হিল ভয়েস, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, চট্টগ্রাম: “আত্মকেন্দ্রিকতা, দোদুল্যমানতা ও সংকীর্ণতাবাদ পরিহার করে জুম্ম জাতীয়তাবাদী আদর্শ সুদৃঢ় করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হোন” স্লোগানে গতকাল ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যৌথ বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
পিসিপির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণ চাকমার সভাপতিত্বে বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সৌখিন চাকমা, প্রধান আলোচক বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক তাপস হোড়, বিশেষ অতিথি ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখর দত্ত, পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি এ্যানি সেন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি গৌরচাঁদ ঠাকুর প্রমূখ।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র চবি শাখার অর্থ সম্পাদক নরেশ চাকমা এবং সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেন পিসিপি’র চবি শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক নবোদয় চাকমা এবং বিদায়ী কমিটির পক্ষে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক রুমেন চাকমা। এছাড়াও সম্মেলনে পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম, পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখা, রাঙ্গামাটি শহর শাখা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভার শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বীর শহীদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৌখিন চাকমা বলেন, “জুম্ম জনগণের মুক্তির লড়াই সংগ্রামে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সংগঠন হলো লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের আন্দোলনকে আরো জোরদার করতে হবে। শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন উত্তোরনের নাম দিয়ে এখনো সেনাশাসন জারি রেখেছে যা সম্পূর্ণ পার্বত্য চুক্তির পরিপন্থী। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে।”
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তাপস হোড় বলেন, “পাহাড়ের দীর্ঘদিনের সমস্যার মুখে আজকে এই সম্মেলনে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মান-সম্মান, অধিকার ও বসতভিটা রক্ষার লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণের দিন। পাহাড় ও সমতলে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এখনো চলমান রয়েছে। পাহাড়ীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সমাজকে সামনের সারিতে এসে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা বলেন, “আত্মকেন্দ্রিকতা, দোদুল্যমানতা ও সংকীর্ণতাবাদ এই ধরনের ভুল চিন্তাধারাগুলো ছাত্র সমাজকে পরিহার করতে হবে। এই ভুল চিন্তাগুলো সংগ্রামের বাধা।” তিনি আরো বলেন, “নাইতং পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ হচ্ছে যা একাধারে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের হুমকি, আবার অন্যদিকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের স্বাভাবিক জীবনধারণেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। শাসকগোষ্ঠী অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়ায়, অধিকারের দাবি জানাচ্ছে তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছে। ছাত্র সমাজ ভুল চিন্তাধারাকে ঝেরে ফেলে জুম্মদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে।”
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা অনুধাবন করতে পারি অতীতে পাহাড়ী ছাত্র সমাজ কিভাবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম জনগণকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ভূমি বেদখল, ঘরবাড়ি তল্লাশি, অপহরণ, মিথ্যা মামলা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিনিয়ত চলমান রয়েছে। জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ধ্বংস করার জন্য শাসকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করে চলছে।” তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি এ্যানি সেন বলেন, “পিসিপি এমন একটি সময়ে সম্মেলন করতে যাচ্ছে যেসময়ে আমরা অধিকারের কথা বলতে পারি না। এদেশের সংবিধানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বাঙালী জাতীয়তাবাদকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সকল নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।” তিনি পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সংগ্রামে সবসময় পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি গৌরচাঁদ ঠাকুর বলেন, “পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সম্পর্ক নিবিড়। পাহাড় কিংবা সমতলের যেকোন অন্যায়ের প্রতিবাদী আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতে যে কোন যৌক্তিক আন্দোলনেও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পাশে থাকবে।”
আলোচনা সভার শেষে নবোদয় চাকমাকে সভাপতি, নরেশ চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও অন্তর চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ২৯ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপির চবি শাখা কমিটি গঠন করা হয়।
অপরদিকে সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি, বিনিময় চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও হ্লামিউ মারমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপির চট্টগ্রাম মহানগর শাখা কমিটি গঠন করা হয়। নবনির্বাচিত কমিটি শপথ পাঠ করান পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি কাজল চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর ও চবি শাখার সম্মেলন থেকে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ উত্থাপন করা হয়:
১. অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।
২. সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জন্য ৫% কোটা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগসহ সকল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আবাসন সংকট নিরসন, ক্যান্টিনে খাবারের মান বৃদ্ধি, গবেষণা খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধিসহ মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৫. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।