বাচ্চু চাকমা
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কী। এদিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র অনাড়ম্বর বিশাল জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে “গোল্ডেন জুবলি” সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন হওয়ার কথা থাকলেও তা আজ হয়ে উঠছে না। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের একমাত্র মুক্তির সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের পরিস্থিতি দিন দিন চুক্তি-পূর্বের ন্যায় শ্বাসরুদ্ধকর, হতাশাব্যাঞ্জক, উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের বুকে যেখানে গণতন্ত্রের লেশমাত্র পাওয়া যায় যাচ্ছে না- এধরনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ, প্রতিকূল ও বৈরি অবস্থায় মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন নি:সন্দেহে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তারপরও কলমের শক্তির সহায়তায় প্রচার যুদ্ধের অংশ হিসেবে আমরা অনলাইনে কিংবা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সুবর্ণ জয়ন্তীকে অনাড়ম্বরভাবে নিপীড়িত জাতি ও মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করতে তো কোন ত্রুটি নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত, সম্প্রদায়গত নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার অবসান তথা বৈষম্যহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জন্ম হয়েছিল। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি হচ্ছে শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের পার্টি। এরই সুত্র ধরে মানব সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি সব সময়, সব ফ্রন্টে। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, সেই ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিতে-জাতিতে ও ধর্মে-ধর্মে ভেদাভেদ করে না- এমনই মানব সম্পর্কিত মহান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমাদের জুম্ম সমাজের বহু পশ্চাৎপদ, গুণেধরা সামন্তীয় চিন্তা-চেতনার উর্ধ্বে এসে জুম্ম জনগণের এই পার্টির হাল ধরতে এগিয়ে এসেছিলেন মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, শুরু করতে হয়েছে অ আ এবং এ বি একেবারেই গোড়া থেকে। হাটি-হাটি পা-পা করে শাসকগোষ্ঠীর শত-হাজারো বাধা ও চোখ রাঙানির ভয়কে জয় করে এবং শত-হাজারো রক্ত-পিচ্ছিল পথ বেয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। পাহাড়ের একমাত্র জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির সুবর্ণ জয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর উপলক্ষে সকলকে জানাই রক্তিম অভিবাদন।
আজকের এদিনে পাহাড়ের সমগ্র জুম্ম জনগণ রাখাবা শহরের প্রাণকেন্দ্রে আড়ম্বরপূর্ণ একটা পরিবেশে সুবর্ণ জয়ন্তী প্রাণভরে উপভোগ করতে পারতেন। আমি ভাবছিলাম, জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজের মনের মধ্যে সুবর্ণ জয়ন্তী কতটা প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে, একটা বিপ্লবী পার্টির দীর্ঘ ৫০ বছরের সংগ্রামে তারুণ্যের দ্রোহের ভাবনায় মূল্যায়ন কেমন হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যদি যথাযথ বাস্তবায়ন হতো তাহলে জনসংহতি সমিতির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কী বা সুবর্ণ জয়ন্তী অনন্য বৈশিষ্ট্যকে সাথে নিয়ে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের সামনে যথারীতি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আশার আলো জাগিয়ে তুলা সম্ভব হতো বলে আমি মনে করি।
আন্দোলনের ৫০ বছরের মধ্যে জুম্ম জাতীয় জীবনে পাওয়া আর না-পাওয়ার মধ্যেকার দূরত্ব ক্রমাগতভাবে কমিয়ে আনতে আমরা আরও বেশি উদ্যোগী হতে পারতাম, এবং সফলতা আর ব্যর্থতার হিসেব-নিকেশ করে ব্যর্থ-সফলতার মধ্যেকার যেটির পাল্লাটা বেশি ভারী সেদিকটা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে সচেষ্ট থাকতে পারতাম। দীর্ঘ ৫০ বছরের পর দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামের উভয় দিক আলোচনা ও সমালোচনা করে, ভুল-ভ্রান্তি শুধরাতে আত্মসমালোচনায় মনোযোগী হতে আমরা আরও অধিকতর সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতাম। জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে বিশাল অর্জনের খাতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনবদ্য একটা দলিল হয়ে জুম্ম জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধশালী করতে সহায়ক-শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারতেন।
আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অতীতের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাসে কর্মীদের লোলুপ স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে অনেক বিপ্লবীর হৃদয়ের শিহরণ জাগিয়ে তুলতে পারবে, দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে টিকে থাকার মালমশলা ও অসামান্য অনুপ্রেরণা লাভে কর্মীদের চলার পথে শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সুদীর্ঘ ৫০ বছরের গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস থেকে সক্রিয় কর্মী, লড়াইয়ের মজুত বাহিনী ও সাধারণ জুম্ম জনগণ বাস্তব শিক্ষা নিয়ে নিজেদের চেতনাকে ধারালো করার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তি ছিনিয়ে আনবেই একদিন। রাজনৈতিক গ্রামার অনুযায়ী যদি বলি, পাহাড়ের বুকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নেতৃত্ব দেবেন, পরিচালনা করবেন তাঁর সক্রিয় কর্মী বন্ধুরা এবং আন্দোলন করবেন জনগণ। সেক্ষেত্রে গোটা কর্মী ও জনগণকে অতীতের লড়াই সংগ্রামের মূর্ত ইতিহাস, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও কৌশল সমন্বয় সাধন করে আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নিপীড়িত জুম্ম জনগণের সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। এই লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জনসংহতি সমিতি অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস পাহাড়ের বুকে সৃষ্টি করেছিলেন। জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার্থে জীবন উৎসর্গ তথা আত্মবলিদানের ইতিহাসেই ভরপুর আন্দোলনের গতিপথ। বিশ্লেষণে বলা যায়, তীর অথবা ধনুক ছুঁড়তে হলে প্রথমে পেছনে বেশি করে টানতে হয়, তীর বেশি করে টেনে ছুঁড়তে পারলে সেটার গতিবেগ অধিকতর দ্রুত হয়। কাজেই ইতিহাসের পেছনে আমাদেরকে ফিরে যেতে হয়, মোঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল, ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল এবং পাকিস্তান আমল হতে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষাসহ নিজেদের স্বকীয়তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য আপোষহীন লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত ছিল।
৬০ দশক থেকে এই আন্দোলনের পুরোভাগে নেতৃত্বের হাল ধরেছেন প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। বিশেষ করে ৬০ দশকের কাপ্তাই বাঁধ জুম্ম জাতীয় জীবনের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গিয়েছিল। ৪৭-এর দেশভাগের সংকটের উপায় খুঁজতে গিয়ে পাহাড়ের বুক চিড়ে বেড়িয়ে আসে জুম্ম জনগণের একমাত্র মুক্তির দিশারী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ৬০ দশকের কাপ্তাই বাঁধ-এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে এম এন লারমা নিবর্তনমূলক আইনের অধীনে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর নিকট গ্রেফতার হন। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তিকরণের জন্য কিইবা করেননি, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ফলে লক্ষাধিক জুম্ম জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, ৫৪ হাজার একর উর্বর ধান্য জমিসহ লক্ষাধিক একর জমি কাপ্তাই জলে প্লাবিত হয়ে গেছে ও বনের গাছগাছালি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ১৯৬১ সালে ১৯০০ সালের ব্রিটিশরা বানানো আইন সংশোধন করে জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার খর্ব করা হয়েছিল, ১৯৬২-এর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে “এক্সক্লোডেড এরিয়া মর্যাদা” বাতিল করে “ট্রাইবেল এরিয়া” ঘোষণা, পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে “ট্রাইবেল এরিয়া” মর্যাদাও পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের অস্তিত্বকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী।
এরপর ১৯৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নির্বাচনে এম.এন লারমার জয়লাভ, জাতীয় সংসদে স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা তুলে ধরলে পাকিস্তান সরকারের অস্বীকৃতি-এসব বঞ্চনা ও অবহেলা এম এন লারমাকে আরও ইস্পাত-দৃঢ় কঠিন লৌহমানবে পরিণত করতে সহায়তা করে। পাকিস্তানের কারাগার এম এন লারমাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, বরঞ্চ তাঁকে যতই বাধাদান করা হয়েছে ততই পাহাড়ের বুকে অপ্রতিরোধ্য ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও অবহেলা মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে আরও অধিকতর দূরদর্শী সম্পূর্ণ করে তুলেছে। এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এহেন প্রেক্ষাপটে অধুনা বাংলাদেশ আমলে প্রথম নির্বাচনে আবারও এম.এন লারমার অংশগ্রহণ এবং বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
বাংলাদেশ আমলেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশ সংবিধানে জুম্মদের বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা, রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম এবং বিসমিল্লাহি রহমানের রহিম অন্তভুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবি-দাওয়া তথা জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকার উপেক্ষিত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এম এন লারমার নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে পুরোদমে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের একমাত্র কান্ডারী রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জন্মলাভ করে। আজ হতে দীর্ঘ ৫০ বছর আগে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই সংগঠনের জন্ম হয়। জন্মলগ্ন থেকে জেএসএস নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হতে একচুলও বিচ্যুত হয়নি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং পার্টির সদস্যরা আন্দোলন শুরু করেছেন, সেই আন্দোলনের নির্মম বাস্তবতায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, শত-হাজারো অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা ও যন্ত্রণাকে আপন করে নিয়ে জেএসএস-এর আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতিকে নিয়ে লিখতে আমরা গর্ববোধ করি একারণে যে, মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমার সুদক্ষ নেতৃত্বে আজও আপোষহীন লড়াই সংগ্রাম পাহাড়ের বুকে চলমান রয়েছে। এই বছরে ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণ জয়ন্তী অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপন করার কথা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও কঠিন বাস্তবতায় সুবর্ণ জয়ন্তী যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি জুম্ম জনগণের অনুকূলে থাকতো, তাহলে বহুদিন পর সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন মধ্য দিয়ে আমাদের কর্মী বন্ধুরা ও সাধারণ জনগণ মিলিত হয়ে সংগ্রামের ময়দানে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগিয়ে পরস্পরের হৃদয় জুড়ে একধরণের সুখের অনুভব তথা ভালবাসার মিলন উৎসবে মেঠে উঠতে পারতাম। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস, ফেলে আসা অতীতের সংগ্রামের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও অনেক সুখ-স্মৃতি এবং শত-শত বীর সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা ও যন্ত্রণার চাপা গোঙানির রূঢ় বাস্তবতাকে মনে করিয়ে নিজেই কিছুক্ষণের জন্য হলেও আন্দোলিত ও উদ্বেলিত হয়ে যেতাম।
দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র আন্দোলন সংগ্রামের সময় পরস্পরের মধ্যে কত ঝগড়াঝাটি আর কত মান-অভিমান, আর কত সুখ-স্মৃতি, কত হাসি, গানে জোয়ানের ভরপুর উচ্ছল প্রাণ ছিল। প্রাণের প্রাণ মেলাতে ছুটে যাওয়া সেই ৭০ দশকের জুম্ম তরুণ আজও স্বপ্নের বিশাল সিঁড়ি বেয়ে সংগ্রামের রক্ত-পিচ্ছিল পথ চলতে সাহস করে। সেই টগবগে তারুণ্যের সময়ে পার্টিতে যুক্ত হওয়া তরুণটি আজ প্রবীণের ভরপুর। আজকের এদিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির “সুবর্ণ জয়ন্তী” যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হত, তাহলে সেই তরুণ বয়সে যুক্ত হওয়া একজন শান্তিবাহিনীর গেরিলা বন্ধুর অনেক অপ্রকাশিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, কৌশল ও অনন্য স্মৃতিগুলো স্মরণে এসে পরস্পরের সাথে শেয়ার করতে পারতেন।
অতীতের গৌরবময় সংগ্রামের সম্যক জ্ঞানের ইতিহাস তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে তাঁদের লড়াই সংগ্রামের সাথী হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাতেন। তবে এটাই বাস্তব সত্য, ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক সোহাগ মিশ্রিত শাসন, সেই প্রিয় অগ্রজরা কত যে আপন ছিলেন তা হারানোর পর আরও বেশি গভীরভাবে অনুভব ও উপলদ্ধি করা যায়। আন্দোলনের সময়ে তাদের মধ্যে বিশেষ করে খন্ড-খন্ড লড়াইয়ে জয় পরাজয় নিয়ে কত যে কথা হত, তারপর যুদ্ধের জয় কিংবা পরাজয় শেষে কর্মী সূলভ কিংবা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তথা আদর্শগত সম্পর্ক নিয়ে তা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিষয়টাকে মূল্যায়ন ও বিচার-বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে ভুল এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সর্বদাই সচেতন থাকতেন। ইস্পাত-দৃঢ় কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও কত সফলতা, কত ব্যর্থতা ছিল, তারপরেও পার্টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে এবিষয়গুলো সহজে মানিয়ে নিতে পেরেছেন জনসংহতি সমিতির সদস্যরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সক্রিয় সদস্যরা জুম্ম জনগণের আশ্রয়ে থেকে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন, দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে যাত্রা শুরু করা হয় মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে।
এই লড়াই সংগ্রামে কত নদী, ঝিরি-ঝর্ণা, পাহাড়-পর্বত, আঁকাবাঁকা সুরু গিরিপথ অতিক্রম করে শুরু হয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রাম। পাহাড়ের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে শুরু হয় লড়াইয়ের এই দীর্ঘযাত্রা। ৭৫-এর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে মৃত্যু হওয়াতে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয় এবং সাথে সাথে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা বিকল্প পথে হাঁটতে জনসংহতি সমিতি বাধ্য হয়। সেই সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের সময় শাসকগোষ্ঠীর দোসর তাবেদার বাহিনীরা যখন রাতে ঘুমাতেন তখন জেএসএস-এর অতন্দ্র প্রহরীরা ছুটে যেতেন পাহাড়ের এক প্রান্ত হতে অপরপ্রান্তে, সংগ্রামের পথে অনেক নদী, পাহাড়, ঝিরি-ঝর্ণা, আঁকাবাঁকা সুরু গিরিপথ, বন-জঙ্গলের বিরাট প্রাকৃতিক বাধা পেরিয়ে লক্ষ্য জয়ের পথে এগিয়ে যেতেন পার্টির অগ্রগামী সদস্যরা। জেএসএস-এর প্রিয় অগ্রজরা সক্রিয় অবস্থানে থেকে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর দুর্বল দিকটাতে আঘাত করতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকতেন।
সমগ্রকে জয় করতে প্রত্যেকটি খন্ড যুদ্ধ বিজয়ী হওয়ার প্রয়োজন নেই, দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের সময় তা অবশ্যই মনে রাখতেন তারা। তারই প্রেক্ষাপটে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর দোসরদের নির্মম পাশবিকতার হাত থেকে জুম্ম জনগণকে মুক্ত করতে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা আত্মবলিদানের জন্য সবসময় প্রস্তুত ছিলেন। তাই আজকের পার্টির সুবর্ণ জয়ন্তী হতে পারতো পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের আশা-আকাংখা ও লক্ষ্য পরিপূরণের একটা সিঁড়ি হিসেবে, চারিদিকে বিভিন্ন রঙের ফেস্টুন, ব্যানারে সুসজ্জিত করে জিমনেসিয়াম মাঠ প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্বোধন করতেন আমাদের জুম্ম জনগণের প্রিয়নেতা সন্তু লারমা। হাজারো নিপীড়িত জুম্ম জনগণের সমাগমের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির এই অনন্য সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করা হত, এম এন লারমার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অর্জন, এবং বর্তমান নেতা সন্তু লারমার জীবদ্দশায় তা প্রাণভরে উপভোগ করে যেতে পারতেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সুবর্ণ জয়ন্তী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করতে না পারাতে জুম্ম জনগণের বেদনা হৃদয়ের অন্তরালে তুষের আগুন হয়ে ঢাউ-ঢাউ করে জ্বলছে, সেই বেদনা ও যন্ত্রণাকে জুম্ম তারুণ্যকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে হবে। জুম্ম জনগণের একমাত্র কান্ডারী সংগঠন জেএসএস-এর আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে অজেয় হয়ে উঠুক-সুবর্ণ জয়ন্তীর এদিনে কামনা করি যেন তাই হয়।