অংম্রান্ট অং
অতি সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং যমুনা টিভিতে এক বক্তব্য দেন। যা যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখা গেছে। এক, এই বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ টেনে এনে এবং বিশ্বের কোন কোন দেশে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয় নাই তা কষ্ট করে খুঁজে বের করে মাত্র দুটি দেশ আয়ারল্যান্ড ও নেপালের উদাহরণ দিয়ে সারা বিশ্বের একই সাধারণ অবস্থা বানিয়ে নিলেন।
এখানে লক্ষ্য করুন, বীর বাহাদুরের এই বক্তব্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার বা তার সদিচ্ছা ও দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক প্রকাশ পেয়েছে? চুক্তির শর্তে বা চুক্তি ধারার অধিকার অনুযায়ী তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী দেওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দীর্ঘদিনের দাবি এবং আন্দোলনও করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয় একটি কর্মকে (যেমনঃ সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) নিয়ে নয়, দেশের একটি বিশেষ অঞ্চলকে নিয়েই এই মন্ত্রণালয়। যে চুক্তির শর্তে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন সেই চুক্তিতে তো আরো শর্ত/ধারা রয়েছে। মন্ত্রী হয়ে তিনি দেশের অন্যান্য মন্ত্রীদের মতো উন্নয়নের কথা বলেন এবং বলে থাকেন। কিন্তু যে অঞ্চল ও যে অঞ্চলের জনগণকে দেখাশোনা, যত্ন নেওয়া এবং তাঁদের কল্যাণে কাজ করার কথা (যেসব দায়িত্ব-কর্তব্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বা শান্তি চুক্তিতে লেখাও রয়েছে) সে ব্যাপারে কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চুক্তি বা চুক্তির শর্তকে পদদলিত করা অথবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চরিত্র তাঁর মধ্যে অধিকতর পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। এতে ‘যে থালায় ভাত খেত, সেই থালায় মূত্রপাত করার’ মতো হলো না? আর চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার বা বীর বাহাদুরের সদিচ্ছা ও দৃষ্টিভঙ্গি যদি থেকে থাকে তাহলে তিনি ইতিবাচক উদাহরণ তুলে না ধরে কষ্টসহকারে ইউরোপ মহাদেশ থেকে নেতিবাচক উদাহরণ তুলে ধরলেন কেন? তিনি ভারতের মিজোরামের উদাহরণ তো আনতে পারেন। যে নেপালের উদাহরণ দেখালেন সেই চুক্তি কি পার্বত্য অঞ্চলের মতো একটি অঞ্চল বা স্বতন্ত্র বৈচিত্র্যতাসম্পন্ন জাতিসত্বার সাথে করা চুক্তি? আর তিনি নেপালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কতটুকু জানেন, যেখানে তিনি একেবারেই সরাসরি বলে দিচ্ছেন নেপালের চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি বলে? এসব গোঁজামিল উদাহরণ তৈরি করে নেতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরার উদ্দেশ্য কি? বীর বাহাদুরের বক্তব্য থেকে যে কেউ সহজেই সমাধান টানতে পারবেন যে, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের কোন সদিচ্ছা নেই বলেই এভাবে নেতিবাচক উদাহরণ তুলে ধরেছেন মন্ত্রী বীর বাহাদুর।
দুই, মাননীয় মন্ত্রী বীর বাহাদুর বলেছেন, “চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্ব হলে খুন করবেন সেটা তো চুক্তিতে লেখা নেই।” তাই যদি হয়, তাহলে যেটা লেখা আছে ঠিক সেই রূপে অথবা সেই অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন করে যাওয়া হচ্ছে না কেন? কেন চুক্তি বাস্তবায়নে নানা প্রকারের টালবাহানা করা হয়? বিশ্বে আজকের আয়ারল্যান্ড, নেপালের উদাহরণ অবতারণা করে বীর বাহাদুর মহোদয় বস্তুত চুক্তি বিরোধী পক্ষকে উস্কে দেওয়া চেষ্টা করেছেন এবং চুক্তি বিরোধীদের অবস্থানকে সমর্থন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এখানে মন্ত্রী বীর বাহাদুর ‘দেরি হলে’ বলে একটা সময়ের কথা বলেছেন। মাননীয় মন্ত্রী আপনার নিকট প্রশ্ন, ধরুন সেই ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কতো বছর? ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় চার বছরের অধিক সময় পেয়েছিলেন। বিএনপি শাসনামলের কথা বাদই দিন। আবার ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটানা কতো বছর আপনার দল এবং আপনারা ক্ষমতায় আছেন? চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৪টি বছর (যা বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরের অর্ধ সময়) বা বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের ১২টি বছর অতিক্রান্ত হলেও বীর বাহাদুর মহোদয় ‘দেরি’ বলে মনে করছেন না, তাহলে এই চুক্তি বাস্তবায়নে আর কতোটা সময়ের প্রয়োজন?
পার্বত্য চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো বাস্তবায়ন না হচ্ছে বলে চুক্তির আরেকপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভিযোগ করে আসছে। দিনদিন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য’ হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের আদিবাসীরা প্রান্তিকতা থেকে আরো প্রান্তিকতায় চলে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী, আদি ও স্থায়ী বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেয়ে অস্থায়ী ও সেটেলার বাঙালি জনগোষ্ঠী জনসংখ্যায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। মন্ত্রী মহোদয়, আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনতাত্ত্বিক অবস্থার বিষয় ভেবে দেখেন কিনা জানি না। এ অবস্থায় চুক্তি বাস্তবায়িত হতে বিলম্বিত হওয়াকে যদি আপনি অবান্তর মনে করেন, বা আপনার মনে উদ্বেগ না আসে, অথবা আরো অধিক অধিক সময় বিলম্বিত হওয়ার পক্ষে ওকালতি করেন তাহলে পঞ্চাশ বা শত বছর পর পার্বত্যাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য কেমন দাঁড়াবে? তখন চুক্তি বাস্তবায়ন অধিকতর সহজ হয়ে যাবে কি?
সেইসাথে মন্ত্রী পার্বত্যাঞ্চলের সমস্ত খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজির দায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মাথায় চাপিয়ে দিয়ে এবং ন্যাকামির আশ্রয় নিয়ে চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের স্বার্থে নিজে খুন হতে ইচ্ছার কথা বললেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যরা চুক্তি বিরোধী, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এবং মগপার্টির সশস্ত্র সদস্যদের খুন-অপহরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট মামলায় জড়িত হচ্ছে, তাদেরকে ঘর-সংসার ও এলাকা ছেড়ে যেতে হচ্ছে; সেসমস্ত বিষয় তো আপনি ভুলেও মুখে আনেননি,সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন।
মাত্র কিছুদিন পূর্বে মন্ত্রীর রবার বাগানের পার্শ্ববর্তী চেমিডলু পাড়াতে নিজ বাড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বান্দরবান জেলা কমিটির সদস্য ও বান্দরবান সদর থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পুশৈথোয়াই মারমা মগপার্টির হাতে নৃশংসভাবে খুন হলো সেই বিষয়টি মন্ত্রীর মনে থাকলো না। তার মাস দুয়েক আগে বান্দরবানের কুহালং ইউনিয়নের ক্যমলং পাড়ায় উগ্য মারমা নামে এক নিরীহ ফার্মেসি দোকানদার মগপার্টি কর্তৃক অপহৃত ও খুন হলেন। এসব ঘটনা মন্ত্রী মোটেই জানেন না বলে মনে হলো। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ লোকজন সংস্কারপন্থী, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এবং মগপার্টির সশস্ত্র গ্রুপের হাতে খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে সেগুলোকে মন্ত্রী কিছুই মনে করলেন না। এ সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে নিরাপত্তার নামে সেনাবাহিনী লালন-পালন করে যাচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় এই সশস্ত্র গ্রুপগুলো রয়েছে মন্ত্রী কিছুই জানেন না, বুঝেন না ভান ধরে ধূর্তামি করলেন।
তিন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য আলোচনা-পর্যালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমান করার যুক্তি মন্ত্রী বীর বাহাদুর তুলে ধরেছেন। সরকারের সাথে চুক্তি হওয়ার পর থেকে চব্বিশ বছরের অধিক সময় ধরে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলন, বিতর্ক, অভিমান, অভিযোগ, দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের আলোচনা ও আহ্বান মাননীয় মন্ত্রী কি দেখেন নাই, শুনেন নাই? তিনি কি সম্পূর্ণ নতুন, সবেমাত্র নরক থেকে উঠে এসেছেন?
তাছাড়া চুক্তির ধারা বা শর্ত মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েছেন। চুক্তির ধারায় বলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় হবে এবং ঐ মন্ত্রণালয়ে একজন উপজাতি মন্ত্রী হবেন’। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে উপজাতি মন্ত্রীও বলা চলে। সেই হিসেবে মন্ত্রী বীর বাহাদুর, বয়সের দিক দিয়ে কম বা ছোট হতে পারে; কিন্তু দায়িত্বের দিক দিয়ে আপনি উপজাতিদের মধ্যে সবার উপরে, সবার বড়। আপনার যুক্তি বা শিক্ষা অনুযায়ী আপনি চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে কখনো তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমান করেন না কেন? দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে আপনি বিভিন্ন ক্ষমতা ভোগ করেছেন এবং এখনো ক্ষমতা ভোগ করে চলেছেন উপজাতি হিসেবে।
এতো বছরগুলোতে আপনাকে চুক্তির বাস্তবায়ন ব্যাপারে জাতীয় সংসদে আলোচনা-পর্যালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমান করতে অধম উপজাতিরা একবারও দেখতে-শোনতে পেল না কেন? আপনি যদি নিজেকে উপজাতি মন্ত্রী মনে না করে থাকেন তাহলে উপজাতি মন্ত্রীর চেয়ারে বসেন বা বসে থাকেন কেন? আপনি যে গাছের ফল খান, যে গাছের ছায়ায় আরাম ভোগ করেন; সেই গাছকে শক্তিশালী করার কোনো চেষ্টা তো উপজাতিরা দেখতে পায় না! এসব আপনার স্ববিরোধী চরিত্র নয় কি? মারমা সমাজে একটা ঘৃণ্য চরিত্র আছে, তা হলো ‘আচাঃরাগা-কোরোয়াই (খাবো-দায় নেবে না)’। মন্ত্রী, আপনি সেই চরিত্রের মূর্তরূপ নয় কি? চুক্তির সুফল ভোগ করবেন, কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের দায় নেবেন না এটা কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের চরিত্র হতে পারে না।
চার, অস্ত্রে ঝনঝনানি ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নিরাপত্তাবাহিনীর দায়িত্ব আছে বলে মন্ত্রী বীর বাহাদুর যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। একটা বিষয় লক্ষ্য করার দাবি রাখে যে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা বলে দশকের পর দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জারি রাখা হয়েছে। বাস্তবে লক্ষ্য করুন, সেনাশাসনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রের ঝনঝনানি বা অবৈধ অস্ত্র কমে গেছে নাকি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে? এটা কি প্রমাণ করে না অস্ত্রের দ্বারা সমস্যা সমাধান নয়? দেশের গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে দেখা যায় সেনাবাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। কিন্তু বাস্তব তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এমন অস্ত্র উদ্ধার ঘটনা অনেকগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন কায়েম রাখা, বৈধতা অর্জনের অপচেষ্টা এবং দেশবাসীকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর এক একটি নাটক ও কারসাজি। তার প্রমাণ মেলে সেনাক্যাম্পের অনুমতি নিয়ে এবং বনের জীবজন্তু কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য পাহাড়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি বন্দুক এবং ভিনদেশী বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করা অস্ত্র উদ্ধারের নাটক।
আরো লক্ষ্য করা যায়, মগপার্টি, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারের সশস্ত্র গ্রুপগুলো সেনাক্যাম্প, সেনাজোনের আশেপাশে ঘাঁটি গেড়ে আছে, তাদের সশস্ত্র সদস্যরা শহরে, গ্রামে এবং সেনাক্যাম্পের আশেপাশে ঘোরে, চাঁদাবাজি করে, অপহরণ করে ও খুন করে – সেগুলোতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে সেনাবাহিনী যায় কেন? এগুলোর প্রতি মন্ত্রীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় কেন? শোনা যায় মগপার্টি, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি থেকে সেনাসদস্যরাও ভাগ বসায়। এসমস্ত বিষয়গুলি মন্ত্রীর তো অজানা নয়।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে অসহায় দুঃস্থ ও গরীব আদিবাসীদের বিভিন্ন লোভে ফেলে নতুনভাবে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, ইসলামিকরণ করা হচ্ছে। এসব কাজে সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা আছে এবং সেনাবাহিনী তাঁদের রক্ষা করে চলেছে। এগুলোতে মন্ত্রীর দৃষ্টি নেই কেন? সেনাবাহিনীকে তুষ্ট করে চলা কি মন্ত্রীর কাজ?
পাঁচ, পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকটি আঞ্চলিক দল হয়ে যাওয়াকে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। সেই প্রেক্ষিতে অবশ্যই বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই এসব সমস্যাগুলো উদ্ভব হয়েছে। একটি ঘটনা লক্ষ্য করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পার্বত্য বান্দরবান জেলাতে সেনা প্রহরায় জেএসএস (সংস্কার)-কে নিয়ে আসা হয়। কয়েকমাসে পরে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে সংস্কারের বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যা ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতিসহ কয়েকজন মারা যায়। সেই মামলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাঘমারা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মংপু হেডম্যানসহ আরো অনেকজকে ঐ মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। মামলাটি করানো হয় সংস্কারের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমাকে দিয়ে।
উক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে বান্দরবানে নিয়ে আসার খবর সাংবাদিক এবং সদরে সচেতনমহল জানতে পারে। তাঁরা ঐ সংগঠনকে বান্দরবানে নিয়ে না আসার জন্য মতামত ব্যক্ত করে। এর কয়েকদিন পর দেখা যায় মংপু হেডম্যানকে সভাপতি করে বান্দরবান জেলা কমিটি দাঁড় করানো হয়েছে। বর্তমানে ঐ সংগঠনের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ঐ উবামং নিজেই। এটি করলো বান্দরবানের চাকরিরত সেনাবাহিনী এবং ডিজিএফআই।
পার্বত্যাঞ্চলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে দায়িত্ব ও ক্ষমতা না থাকার কারণে এমন হতে পেরেছে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের যথাযথ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এসব কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে না। এছাড়া পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায় যে, দল ভাঙ্গা ও গড়ার পেছনে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের স্পষ্ট হাত রয়েছে। ঐ দলগুলোকে সেনাবাহিনী লালন-পালন করে চলেছে, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজি করাচ্ছে; যাতে আদিবাসী জনসাধারণ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়, অসংগঠিত হয় এবং সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থাকতে বাধ্য হয়।
আরো লক্ষ্য করা যায়, চুক্তি দল ভেঙ্গে পরার ব্যাপারে মন্ত্রীর বক্তব্যে হতাশা ও আপসোসের সুর ফুটে উঠেছে। এটি চুক্তি বাস্তবায়নে মন্ত্রীর অনিচ্ছার ব্যাপারে প্রকৃত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, নয় কি? মন্ত্রী কেন চুক্তি বিরোধীদের শক্তিশালী অবস্থান চান, তা চুক্তি বাস্তবায়নের আরো বিলম্ব করা বা চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বানচালের জন্য, নয় কি?
ছয়, শেষে মন্ত্রী মাথা নেড়ে নেড়ে তাদের উন্নয়নের ফিরিস্তি উল্লেখপূর্বক নিজের মাহাত্ম্য তুলে ধরতে সচেষ্ট হলেন। প্রকারান্তরে তা জনসাধারণকে উপহাসের সামিল হলো। উন্নয়ন একটি দেশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সব দেশে, সর্বকালে সরকার তার দেশ উন্নয়নের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে থাকে। এরশাদের আমলে উপজেলা ব্যবস্থা চালু করে সমস্ত উপজেলাতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে থাকে এবং উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে প্রশাসনকে মানুষের দ্বোরগোড়ায় নেয়া হয়েছে। সেই ভিত্তির উপর অন্যান্য সরকারগুলো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। বিএনপির আমলেও বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলা বাদে অন্যান্য উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিভিশন কি আপনারা নিয়ে এসেছেন? ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই পার্বত্য জেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করা হয়। কোনো দেশ কি এক জায়গায় বসে থাকে?
মন্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়ে কথা বলেছেন। কিন্তু ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক আছে কিনা, ছাত্রছাত্রীরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে কিনা – তা বললেন না কেন? মানসম্মত শিক্ষা না পেলে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী হতে না পারলে এ-যুগে কোনো প্রতিযোগিতামূলক স্থানে টিকতে পারে না। জীবনকে দিশাহারা করে। তাহলে বুঝতে বাকি নেই যে, আপনার বা আপনাদের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দেওয়া শুধু নির্বাচনে ভোট পাওয়ার উদ্দেশ্যে, মানব উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নয়।
মন্ত্রী আয়-রোজগার বেড়ে যাওয়ার কথা বললেন। কিছু চাকরিজীবী, দুই-একজন ঠিকাদার ব্যতীত কারো জীবনযাপনের অবস্থা ভালো নেই। পাহাড়ে আদিবাসীদের মধ্যে কর্মসংস্থান বা জীবনযাপনের ও জীবনের মান কতটুকু বেড়েছে তার অনুসন্ধান কি আপনি চালিয়েছেন? এখনো শীতকালে একটা দেড়শো টাকার কম্বল পাওয়ার জন্য লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে, লোকজন নিজের চিকিৎসা করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য অন্যদের সামনে হাত পাততে হয়। পানীয় জলের জন্য এখনো প্রাকৃতিক ছড়া-ঝর্ণার উপর নির্ভরশীল। যথাযথ টিকাদানের ব্যবস্থা না থাকায় এযুগেও পার্বত্যাঞ্চলে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। মুখস্থ বা মনগড়া কথা বলতে আপনার লজ্জা করে না? আপনি কি মানুষে আছেন? চোর মায়ের বড়ো গলা, শিয়ালের ডাক হুক্কাহুয়া!
যে কোনো বক্তব্য বা কাজের স্থান-কাল-পরিস্থিতির সম্পর্কিত হয়ে থাকে। সময়ের প্রেক্ষিতে মন্ত্রীর বক্তব্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। পার্বত্যবাসী ও দেশবাসী বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছে যে, চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৫ম বৈঠকের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সময়ে এসে বিশ্বের কোন কোন দেশে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি তা অতিকষ্টে খোঁজে বের করে এনে টিভিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী তুলে ধরা, চুক্তি বিরোধী পক্ষকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা; তাঁর উদ্দেশ্যে কি? তিনি কি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বানচাল করতে চান?
মন্ত্রীকে দেখলাম তিনি পার্বত্য জেলার প্রতিনিধি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী অথবা উপজাতি মন্ত্রীর মতো নয়। তাঁর কথাবার্তায় অসহায়, অধিকারহারা, বঞ্চিত-নিপীড়িত পাহাড়ের আদিবাসী দুঃখকষ্টের কথা ফুটে ওঠে নাই। তাঁকে মনে হয়েছে তিনি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি এবং সেটেলার বাঙালিদের প্রতিনিধি ও তাঁদেরই মন্ত্রী।