পার্বত্য চুক্তির আলোকে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে

হিল ভয়েস, ২০ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ একটি জন্মগত মৌলিক অধিকার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৭নং আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক কনভেনশনে আদিবাসীদের উক্ত অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও উক্ত কনভেনশনকে স্বীকৃতি বা অনুস্বাক্ষর করেছে। ফলে এটা বাংলাদেশের আইনে রূপান্তরিত হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে।

অপরদিকে ১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। উক্ত চুক্তি মোতাবেক ১৯৯৮ সালে সংশোধিত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনেও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। সুতরাং আইনগত দিক থেকে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ স্বীকৃত রয়েছে। এখন প্রয়োজন তাকে কার্যে রূপান্তরিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর ও উক্ত চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্তির পর প্রায় দুই য়ুগের অধিক কাল অতিক্রান্ত রয়েছে। কিন্তু সরকার বাস্তবায়ন করছে না বা পার্বত্য জেলা পরিষদের ক্ষমতায় যারা রয়েছেন তারা কার্যকর করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।

আজ বছরের পর বছর ধরে পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। যে দল ক্ষমতায় আসুক না কেন তাদের লোকগুলোকে মনোয়নয়ন দিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে মনোনীত না হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। তাদের দায়বদ্ধতা হচ্ছে ঢাকার নিয়োগ কর্তৃপক্ষের উপর। ফলে উপরওয়ালার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এজন্যেই আজ প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালুকরণ সম্ভব হচ্ছে না।

প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালুকরণের বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উপর নির্ভরশীল। এটা স্রেফ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালুকরণের দাবি করার মধ্য দিয়ে অর্জিত হতে পারে না। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আরো একটা দিক বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, পরিষদীয় ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী পদে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ করা। এটা বাস্তবায়িত না হলে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কাজ বরাবরই বাধাগ্রস্ত হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারী বিভাগীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি রয়েছেন তারা অধিকাংশ বহিরাগত। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ স্বাতন্ত্র অবস্থা, বিশেষ শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এবং এখনাকার অধিবাসীদের বিশেষ অধিকার সম্পর্কে অবহিত নন কিংবা সংবেদনশীল নন। পক্ষান্তরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুম্ম বিদ্বেষী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতারই অধিকারী। তারা কখনোই প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালুকরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে না। বরং নানা ক্ষেত্রে অতি সুক্ষ্মভাবে বাধা সৃষ্টি করে যাবে। তাই প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালুকরণের বিষয়টি চুক্তির অন্যান্য বিষয়গুলোর বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত রয়েছে।

সাধারণভাবে জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তথা মূলস্রোতধারার সংস্কৃতি সাথে আদিবাসীদেরকে অঙ্গীভূত করার প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। পাঠক্রম এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আদিবাসী শিশুদের গ্রাস করে ফেলে। এজন্য বহুভাষিক ও আন্ত:সাংস্কৃতিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন অত্যন্ত জরুরী।

সামগ্রিকভাবে ভাষাসহ জুম্ম সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন ও হুমকি রয়েছে। শুধুমাত্র একটা উদাহরণ দেবো। সেটা হচ্ছে আদিবাসী ভাষায় প্রচলিত স্থানের নাম বাংলাকরণ বা ইসলামীকরণ। যেমন ‘হ্দে মরা’কে বাংলা করা হয়েছে ‘হাতিমারা’। ‘জগনাতলী’কে বলা হয় ‘জাহানাতলী’। ‘নাহ্নাচর’কে করা হয়েছে ‘নানিয়ারচর’।‘খবংপর্য্যা’কে লেখা হয় ‘খবংপড়িয়া’। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ পাহাড় ‘তাজিনদং’কে একসময় ‘বিজয়’ নামকরণ করার চেষ্টা করা হয়। ‘ফালিটাঙ্যা চুগ’কে ‘পাকিস্তান টিলা’ নামকরণ করা হয়। রাঙ্গামাটি শহরের বুকে রাঙ্গাপানির কাছে পুলিশ লাইনের নামকরণ হয় ‘সুখী নীলগঞ্জ’। তার পাশেই রয়েছে ‘ফিলিস্তিন বাগ’ নামে একটি স্থান। এভাবে আজকে আমাদের স্থানের নামগুলিও অবলুপ্তি করা হচ্ছে। ভাষাসহ গোটা আদিবাসী সংস্কৃতিকে বিলুপ্তি পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

More From Author