বাচ্চু চাকমা
আমাদের বড় মাত্রায় স্বপ্ন দেখতে হবে। শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, সমগ্র জুম্ম জনগণের মুক্তির জন্য, আমাদের জুম্ম সমাজের জন্য স্বপ্ন দেখতে শিখতে হবে। শুধু নিজের জন্য স্বপ্ন দেখলে নিজের সমৃদ্ধি হবে ঠিক কিন্তু গোটা জুম্ম সমাজের জাতীয় সমৃদ্ধি ও বিকাশ না হলে নিজের জন্য স্বপ্ন দেখা নিতান্তই অর্থহীন। তাই জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে সবার জন্য স্বপ্ন দেখা শিখতে হবে। জানতে হবে এবং জানার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জুম্ম জাতির মুক্তির স্বপ্ন আমাদেরকে বাস্তবায়ন করতে হবে, অন্য দেশ কিংবা অন্য জাতির মানুষগুলো এসে আমাদের আন্দোলন, আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেবে না। নিজেদের স্বপ্ন নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে, এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারার আনন্দ আর তৃপ্তি একদিন প্রাণভরে জুম্ম জাতি উপভোগ করবেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সেই লক্ষ্যে আমাদের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষাসহ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামকে অগ্রসর করতে জুম্ম তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে একাগ্রচিত্তে। এই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল স্বপ্ন দেখা। দেশে দেশে যে সকল নিপীড়িত ও শোষিত মানুষগুলো আজও বেঁচে আছে, তারা কোনো না কোনোভাবে একটি বা একাধিক স্বপ্নকে সামনে রেখেই বেঁচে আছে। স্বপ্ন যেমন দেখতে হয়, অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে হয়। যে স্বপ্ন দেখে না সে মৃত মানুষ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
যদি আমরা প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত আদর্শ প্রতিটি কর্মীগণ হৃদয়ে লালন করে চলতে পারি, তাহলে তাঁর স্বপ্ন একদিন অবশ্যই পূরণ হবে। স্বপ্ন দেখতে হলে বড় করেই দেখতে হয়। বড় স্বপ্ন দেখলে ছোট স্বপ্নগুলো এমনিতেই বাস্তবায়ন হয়! কেউবা জুম্ম জাতির স্বপ্ন পূরণে তরুণদের উৎসাহ দেবে, কেউবা নিরাশ করবে তা স্বাভাবিক। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের এটাই বাস্তব সত্য ঘটনা। আন্দোলনের স্বার্থে অন্যের দেয়া উৎসাহ কোন কোন সময় আমাদের সামনে চলতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। জুম্ম জাতির মুক্তির স্বপ্ন আমাদের এক মুর্হুত থামতে দেবে না, বিশ্রাম দেবে না, এমনকি আমাদেরকে ঘুমাতেও দেবে না। জুম্ম তরুণ সমাজ যদি অধিকতর সাহসী হন, বিবেকবান হন, জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা ও সততার সমন্বয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হন আর আমাদের মনে যদি স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, আর তা বাস্তবায়নের জন্য যদি আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি তাহলে দুনিয়ার এমন কোনো অপশক্তি নেই যা আমাদের আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে পারে। আমাদের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বপ্নের গল্পগুলো বিশ্বের প্রগতিশীল, মানবতাবাদী ব্যক্তি, সংগঠন, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষ স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের সময় আমাদের বাহ্যিক শক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা আমরা লাভ করেছি, ফলশ্রুতিতে স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ ভিত্তি শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছি।
সমাজের বাস্তবতার কথা ভাবলে অনেকেই হয়তোবা হতাশ হন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশাহীনের মতন অস্বাভাবিক মন্তব্য করে বসে থাকেন। আমাদের জুম্ম সমাজব্যবস্থা আজ কোথায় অবস্থান করছে? আমাদের জুম্ম সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণসহ সম্যক ধারণা নিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখতে হবে। কেননা আমাদের সমাজব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বপ্ন দেখলে কিংবা চিন্তা করলে সেটা হবে কেবলমাত্র কাল্পনিক ও মনগড়া। আমাদের সামনে আজ দিবালোকের মতোই পরিষ্কার, জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে অধঃপতনে ঠেলে দেওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর সমস্ত কিছু আয়োজন করে রেখেছে। আমাদের মানবিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করছে শাসকশ্রেণি, এবং আমাদের জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে মদ, জুয়া, হিরোইন, গাজা, ইয়াবার আসরে জমজমাট করে রাখতে পারলে শাসকগোষ্ঠীর আসল উদ্দেশ্য স্বার্থক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আর্শিবাদে প্রাপ্ত এন্ড্রয়েড মোবাইলে আন্তর্জাতিক নব্য ক্রেজিটাইম জুয়ার আসর জমজমাট দেখা যায়, জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজ আজ এই মরণ নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও সমাজের মানুষের মধ্যে ব্যক্তি স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে অনেক মানুষ আজ নিয়ন্ত্রণহীন ভোগবিলাস, উচ্চাভিলাস ও চরম দালালীপনা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে, এসব প্রভাবে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধ তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এধরণের পরিস্থিতি ও বাস্তবতার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে আমাদের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের ধারাবাহিকতা সমানতালে এগিয়ে নেওয়া অবশ্যই অনেক কঠিন। পরিস্থিতি কঠিন হলেও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে।
কে, কিভাবে, কেমন করে এবং কোন উদ্দেশ্যে স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করে? কেউবা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন লালন করে, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা শিক্ষক, কেউবা ব্যাঙ্কার, কেউবা উকিল, কেউবা বিসিএস ক্যাডার, কেউবা সেনা ও পুলিশ অফিসার এবং কেউবা অর্থ-স্বার্থের মালিক হওয়ার স্বপ্ন ও বিল্ডিং দালানকোঠার স্বপ্ন দেখে! কিন্তু আমাদের জুম্ম তরুণদের স্বপ্ন হওয়া উচিত কেবল জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তির! জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, আজীবন বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন আমাদেরও দেখতে হবে। জুম্ম জনগণের স্বশাসনের স্বপ্ন, জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার স্বপ্ন, বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন থেকে জুম্ম জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন, অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার শাসকগোষ্ঠী গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের স্বপ্ন দেখতে হবে, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, মানুষের মত মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন, স্বশাসন ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন, নিজেদের হারানোর বসতভিটা ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জুম্ম তরুণদের অধিকতর আন্দোলনের স্বপ্ন দেখা উচিত। জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে সামিল হওয়ার স্বপ্ন জুম্ম তরুণদের প্রতিটি মুর্হুতে তাড়িত করতে হবে!
যে স্বপ্ন মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে শিখে, মানবমুক্তির পথ দেখাতে পারে- এমনই স্বপ্ন আমাদের দেখা উচিত! শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখলে হয় না, সেই স্বপ্নকে অন্তরে, হৃদয়ের গভীরে লালন করতে হয়। স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয় সমাজের জন্য, স্বপ্ন দেখতে হয় জাতির মুক্তির জন্য, স্বপ্ন দেখতে হয় সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য! পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি ও সময়ের অন্যতম দাবী হলো এই, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থ বা জুম্ম জাতীয় স্বার্থ উদ্ধারের স্বপ্ন দেখতে হবে প্রিয় জুম্ম তরুণদের! নিজের ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়ে আগে জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তির স্বপ্ন দেখতে হবে। তার জন্য দৃঢ়ভাবে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অধিকারের স্বপক্ষে অবস্থান নিতে হবে! ন্যায়ের পক্ষে ও শোষিতের পক্ষে আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। রাজনৈতিক অধিকার ব্যতিত যে কোন জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়, আজ জুম্ম জনগণের পায়ের তলে মাটি যেখানে সরে যাচ্ছে সেখানে জুম্ম ছাত্র সমাজের স্রেফ চাকরির মোহ কিংবা স্রেফ বৈষয়িক স্বপ্ন দেখাটা বাস্তবসম্মত নয়। আজ জুম্ম জাতির মহাসংকটের সময়, ক্রান্তিকালীন সময় অতিবাহিত হচ্ছে! এসময়ে নিজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নগুলো আঁকড়ে ধরে থাকলে আমাদের জুম্ম জাতিকে বিষিয়ে মারবে, কেননা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের পেছনে যদি জুম্ম তরুণরা ছুটাছুটি করে তাহলে জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তির পক্ষে আমরা যথাযথ মনোযোগ দিতে পারব না। তাই বৃহত্তর স্বার্থে জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন দেখতে হবে। মনে রাখবেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া দরকার। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা- তাঁদের স্বপ্নের সাথে বর্তমান জুম্ম তরুণদের একাকার হয়ে মিশে যেতে হবে।
জুম্ম জনগণের মহান স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা গড়ে তুলেছিলেন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি, আদর্শভিত্তিক একটা রাজনৈতিক সংগঠন। সংগঠনের আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মানবতাবাদ। লক্ষ্য পরিপূরণের একমাত্র মোক্ষম হাতিয়ার যেহেতু সংগঠন, সেহেতু সংগঠনের হাত ধরে এগিয়ে এসেছে ৭০ ও ৮০ দশকের জুম্ম তরুণরা। ছাত্র ও যুব সমাজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব বুঝে নিতে এই আন্দোলনে সংঘবদ্ধ জুম্ম তরুণরা সামিল হয়েছিলেন। এই সংগঠনের পতাকাতলে গড়ে উঠেছে পাহাড়ের বুকে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম! স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত শ্রম, রক্ত ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন, স্বপ্ন বাস্তবায়নে যেমনি দরকার প্রজন্ম হতে প্রজন্মের ধারাবাহিকতা তেমনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আত্মবলিদানেরও ধারাবাহিকতা দরকার হয়। একজন সাহসী বীর যোদ্ধার অনুপস্থিতিতে আরেকজন এসে সেই খালি স্থান পূরণ করতে শিখতে হবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে, জুম্ম জাতি পৃথিবীর বুকে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রতা নিয়ে নিঃসন্দেহে বেঁচে থাকতে পারবে, এবং মাথা উঁচু করে একদিন নয় একদিন উঠে দাঁড়াবেই!
বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন তথা তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম থেকে আমাদের জুম্ম তরুণদের প্রেরণা নিতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণের যাঁতাকল হতে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রাম আদর্শগত দিক হতে বিশ্বের বুকে এক ও অভিন্ন। অনেক দেশে দেশে নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের মুক্তির আন্দোলনের শুভসূচনা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে এই সমস্ত আন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা পৃথিবীর ইতিহাসে যেমনি দেখতে পেয়েছি, তেমনিভাবে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আন্দোলন সংগ্রামের সফল সমাপ্তিও দেখেছি। বিশ্বের ইতিহাসে নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের রূপরেখা কোন কোন সময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, আবার কোন কোন সময় অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাস্তবতাও তৈরি হয়েছিল। নিয়ম ও অনিয়ম এই দুয়ের সমন্বয়ে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলন অনেক দেশে দেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একই সুত্রে গাঁথা। তাই, আমাদের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ একা নয়, আমরা কয়েকজনই নয়-জাতীয় পর্যায়ে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিশাল শক্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাববতাবাদী ব্যক্তি ও সংগঠন এবং বঞ্চিত জাতি ও মানুষের আন্দোলনের শক্তি আমাদের আন্দোলনের স্বপক্ষে রয়েছে।
আমাদের স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্র আরও বিশাল হতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্তবাদী ও বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশিক শাসন-শোষণ নির্মূল করে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা তথা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি সম্প্রসারণবাদ প্রতিহত করে জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে সামিল হতে হবে। আমাদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রামে চূড়ান্ত অর্থে বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। ধৈর্য, সাহস ও কৌশলী ভূমিকা নিয়ে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির আন্দোলনে আত্মবলিদানে প্রস্তুত হতে হবে। অতীতের জুম্ম জাতির গৌরবময় সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের এখনও প্রেরণা জোগায়, প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমার ডাকে সাড়া দিয়ে ৭০ দশকে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির বিপ্লবী কর্মীরা দলে দলে যোগ দিয়েছিলেন, এবং এম এন লারমার প্রদর্শিত পথ ধরে নীতিগতভাবে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে বিশ্বাসী হয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৭০ দশকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির নেতৃস্থানীয় কর্মীগণের আত্মগোপনের ন্যায় বর্তমান জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজের আত্মবলিদানের ধারাবাহিকতা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। জুম্ম তরুণদের স্বপ্ন হোক সেটাই, যেটা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে আমাদের জুম্ম তরুণদের স্বপ্ন দেখা দরকার, যেটি দেখেছিলেন প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমাসহ ৭০ দশকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির একদল সংঘবদ্ধ নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী জুম্ম তরুণ। এরই পাশাপাশি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করতে ৮০ দশকের জুম্ম ছাত্র সমাজ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন অসমাপ্ত রেখেই আত্মগোপনে চলে এসেছিলেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দেখানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখতে গিয়ে ৮০ দশকের জুম্ম তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে আত্মবলিদানে ভীত সন্তপ্ত না হয়ে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তির স্বপ্নকে অন্তরে লালন করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ জীবনকে পেছনে ফেলে এসে আত্মবলিদানের গৌরবময় সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। আজও জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজের জাতির ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে একটা স্বপ্নকে ধ্বংস করার জন্য বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এম এন লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে আপসহীন লড়াই সংগ্রাম এখনও নিরন্তর গতিতে এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম বাস্তবে আমরা যা কিছু দেখতে পেয়েছি, তারমধ্যেও সমগ্র শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাইলফলক একটা ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক মাও সেতুং এর চীনের সমগ্র জনগণকে নিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা ছিল, এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সমগ্র জনগণকে নিয়ে হো চি মিনের স্বপ্ন তা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ ছিল বিধায় সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হতে আমরা দেখেছি। স্বপ্ন দেখতে হবে পাহাড়ের পরিস্থিতির আলোকে এবং স্বপ্ন দেখতে হবে সমগ্র জুম্ম জাতির মুক্তির তরে। আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক!