হিল ভয়েস, ২ জানুয়ারি ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: বিগত ২০২১ সালের বিভিন্ন সময়ে সেনা-আওয়ামীলীগ মদদপুষ্ট মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অপরহণ করে কিংবা ফোনে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে রাজস্থলী ও কাপ্তাই এলাকার কেবল ১৪ জন ব্যক্তি থেকে মোট ১.১৫ কোটি টাকা চাঁদা ও মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করেছে। কাপ্তাই জোনে নিয়োজিত ২৩ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মগপার্টি সন্ত্রাসীরা এসব চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৪ জনের কাছ থেকে ১.১৫ কোটি টাকা আদায় ছাড়াও মগপার্টি সন্ত্রাসীরা নিরীহ গ্রামবাসী, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রার্থী ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক লক্ষ লক্ষ টাকার চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় যে, সেনা-আওয়ামীলীগ মদদপুষ্ট মগপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ২০২১ সালের বিভিন্ন সময়ে (১) গাইন্দ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যন উথান মারমা থেকে ১০ লক্ষ টাকা, (২) রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য নিউচিং মারমা থেকে ২ লক্ষ টাকা, (৩) পোয়াইতু মৌজার হেডম্যান উথিনসি মারমা থেকে ৭ লক্ষ টাকা, (৪) প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সরকারী কর্মচারি চুক্যউ মারমা থেকে ২ লক্ষ টাকা, (৫) গাইন্দা ইউনিয়নের মহিলা মেম্বার ওয়াইম্রাচিং মারমা থেকে ৫০ হাজার টাকা, (৬) সরকারি কর্মচারি রনি খিয়াং থেকে ৫০ হাজার টাকা, (৭) গাইন্দ্যা ইউনিয়নের সেক্রেটারী চাথোয়াই মারমা থেকে ৫০ হাজার টাকা, (৮) চিংথোয়াইউ মারমা, ম্রওয়া পাড়া থেকে ৩ লক্ষ টাকা, (৯) রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অংনুচিং মারমা থেকে ২ লক্ষ টাকা, (১০) ভালুক্যা তিনছড়ি পাড়া জনৈক ব্যক্তি থেকে ৫৪ লক্ষ টাকা, (১১) বাঙালহালিয়ার কাঙারাছড়ির বাসিন্দা পুচিমং মারমা থেকে ২৫ লক্ষ টাকা, (১২) রাইখালী ইউনিয়নের নারানগিরি পাড়ার চনুমং মারমা থেকে ৩.৫ লক্ষ টাকা, (১৩) একই ইউনিয়নের গবছড়ার মিরাঙ্গ তঞ্চঙ্গ্যা থেকে ৬০ হাজার টাকা এবং (১৪) মিথোয়াই রাখাইন থেকে ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা বা মুক্তিপণ আদায় করেছে।
সূত্রে জানা যায় যে, গাইন্দ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যন ও জনসংহতি সমিতির রাজস্থলী থানা কমিটির সদস্য উথান মারমাকে মগপার্টি সন্ত্রাসীরা গাইন্দ্যা ইউনিয়নের পোয়াইতু পাড়াস্থ তাদের আস্তানায় ফোনে ডেকে নিয়ে বন্দী করে রাখে এবং মুক্তিপণ হিসেবে তার থেকে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করে। পরে ১০ লক্ষ টাকার বোঝাপাড়া হলে উথান মারমাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
অন্যদিকে মগপার্টির সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য নিউচিং মারমা থেকে ২ লক্ষ টাকা আদায় করে। নিউচিং মারমা হচ্ছেন রাজস্থলী আওয়ামীলীগের মধ্যে রাজস্থলীর সভাপতি ও রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান উবাচ মারমার প্রতিপক্ষ। তাই উবাচ মারমার মদদে নিউচিং মারমা থেকে মগপার্টির সন্ত্রাসীরা উক্ত চাঁদা আদায় করে নেয়।
পোয়াইতু মৌজার হেডম্যান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান উথিনসি মারমাকেও ফোনে পোয়াইতু পাড়ায় ডেকে নিয়ে মগপার্টির সন্ত্রাসীরা বন্দী করে রাখে। তাকে এমনভাবে বেঁধে রাখা হয় যেখানে বসাও নয়, আবার দাঁড়ানোও নয় সেভাবে তাকে রাখা হয়। মগপার্টির সন্ত্রাসীরা তাকে মৃত্যুর হুমকি দেয়। পরে ৭ লক্ষ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
মৃত্যুর হুমকি দিয়ে মগপার্টির সন্ত্রাসীরা পোয়াইতু পাড়ার অধিবাসী ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সরকারি কর্মচারি চুক্যউ মারমা থেকে ২ লক্ষ টাকা, গাইন্দা ইউনিয়নের মহিলা মেম্বার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সদস্য ওয়াইম্রাচিং মারমা থেকে ৫০ হাজার টাকা, উপজেলা একাউন্ট অফিসের সরকারি কর্মচারি রনি খিয়াং থেকে ৫০ হাজার টাকা, গাইন্দ্যা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব চাথোয়াই মারমা থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে নেয়।
জনসংহতি সমিতির সাথে যোগাযোগ রয়েছে এই অভিযোগ তুলে এবং মৃত্যুর হুমকি দিয়ে মগপার্টি সন্ত্রাসীরা গাইন্দ্যা ইউনিয়নের ম্রওয়া পাড়া চিংথোয়াইউ মারমা থেকে ৩ লক্ষ টাকা এবং রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অংনুচিং মারমা থেকে ২ লক্ষ টাকা জোর করে আদায় করে নেয়।
কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের ভালুক্যা তিনছড়ি পাড়া জনৈক গ্রামবাসী থেকে ৫৪ লক্ষ টাকা আদায় করে নেয় মগপার্টির সদস্যরা। উক্ত ব্যক্তি গ্রামের একজন ধনী ব্যক্তি ও সেগুন বাগানের মালিক। সেগুন বাগান বিক্রি করে তিনি সেসময় কোটি টাকা পেয়েছিলেন। সেই খবর পেয়ে মগপার্টি সন্ত্রাসীরা রাতে তার বাড়ি ঘেরাও করে। কিন্তু তিনি কোনক্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাকে না পেয়ে সন্ত্রাসীরা তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে ৫৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তার ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। অন্যদিকে বাঙালহালিয়া ইউনিয়নের কাঙারাছড়ি গ্রামবাসী পুচিমং মারমা থেকে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে সন্ত্রাসীরা ২৫ লক্ষ টাকা করে নেয় বলে জানা যায়।
রাইখালী ইউনিয়নের নারানগিরি বড় পাড়াবাসী চনুমং মারমাকে অপরহরণের পর পাড়ার কার্বারী ও আত্মীয়স্বজন অপহরণকারীদের সাথে দেখা করতে গেলে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা বিনিময়ে মগপার্টির কবল থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা হয়। মিরাঙ্গ তঞ্চঙ্গ্যাকেও অপরহণের পর কার্বারী ও আত্মীয়স্বজন দেখা করতে গেলে ষাট হাজার টাকার মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের কাঙারাছড়ি গ্রামের মিথোয়াই রাখাইন নামে এক বাঁশ ব্যবসায়ীকে অপহরণের দুই দিন পর ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের মদদে মগপার্টি সন্ত্রাসীরা লক্ষ লক্ষ টাকার চাঁদাবাজি করে।বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করার জন্য মগপার্টির সন্ত্রাসীরা চেয়ারম্যান প্রার্থী থেকে ২ লক্ষ টাকা করে এবং মেম্বার প্রার্থীদের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করে এবং অন্যান্য চেয়ারম্যান-মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে হুমকি দিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে।
ফলে রাজস্থলী উপজেলাধীন গাইন্দ্যা ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। মগপার্টির হুমকিতে এই দুই ইউনিয়নে কেউ চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে সাহস করেনি। গাইন্দ্যা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডেও মগপার্টির চাঁদাবাজির কারণে কেউ সদস্য পদে নির্বাচন করেনি। ফলে প্রার্থী না থাকায় ২নং ওয়ার্ডের কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১, ২ ও ৩ ন ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনেও কোন প্রার্থী দাঁড়ায়নি। মগপার্টির হুমকির কারণে বাঙালহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বেশির ভাগে ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে পোয়াইতু পাড়ায় মগপার্টি সদস্যদের ঘর নির্মানের জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিটি পরিবারকে বিনা পারিশ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কোন পরিবার থেকে লোক দিতে না পারলে সেই পরিবারকে দৈনিক ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।