এম সি বিশাল
ভোটের রাজনীতিতে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ভোটচুরির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামীলীগ সরকার সমগ্র দেশের জনগণকে এখন “উন্নয়ন” নামক এক ট্যাবলেট দিয়ে ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় রত রয়েছে। দেশের জনগণের চাহিদা এবং মৌলিক সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে বরাবরই কোন না কোন ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে মিডিয়ার মারফত সেটা উচ্চবাক্যে প্রচার-প্রসার করার নীতি-নৈতিকতাহীন এক সংস্কৃতি চালু হয়েছে। কতিপয় এলিট শ্রেণির আয়ের হিসাবের ভিত্তিতে জিডিপির অগ্রগতির রেকর্ড দেখানো হচ্ছে, অথচ সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের খবরই নেই। বলা যায় রাষ্ট্র পরিচালনায় রত ক্ষমতাসীন দলের মধ্য এখন “উন্নয়ন” নামক এক নতুন রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দিয়েছে। যে কারণে তারা কেবলমাত্র উন্নয়নটা শব্দটাই বলে যায়, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে জনগণের সামগ্রিক অবস্থার কোন প্রকার উন্নয়ন এই সরকার ঘটাতে পারেনি।
এখন চারিদিকে কেবল উন্নয়ন-উন্নয়ন এই শব্দই শুনতে পাওয়া যায়। বাস্তবিক অর্থে উন্নয়নের সঠিক অর্থটাই বোধহয় তাদের কাছে জ্ঞাত নয়। সাধারণ মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা তাদের জীবন মানের উন্নয়নের বদলে কেবলমাত্র রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, সেতু, বড় বড় দালানকৌটা, বিলাসবহুল শপিং মল ও পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাদি অবকাঠামোগত নির্মাণকেই বর্তমানে উন্নয়ন বলে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। চলমান নয়া উন্নয়নের এই সংস্কৃতিতে অথচ এখনো নারীর নিরাপত্তা রক্ষিত হয়নি, সাধারণ মানুষের ভাগ্যর পরিবর্তন হয়নি, দেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে পারেনি, দেশের মানুষ প্রকৃত অর্থে শাসন-শোষণের যাঁতাকল থেকে মুক্ত হতে পারেনি, গণতন্ত্র রয়ে গেছে অধরাতে। তথাকথিত উন্নয়নের এই সুবিশাল ট্যাবলেটটিকে জনমানুষকে জোরপূর্বক গেলানো হলেও, এই ট্যাবলেট এখনো সমাজের বৈষম্যকে দূরীভূত করতে পারেনি, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে পারেনি, সাম্প্রদায়িকতা আর জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংহসতাকে দূর করতে পারেনি।
দেশের সমস্ত সমস্যাকেই এখন উন্নয়নের মোড়কে প্যাকটেজাত করা হচ্ছে। মৌলিক দাবি-দাওয়া নিয়ে জনগণ সগরম হয়ে উঠলে, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছু করতে বা বলতে গেলেই উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে সেটাকে ঢালাওভাবে প্রচারের রাজনীতি করা হচ্ছে। করোনার প্রকোপকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ রেখে আন্দোলনের রাস্তাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, অথচ সেখানে সাধারণ শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে কারখানাগুলো সচল রাখা হয়েছিল। এমনিতর বাস্তবতায় দেশের সমগ্র পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত নাজুক এক অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে, সেখানে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা ভালো যে, দেশের সমগ্র অংশের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একই কায়দায়, একই প্রক্রিয়ায় বিচার-বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই। অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এতদঞ্চলের ভৌগলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য এবং পরিস্থিতি দেশের অপরাপর অঞ্চল হতে সম্পূর্ণ পৃথক এবং ভিন্ন ধরনের। সুতরাং যারা পাহাড়ের পরিস্থিতিকে দেশের সাধারণ পরিস্থিতির আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে, তারা বরাবরই ভুলের পথে পা বাড়ায় এবং অন্ধকারে হাঁতড়ে বেড়ানোর মতই তাদের অবস্থাটা হয়ে দাঁড়ায়।
গত ১৬ জানুয়ারি বীর বাহাদুরের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান যে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন যে, “বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই, যেখানে শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে। এর জন্য তিনি নেপাল, আইল্যান্ডের তূলনাও দিয়েছেন।” অর্থাৎ তার কথা অনুসারে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে না, যা করা হয়েছে সেটাই শেষ। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে এমনই এক সময়ে এসে সরকার দলের একজন প্রতিনিধি হিসেবে বীর বাহাদুরের এমন বক্তব্য নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক, এমনকি তার এই বক্তব্য পাহাড়ের পরিস্থতিকে আরো জটিল করে তুলবে, যা হয়তো তার কল্পনারও বাইরে। পূর্বেকার সময় বীর বাহাদুর গলা উঁচিয়ে বলছিলেন, চুক্তির ৮০% বাস্তবায়ন হয়েছে, এতটি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। অথচ সেই বাহাদুরেরাই এখন চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কোথায়, কোন দেশে হয়েছে, তার হিসেব-নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করাচ্ছেন।
তারা চুক্তি কোন দেশে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি, সেটা দেখতে পায়। কিন্তু তারা এটা দেখতে পায় না যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় যে, ভারতে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো মূলত আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চল। এই উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম একটি রাজ্য হচ্ছে মিজোরাম, যেখানে মিজো জনগোষ্ঠীভুক্ত লুসাই, বম, পাংখো, লাই ও মারা এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এই মিজেরামে ভারতের অন্য কোন অঞ্চল থেকে এসে কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে না, কেননা বাইরের কেউ এসে এখানে জায়গা-জমি ক্রয় করতে পারে না। এতদঞ্চলের জনগোষ্ঠীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এখানে “ইনার লাইন পারমিট” ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তাদের রয়েছে নিজস্ব আইন পরিষদ। অথচ বীর বাহাদুরেরা সেই সমস্ত রাজ্যগুলিকে দৃষ্টান্ত দিতে অপরাগ।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভিন্ন ভাষাভাষি ১৪টি জাতিগোষ্টীর আবাসস্থল। তাদের সংস্কৃতিক বৈচিত্র্যটা এতদঞ্চলকে আরো সুন্দর এবং বিকশিত করেছে। এমনকি ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল বিশেষ শাসনব্যবস্থার দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। সুতরাং এই অঞ্চলের বিশেষত্বকে অক্ষুন্ন রাখতে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে এক বিশেষ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি আরো বলেছেন, “বলা এবং করার মধ্য একটা তফাৎ আছে, বাস্তবটা আলাদা।” তার এই বক্তব্য নিছক শিশুসুলভ কোন গল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ দুই যুগ পেরিয়ে এসে এধরনের বক্তব্য দেয়ার কোন যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। সেই সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষে থেকে সরকার সমস্ত বিষয়, সমস্ত আইনী প্রক্রিয়া, দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান ইত্যাদি বিষয়কে মাথায় নিয়েই এই চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। এমনকি চুক্তিতে রাষ্ট্রের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও প্রস্তাবনায় রাখা হয়েছে। সুতরাং এই সময়ে এসে বাস্তবতার দোহাই দিয়ে, বলা এবং করার মধ্য তফাৎ দেখিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ানো বা চুক্তিকে অস্বীকার করার কোন অর্থই থাকতে পারে না।
চুক্তি হয়েছে বলে পাহাড়ে মোবাইল পৌঁছেছে, টেলিভিশন এসেছে, রাস্তাঘাট হয়েছে বলে বীর বাহাদুরের উচ্চবাক্যগুলোও একদম বালখিল্য। তাহলে কি চুক্তি না হলে পাহাড়ে সরকার মোবাইল নেটওয়ার্ক দিতো না? পাহাড়ীরা টেলিভিশন কিনতে পারতো না? রাস্তাঘাটের কোন উন্নয়ন হতো না? আর মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক তো আওয়ামীলীগ সরকারের পূর্ববর্তী ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারই এনেছিল। এটার জন্য আওয়ামীলীগ সরকারের কোন কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না।
বস্তুত পক্ষে এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে চুক্তির মূল জিনিসটাকেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। জনগণের সামনে চুক্তিকে কেবলমাত্র একটি উন্নয়নের কাগজ হিসেবে উপস্থাপনের রাজনীতি করা হচ্ছে। এই চুক্তি যে একটি রাজনৈতিক চুক্তি, সেটাকে সরকারের দলীয় লোকেরা বরাবরই বেমালুম ভুলে যায় বা অস্বীকার করার প্রয়াস চালায়। বীর বাহাদুরেরা ভুলে যায় কি করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা কোন মোবাইল, টিভি কিংবা রাস্তাঘাটের সমস্যা নয়, নয় কোন জিনিসপত্র কেনা-বেচা করার সুযোগ-সুবিধার সমস্যা।
যদি সত্যিই পাহাড়ের সমস্যা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যা হতো, তাহলে উন্নয়ন বোর্ড গঠনের পরেও কেন সেই সমস্যার সমাধান হয়নি! যদি নিতান্তই কেবল তথাকথিত কতিপয় লোকেদের বিদ্রোহ হতো, তাহলে সামরিক উপায়ে কেন সেটি নিরসন হয়নি।
কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। অধিকিন্তু এটি কেবলমাত্র এতদঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা। সুতরাং ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের সনদ এবং জাতীয় চুক্তি। অতএব, এই চুক্তিকে কেবলমাত্র উন্নয়ন দিয়ে বিশ্লেষিত করার কিংবা বর্ণনা করার কোন যৌক্তিকতাই নেই, এমনকি থাকতেও পারে না।
হ্যাঁ, চুক্তির পরে পাহাড়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার ঘটেছে তূলনামূলকভাবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসারও ঘটেছে মোটামুটি। তবে এর অর্থ এই নয় যে, এসব উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তেই কেবল চুক্তি হয়েছে। উন্নয়ন, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য চুক্তি না হলেও হতো, যদি রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকতো। তবে হ্যাঁ, ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি সেগুলোকে তরাণ্বিত করেছে এটাও বাস্তব সত্য। কিন্তু চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা বা স্বশাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা। জুম্ম জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন, তাদের সমাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি। সুতরাং এই চুক্তি নেহাতই কেবল চুক্তির খাতিরে চুক্তি নয়। অতএব বীর বাহাদূরদের তথা সরকারের চুক্তি বাস্তবায়ন না করার এবং চুক্তি ভূলন্ঠিত করার পরিণামটাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা জনগণের অসন্তোষ রাষ্ট্রের ভিটকে নাড়িয়ে দিতে বরাবরই সক্ষম ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এটাই নির্মম সত্য।
বীর বাহাদূর তার বক্তব্যে আরো উল্লেখ করেছেন যে, “চুক্তির কোথায় লেখা আছে, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে দেরি হলে, খুন করা হবে?”
কিন্তু তার বিপরীতে প্রশ্ন হচ্ছে, চুক্তির কোথায় লেখা আছে, “পাহাড়ে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প থাকবে? পাহাড়ের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে থাকবে? চুক্তি হওয়ার পরেও কেন ২৪তম পদাতিক ডিভিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী থাকবে? কেন স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা হচ্ছে না? আর তথাকথিত ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি ইত্যাদি সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ কর্তৃক মদদ দেয়ার বিধান রয়েছে? চুক্তিতে কোথায় লেখা রয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করে সেনাবাহিনী কর্তৃক চিম্বুক পাহাড়ে বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের? চুক্তিতে কোথায় উল্লেখ রয়েছে উন্নয়নের নামে পাথর উত্তোলন ও বনাঞ্চল উজার করে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করার?
চুক্তিতে কোথায় উল্লেখ রয়েছে সার্কেল চীফের পাশাপাশি ডেপুটি কমিশনারদের পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দার সনদ প্রদানের বিধান? চুক্তিতে কেবল উপজাতীয় আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিধান রয়েছে, কিন্তু সেখানে আওয়ামীলীগ সরকারে কেন মুসলিম সেটেলারদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য জেলায় পুনর্বাসনের অপচেষ্টা করলো কেন?
উপরন্তু পাহাড়ে যে সমস্ত হত্যা, খুন, গুম ইত্যাদি ঘটনা হয়, সেগুলোর জন্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী জেএসএস কোন মতেই দায়ী নয়। কেননা জেএসএস বরাবরই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আলোচনার টেবিলটিকে সামনে রেখেছে এবং সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে চলেছে। ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি, আরসা, আরসু ইত্যাদি সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে জেএসএস গড়ে তুলেনি। রাষ্ট্রযন্ত্র তথা ক্ষমতাসীন দলের মদদে ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং পাহাড়ে হত্যা, খুন, গুম ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলই প্রকৃতপক্ষে দায়ী।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ হিসেবে চুক্তি বিরোধীদের বিরুদ্ধে সমাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে অবস্থান নেয়াটা সরকার এবং জেএসএস উভয়ের অধিকার রয়েছে। জনসংহতি সমিতি যদি চুক্তি বিরোধীদের রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিহত করে সরকারকে সহযোগিতা দিতে পারে, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে কেন সেই সহযোগিতা করা হবে না৷ সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসুক এবং চুক্তি বাস্তবায়ন হোক, এইটা চায়, তাহলে চুক্তিকে ঘিরে অপপ্রচার এবং চুক্তি বিরোধী অপশক্তিকে দমন করাটাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের হাতে না দিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে সমর্পন করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী সেই সমস্ত চুক্তি বিরোধী অপশক্তিসমূহকে আগলে নিয়ে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে আর পাহাড়ে তাদের বৈধতাকে পাকাপোক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে। সুতরাং পাহাড়ে হত্যা, গুম, চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো কোন না কোনভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদেই সংঘটিত হচ্ছে, তারা কোনভাবেই এর থেকে দায়মুক্ত হতে পারে না।
অপরদিকে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা বরাবরই এই সমস্ত সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে নির্বাচনের সময় ব্যবহার করে থাকে। এই সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনগণকে তাদের পক্ষে ভোট দিতে প্ররোচিত করা হয় এবং অপরদিকে সরকার দলের বিপক্ষীয় কোন প্রার্থীকে এই সমস্ত সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দ্বারা নানাভাবে হয়রানি এবং হুমকি প্রদান করা হয়। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীরাই এই সমস্ত তথাকথিত সশস্ত্র গ্রুপগুলোর পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং অস্ত্রের ঝনঝনানির দোহাই দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার যে যুক্তি তারা দেখায়, সেটা নেহাতই তাদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বস্তুতঃপক্ষে এইসব বক্তব্যের দ্বারা চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার অভাব এবং অনাগ্রহটাই প্রকাশ পায়। চুক্তি বাস্তবায়নের বিপরীতে তথা চুক্তি বাস্তবায়নের সমস্ত প্রক্রিয়াকে স্থগিত রেখে কেবলমাত্র নানা অহেতুক অজুহাত দেখিয়ে চুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার বা ভূলন্ঠিত করার অপচেষ্টা রাষ্ট্র বারবার করে দেখাচ্ছে। তারপরেও চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ হিসেবে জনসংহতি সমিতি এবং জুম্ম জনগণ যে অসীম ধৈর্য দেখিয়ে চলেছে, সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্য যে, সরকার চুক্তিকে লঙ্ঘন করে চুক্তির বৈধতাকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ করা সত্ত্বেও জনসংহতি সমিতি যে ধৈর্য দেখিয়ে চলেছে, সেটাকেই যদি সরকার জেএসএস বা জুম্ম জনগণ এর দূর্বলতা মনে করে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে তার ফল কখনই দেশের এবং দেশের জনগণের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। অতএব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের এবং সরকারের ক্ষমতায় থাকা দলের লোকেদের উচিত চুক্তিকে সম্মান করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবরকমের সহযোগিতা করা এবং চুক্তি বিরোধীদের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেওয়া, তাহলেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে।