হিল ভয়েস, ২০ জানুয়ারি ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: সম্প্রতি কয়েক মাস ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ঘুমধুম ইউনিয়নে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর অবস্থানরত রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে আরাকান সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংঘাত হয়ে আসছে বলে বিশ্বস্থসূত্রে জানা গেছে। এতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র মুসলিম জঙ্গী সংগঠন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মী (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-এর কয়েক ডজন সদস্য নিহত এবং অপরপক্ষে আরাকানী গেরিলা বাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়েছে বলে সূত্রে উল্লেখ করা হয়। এতে ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থানীয় অধিবাসীরা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে।
সূত্র জানায় যে, মূলত সশস্ত্র আন্দোলনরত আরাকানী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক রোহিঙ্গা জঙ্গীদেরকে উস্কানী প্রদান, আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) প্রদেশে রাখাইন ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের চলমান বিরোধ, রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গীদেরকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সমর্থন ও সহায়তা, রোহিঙ্গা জঙ্গী কর্তৃক ঘুমধুম এলাকায় স্থানীয় মারমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর উপর হয়রানি ও নির্যাতন, সর্বোপরি সীমান্তবর্তী বিভিন্ন ব্যবসায়িক চ্যানেলের উপর আধিপত্যকে কেন্দ্র করেই রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গীদের সাথে আরাকানী বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংঘাতের সূত্রপাত হয়ে আসছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, ১৩-১৪ জানুয়ারি ২০২২ দুইদিন ধরে ঘুমধুম ইউনিয়নের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানার ৩৭ ও ৩৮নং পিলার বরাবরে রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গী সংগঠন আরসা/আরএসও সশস্ত্র জঙ্গীদের সাথে আরাকানী বিদ্রোহীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় বলে জানা যায়।
সূত্র মতে, ১৩-১৪ জানুয়ারি ঘটনা সংঘটিত না হওয়ার ৩/৪ দিন আগে মাদক বহনকারী কয়েকজন রাখাইন লোককে বুসিডং থেকে সীমান্তে আসার সময় আরসা/আরএসও জঙ্গীদের হাতে ধরা পড়ে এবং আরএসও সদস্যরা সমস্ত জিনিস নিয়ে কেড়ে নেয়। মাদক চোরাচালানের রাস্তাটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার উদ্দেশ্যেই আরসা/আরএসও সদস্যরা এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় বলে জানা যায়। এতে আরাকানী বিদ্রোহীরা ক্ষুব্ধ হলে শেষ পর্যন্ত আরএসও/আরসাদের উপর প্রতিশোধ নিয়ে নেয়।
আরো জানা যায় যে, ১২ জানুয়ারি সকালে আরাকানী বিদ্রোহীদের এক সদস্য সামান্য দূরে জুম ক্ষেতে বেগুন তুলতে গিয়ে আরসা/আরএসও সদস্যদের কবলে পড়েন। আরএসও সদস্যরা আরাকানী সদস্যকে অমানষিকভাবে মারধর করে। পরে আরাকানী সদস্যটি কোন রকম আরসা/আরএসও জঙ্গীদের কবল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এরপর আরাকানী বিদ্রোহীদের শত শত সদস্য গিয়ে আরসা/আরএসওদের ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলা করে। ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে এবং আরসা/আরএসওদের অনেক সদস্য হতাহত হয় বলে জানা যায়। এমনকি অনেক আরসা/আরএসও সদস্যরা সামরিক পোষাক পাল্টিয়ে সাদা পোষাকে ঘুমধুমের বাইশপারী হয়ে পালাতে দেখা যায় বলে খবর পাওয়া যায়।
অন্যদিকে ২০২১ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে আরাকানী এক সশস্ত্র গ্রুপ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের গাছবনিয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া সংলগ্ন বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমানার ৪২নং পিলারে রোহিঙ্গ্যা জঙ্গী গোষ্ঠী আরসা/আরএসও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে জানা যায়।
গাছবনিয়া পাড়া থেকে সামান্য উত্তরে নিকুছড়ি বিজিবি ক্যাম্পের ছত্রছায়ায় আগে থেকে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সদস্যরা সেখানে অবস্থান করছিল। ২০২১ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে আরসা/আরএসও সদস্যদের বিপুল সংখ্যক সদস্য সেখানে সমবেত হয়। ৩০অক্টোবর ২০২১ আরসা/আরএসও সদস্যদের জন্য এক জীপ (স্থানীয় ভাষায় চাঁদের গাড়ি) চাউল ও বিভিন্ন বাজার গাছবনিয়া পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার পরদিন ৩১ অক্টোবর আরো এক ট্রাক (ডাম্পার) চাল নিয়ে যায়।
২০২১ সালের ১ নভেম্বর ভোর রাতে ৩৯-৪১ নং সীমান্ত পিলার বরাবরে অবস্থিত আরাকানী সশস্ত্র গ্রুপের বড় ব্রিগেডের উপর আরসা/আরএসও জঙ্গীরা হামলা করেছিল বলে জানা যায়। সেদিন ভোর রাতে ৩:০০-৪:০০ টার দিকে প্রায় একঘন্টা অধিক সময় ধরে প্রচুর গোলাগুলি হয়। আরাকানীরা রাত্রে মদ খেয়ে গানবাজনা করার সময়ে হামলা করা হয় বলে জানা গেছে।
আরাকানী সশস্ত্র গ্রুপের যোগাযোগের মূল কেন্দ্র গর্জনবনিয়া পাড়া হলেও উক্ত ঘটনার পর দিন ২ নভেম্বর তাদের কোন সদস্য সেখান থেকে কোন মালামাল নিতে দেখা যায়নি। সে সময় গর্জনবনিয়া পাড়ার মাধ্যমে আরাকানীদের যোগাযোগের রাস্তাটি আরসা/আরএসও সদস্যরা বন্ধ করে দিয়েছিল। আরসা/আরএসও কর্তৃক রাস্তা ব্লক করে রাখার কারণে আরাকানী সদস্যরা কোন আহত বা নিহত সদস্যদের চিকিৎসার জন্য কোথাও নিতে পারেনি বলে জানা যায়। এমনকি সেসময় আরসা/আরএসও সদস্যদের বাধার মুখে গর্জনবনিয়া পাড়ার স্থানীয় অধিবাসীদের কোন লোক কর্মস্থল জুম ও কলাবাগানে যেতে পারেনি।
আরসা/আরএসও জঙ্গীদের উক্ত হামলায় প্রায় এক ডজনের মতো আরাকানী সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ নারী সদস্য ছিল। হামলাকারী আরসা/আরএসও সদস্যদের মধ্য থেকে ১৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ হামলার জন্য প্রায় ১৫০ জনের মত আরএসও/আরসা সদস্য অংশ নিয়েছিল এবং নিকটবর্তী বিভিন্ন পাহাড় ও রাস্তার ধারে ৪০-৫০ জন করে গ্রুপ হয়ে অবস্থান নিয়েছিল বলে খবর পাওয়া যায়।
আরএসও জঙ্গীদের উক্ত হামলার প্রতিশোধ নিতে ২ নভেম্বর ভোর রাতে আরাকানী সশস্ত্র সদস্যরা থোয়াইঙ্গা ঝিরি বিজিবি ক্যাম্পের পূর্ব দিকে আরএসও/আরসা ক্যাম্পে হামলা চালায়। আরসা/আরএসও জঙ্গীদের উপর আরাকানীদের হামলায় কমপক্ষে কয়েক ডজন আরসা/আরএসও জঙ্গী সদস্য নিহত হন। আর আরাকানীরা অনেক আরসা/আরএসও সদস্যকে বন্দী করে বলে জানা যায়। আরাকানীদের হামলা থেকে বাঁচার জন্য প্রায় ৭০-৮০ জন আরসা/আরএসও জঙ্গী ঘুমধুম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খাইরুল বশর-এর বাগান ও আংগা মরং নামক কুতুপালং বড়ুয়া পাড়ার কাছাকাছি জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় বলে খবর পাওয়া জানা যায়।
এদিকে এ ঘটনার পর ৪২নং সীমান্ত পিলার সংলগ্ন নিকুছড়ি বিজিবি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণাধীন আরসা/আরএসও ক্যাম্পে নতুন করে ৫টি অস্থায়ী ঘর তৈরি করা হয়। পালিয়ে আসা আরসা/আরএসও সদস্যরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়। অপরদিকে জামীরতলী পাড়া খালে ও পাহাড়ে অবস্থিত আরসা/আরএসও ক্যাম্পের দিকে গোলাগুলি হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। ৫ নভেম্বর গভীর রাতে ৪২নং পিলার দিকেও প্রচুর গোলাগুলি হয়েছিল।
আরসা/আরএসও সদস্যদের উপর হামলা না করার জন্য বাংলাদেশের সেনা গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে আরাকানী বিদ্রোহীদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।
আরএসও/আরসা ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর দুই মেজর ও একজন আফগান নাগরিক
ছবি: সাদা সার্টে মেজর রাসেদ, সেনা পোষাকে মেজর জিয়া এবং বৃদ্ধ হুজুরটি হামিদুল্লাহ আফগানিস্তানের নাগরিক।
গত ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে যে, ৪২নং সীমান্তবর্তী গাছবনিয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া সংলগ্ন নিকুছড়ি বিজিবি ক্যাম্পের পার্শ্বে অবস্থিত আরএসও/আরসা ক্যাম্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুইজন মেজর ও একজন পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া আফগানিস্তানের নাগরিক রয়েছেন বলে জানা যায়। মেজর রাসেদ ও মেজর জিয়া এই দুইজন ব্যক্তি আরএসও/আরসা ক্যাম্পে ইঞ্জিনিয়ার নামে পরিচিত। আফগানিস্তানের নাগরিকের নাম হামিদুল্লাহ। উক্ত দুই মেজর ২০২০ সালের দিকে সিলেট সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যায় এবং গত ২/৩ মাস আগে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ২৬৮নং রেজু মৌজার অন্তর্গত নিকুছড়ি বিজিবিদের সাথে মিলেমিশে সীমান্তে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জামিরতলী পাড়া সহ কয়েকটি তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়েছিল এবং গাছবনিয়া পাড়ায় ঘরবাড়ি তল্লাসি করেছিল। গাছবনিয়া পাড়ার ঘরবাড়ি তল্লাসি করার সময় মেজর জিয়া নেতৃত্বে ৭-৮ জন আরএসও সদস্যও ছিল এবংরেজু পাড়া বিজিবি ক্যাম্প থেকে টহলরত স্পেশাল গ্রুপের নামে দুইটি মোটর সাইকেলসহ আরএসও/আরসা সদস্যদের সাথে একত্রে ঘরবাড়ি তল্লাসি করা হয়েছিল।