাঙালিদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটেলার সংগঠনগুলোকে অর্থ সহায়তা দিয়ে চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম ও জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার মদদ দিয়ে চলেছে। তাহলে কে চুক্তি বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে? নি:সন্দেহে বলা যায় সেটা সেনাবাহিনী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা হলো রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং মুখে হলেও স্বীকার করেন। তাই এই সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু সমস্যার সেই রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান না করে কে বা কারা পূর্বের স্বৈরশাসক তথা সামরিক শাসকদের মতো ব্যাপক সামরিকায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যাকে সামরিক উপায়ে তথা দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধানের ষড়যন্ত্র করে চলেছে? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেই ফ্যাসীবাদী নীতির অনুসারী হচ্ছে দেশের দেশপ্রেমিক (?) সেনাবাহিনী। শেখ হাসিনা সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীই সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। তাই ভূতের মুখে রাম নাম মানাই না।
আইএসপিআরে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে যে, “বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর চারটি আঞ্চলিক দল হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি ইত্যাদি দুষ্কৃতিমূলক কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে পাহাড়ের নিরীহ সাধারণ মানুষের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।” কিন্তু ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি ইত্যাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্মদাতা, ইন্ধনদাতা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা কারা তা আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
পার্বত্য চুক্তি অনুসারে ১৯৯৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি জনসংহতি সমিতির প্রথম অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ইউপিডিএফ চুক্তি বিরোধী ব্যানার, ব্যানার টানানোর লম্বা বাঁশ ও অন্যান্য সামগ্রী কিভাবে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামের ভেতরে নিয়েছিল, তা একটু নিখুঁতভাবে অনুসন্ধান করলেই তা সহজেই ধরা পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো এলাকায় সেনাবাহিনীর মদদ ও গভীর ষড়যন্ত্র না থাকলেও এটা যে কখনোই সম্ভব নয়, তা সহজেই অনুমেয়। আর পরবর্তী সময়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত সেনা ক্যাম্পের লাগোয়া কালেকশন পোষ্ট বসিয়ে সেনাবাহিনী নাগের ডগায় ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, খুন ইত্যাদি সন্ত্রাসী তৎপরতা কি সেনাবাহিনীর প্রশ্রয় ও মদদ না থাকলে যে কখনোই সম্ভব নয়, তা একটি কচি শিশুরও বুঝতে বাকি নেই।
অপরদিকে সেনাবাহিনী কর্তৃক সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সদস্যদের রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং, লংগদুর তিনটিলা, দীঘিনালার বাবুছড়া, রাঙ্গামাটি জীবতলী, বান্দরবানে বালাঘাটা ও শহরে ভাড়া বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে এবং মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়ায় সশস্ত্রভাবে মোতায়েন রেখে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও চুক্তি সমর্থকসহ সাধারণ লোকের উপর সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর খোঁজে প্রায়ই নিরীহ জনগণকে হয়রানি ও নির্যাতন করে থাকে। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে জেএসএস সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঘোরাফেরা করলেও সেনাবাহিনীর চোখে ধরা পড়ে না। এ থেকে নি:সন্দেহে বলা যায় যে, সেনাবাহিনীই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে ঘোলাটে করে তুলছে।
আইএসপিআরে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো এক অদ্ভূত বিষয় অবতাড়না করা হয়েছে তা হলো, “সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ হতে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড সৃষ্টি পায়তারা করছে, যা নিঃসন্দেহে দেশদ্রোহিতার শামিল।” বস্তুত জুম্মল্যান্ড ফোবিয়া সেনাবাহিনীরই সৃষ্টি ও আবিস্কার। সেনাবাহিনীর এটা একটা ষড়যন্ত্রমূলক কৃত্রিম ভার্চুয়াল যুদ্ধ। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনরত কোন সংগঠন বা দলের এই ধরনের কোন বাস্তব রাজনৈতিক কর্মসূচির অস্তিত্ব না থাকলেও সেনাবাহিনী এটা নিয়ে ভার্চুয়ালি কাল্পনিক প্রচার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী একদিকে জুম্মদের নামে ফেসবুক ও পেইজ খুলে ভার্চুয়ালি জুম্মল্যা-ের কর্মসূচি, মানচিত্র, পতাকা, মুদ্রা, সরকার ইত্যাদি কৃত্রিম ইস্যু সৃষ্টি করে ব্যাপক প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে তার বিরুদ্ধে নানামুখী অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র করে চলেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনরত ব্যক্তিবর্গ, অধিকার কর্মী ও সংগঠনগুলোকে ক্রিমিনালাইজ করার (সন্ত্রাসী হিসেবে লেবেল দেয়ার) জন্যই সেনাবাহিনী এধরণের ষড়যন্ত্র করে চলেছে এবং এই কাল্পনিক ফোবিয়া অবতাড়নার আশ্রয় নিয়েছে। পক্ষান্তরে চোরের মায়ের মতো সেনাবাহিনীই সন্তু লারমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা বা রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে থাকে। এটাই হচ্ছে বাস্তব সত্য।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণকে অধিকার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রতারণা করা হলো। চুক্তি বাস্তবায়ন করা হলো না। প্রতারিত সেই জনগোষ্ঠী যদি ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠে তাহলে সেই জনগোষ্ঠীকে কি বেশি দোষ দেয়া যাবে? সেই জনগোষ্ঠীকে কি চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে। কখনোই নয়। চুক্তি ভঙ্গ সেই পক্ষ করছে যে পক্ষ চুক্তি করেও চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। আর সেই পক্ষ হচ্ছে সরাকার পক্ষ। সরকার পক্ষের অস্ত্রধারী বাহিনী হচ্ছে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই। তারা হচ্ছে প্রতারক, তাদের ভূমিকা হচ্ছে মীরজাফরী। প্রতারক ও বেঈমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নি:সন্দেহে প্রতারিতদের ন্যায্য অধিকার রয়েছে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরশাসক ’৭০-এ নির্বাচন দিলো। কিন্তু নির্বাচনের পর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলো না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়কে বৃঙ্গাঙ্গুলী দেখালো। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো না। তাহলে সেই প্রতারক ও বেঈমান পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের বিদ্রোহ করা কখনোই অন্যায্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। সেই জন্যই ’৭১-এ বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি-অবাঙালি (আদিবাসী) নির্বিশেষে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
২ ফেব্রুয়ারিতে বান্দরবানের বন্দুকযুদ্ধে কথিত সশস্ত্র গ্রুপের যে তিনজন সদস্য নিহত হয়েছেন, তারা যতই সন্ত্রাসী হোক না কেন, খুন-খারাপীর মতো যতই অন্যায্য ও নৃশংস কাজে লিপ্ত হোক না কেন, তারা চুক্তি পক্ষ বা চুক্তি বিরোধী কিংবা দুর্বৃত্তকামী যেই গ্রুপেরই অবৈধ অস্ত্রধারী সদস্য হোক না কেন, নিহত সেই তিনজন যুবককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুম্ম যুব সমাজ আজ জাতীয় বীর হিসেবে অভিহিত করছে। জুম্ম যুব সমাজ এই ভেবে নিজের ঝাল মিটাচ্ছে যে, নিজের প্রাণ দিয়ে গেলেও তারা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে জুম্ম জনগণের উপর শাসন-শোষণকারী একজন সশস্ত্র জালেমকে হত্যা করতে পেরেছেন, তারা পার্বত্য চুক্তি বিরোধিতাকারী ও ভঙ্গকারী একজন অস্ত্রধারীর প্রাণ কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন, রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নকারী একজন নিপীড়কের উপর প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন। জুম্ম জনগণের সাথে শাসকগোষ্ঠী তথা রাষ্ট্রীয় শক্তি যে কদর্য প্রতারনা করেছে, তার ফলে জুম্ম যুব সমাজের মধ্যে যে তুষের আগুন জ্বলছে, সেই ক্ষোভ থেকে তারা এধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে (নিহত তিনজন অস্ত্রধারীকে জাতীয় বীর আখ্যায়িত করতে) দ্বিধাবোধ করছে না।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু হচ্ছে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার অন্যতম একটি উৎস। পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের হুমকি দেখিয়ে সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে থাকে এবং একটা পর্যায়ে সেই ক্ষমতার উপর ভর থেকে সামরিক কূ করে থাকে। যার অন্যতম উদাহরণ হলো জেনারেল মঞ্জুর কর্তৃক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা। জেনারেল মঞ্জুর পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর একটি বিরাট শক্তি তার নিয়ন্ত্রণাধীন করেছিলেন এবং এক পর্যায়ে সেনা শক্তি ব্যবহার করে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক বিদ্রোহ করেছিলেন। অনুরূপভাবে সেনাবাহিনীর একটি গোষ্ঠী দ্বারা সামরিক বিদ্রোহের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেনাবাহিনীকে আস্কারা দিয়ে যে শাসকগোষ্ঠী/সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছে, সেই শাসকগোষ্ঠী/সরকারই সেই সেনাবাহিনীর অহংকার ও ক্ষমতার বুলি হয়েছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে যেমনি উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার অনেক ইতিহাস রয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতন্ত্র কখনোই সামরিক শক্তির উপর ভর করে টিকে থাকতে পারে না। গণতন্ত্র জনগণের শক্তির উপর ভর করে টিকে থাকে। ইতিহাসের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের একের পর এক শাসকগোষ্ঠী বরাবরই জনগণের শক্তির উপর নির্ভর না করে সেনাবাহিনীর শক্তির উপর ভর করে টিকে থাকার চেষ্টা করে থাকে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সেনাবাহিনীকে খুশী রাখতে ও সেনাবাহিনী লাভের খোরাক যোগাতে দেশের প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠী/সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়ে থাকে, যা এক সময় সেই শাসকগোষ্ঠী/সরকারের বুমেরাং হয়ে থাকে। আজকে বর্তমান সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পূর্বের স্বৈরশাসকদের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিকায়নের মাধ্যমে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার সমাধানের নীতি গ্রহণ করেছে, তার জন্য এই সরকারকে একদিন চড়া মূল্য দিতে হবে তা কোন সন্দেহ নেই।