কং মোয়াইন কিয়
অতীতে মুরগীদের এক রাজ্য ছিল। মুরগীরা তাদের রাজার শাসনে সুন্দর জীবনযাপন কাটিয়ে দিতো। সকাল হলে মোরগ-মুরগি খাবারের সন্ধান করতো, আর সন্ধ্যা হলে ঘরে ফিরে আসতো। মুরগীর বাচ্চারা সারাদিন খেলাধুলা করতো, নাচগান করতো এবং মা-বাবার সঙ্গে খাদ্যের সন্ধানে যেতো। এভাবেই চলতো মুরগীদের সংসার।
একদিন পৃথিবীব্যাপী মহাঝড়ের কবলে পরে সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মুরগির রাজ্য আার বাঘের পাশাপাশি হওয়ায় মুরগির রাজ্যকে বাঘরা দখল করে নিল। এখন বাঘরা হলো দেশের শাসক। তবে মুরগির রাজার পদবি কেড়ে না নিলে রাজার ক্ষমতা থাকলো না। বাঘ এসে বলে, “এখন তোমাদের আগের ব্যবস্থা থাকবে না, তোমাদের নিয়ম থাকবে না; সবকিছু বাঘের নিয়মে চলবে।” মুরগীরা তো অসহায়, তারা বাঘের সাথে পারে না। মুরগিদের তো বাঘের মতো নখ নেই, দাঁত নেই; গায়ে বাঘের মতো বলও নেই।
মুরগিদের অবস্থার কথা না ভেবে বাঘেরা তাদের ইচ্ছার মতো যা চায় তাই করতে লাগলো। এরফলে ধীরে ধীরে মুরগিদের অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হয়ে চললো। মুরগিদের বাঁচার পরিবেশ নষ্ট হতে লাগলো। মুরগিদের রাজার সেদিকে দৃষ্টি দিতো না, সেদিকে মনোযোগ রাখতো না। মুরগিদের রাজা এবং তাদের গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের মুরগি বললেও সমস্ত মুরগি এক মনে করতো না। তারা মনে করতো মুরগির মধ্যে তারা শ্রেষ্ঠ। সেই শ্রেষ্ঠভাব মনে লালন করতে করতেই রাজা এবং রাজার গোষ্ঠী অনেক সময় নিজেদের মুরগি মনে করতো না; মনে করতো তারা বাঘ। তাই মুরগির রাজা ও তার গোষ্ঠীরা সমস্ত মুরগির জন্য ভাবতো না; মুরগিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতো না। রাজা নিজের ও নিজের গোষ্ঠীর আরাম-আয়েশ নিয়ে মশগুল থাকতো। এই আরাম-আয়েশের লোভে মুরগির রাজা এবং তার গোষ্ঠীর সদস্যরা বাঘদের মুরগির শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ভাবতো। বাঘদের চিন্তা ও কথাকে সমর্থন দিয়ে যেতো। মুরগিদের সামনে বাঘদের শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু বলে আলোচনা করতো।
কোনো কোনো মুরগি বাঘদের বিপক্ষে কথা বললে বা রাজার ভুল কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলে বাঘদের নালিশ করে ঐ মুরগির শাস্তির বিধান করতে তৎপর থাকতো। যাতে অন্য মুরগিরা তাকে প্রভু মানে। একারণে রাজার সাথে সাধারণ মুরগিদের সম্পর্ক মন্দই অবস্থায় থাকতো। আরেকদিকে মুরগির রাজার গোষ্ঠীতেও রাজপদ ও ক্ষমতার লোভে গোলমাল লেগেই থাকতো। ক্ষমতা লাভের জন্য রাজগোষ্ঠীর মুরগিররা কে বেশি বেশি বাঘের ভক্ত, কে বেশি বেশি বাঘের অনুগত; তা প্রমাণের ব্যস্ত থাকতো। আবার মুরগিদের রাজা হওয়ার একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিলো। রাজগোষ্ঠীর সবচেয়ে বয়স্ক মুরগিই রাজা হতো। এই নিয়মের কারণেই বয়সের ভারে ন্যূব্জ, হাঁটতে-চলতে ও চিন্তা করতে অক্ষম এবং মৃতপ্রায় মুরগি রাজা হতো। ফলে রাজা কী, রাজ্য কী, সুশাসন কী, অধিকার কী ইত্যাদি নিয়ে ভাবার আগেই রাজা মারা পরতো। ভেবে দেখুন, যে সময় নিজেকে নিয়ে ভাবতেই হয় তখন রাজ্য ও রাজ্যের জনসাধারণ নিয়ে ভাবা; তা কি সম্ভব? ‘লোভ-দ্বেষ-মোহে’ রাজগোষ্ঠী মুরগিদের বুদ্ধিশুদ্ধি ও বুদ্ধিমত্তা গেল মরে, বৃদ্ধি পেল বুদ্ধিভ্রংশতা। তাদের দ্বেষ বাঘের প্রতি নয়, নিজের প্রতি; মানে আত্মঘাতী। রাজগোষ্ঠীর মুরগিদের শুভবুদ্ধি হলো না রাজ্যের, নিজেদের ও সাধারণের সকলের মঙ্গলের জন্য রাজগোষ্ঠী থেকে এক জ্ঞানী, কর্মঠ, দক্ষ, উপযুক্ত বয়সী যোগ্য মুরগিকে রাজা নিয়োগ করি। গোষ্ঠীর সকলের মধ্যে একমত না হলে প্রয়োজনে গোষ্ঠী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে রাজা নির্বাচিত হবে। কিন্তু তা না করে নিজেদের মধ্যে রাজা হওয়া নিয়ে ধনসম্পদ নষ্ট করে বাঘের কাছে যেতো এবং বাঘের সিদ্ধান্ত মেনে চলতো। সাধারণ মুরগিদের সামনে রাজা পৃথিবীর মহারাজার ভাবসাব করতো; আবার অন্যদিকে বাঘের কথায় নড়চড় হওয়ার সাহস করতো না। শাসন অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অধিকার না থাকায় রাজা এবং রাজগোষ্ঠীর সদস্যদেরও আর্থিক-অর্থনৈতিক অভাবে পতিত হয়। ফলে গোষ্ঠীর সদস্যরা পূর্বপুরুষের রাজপ্রাসাদ একসময় বিক্রি করে দেয়।
রাজ্য বা সমাজ থাকলে সেখানে বুদ্ধিজীবীরাও থাকে। বুদ্ধিজীবীরা শুধু চোখ দিয়ে দেখে না, জ্ঞান দিয়েও দেখে। জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে রাজ্যবাসীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উত্তম অবস্থার জন্য শিক্ষা দিতেন এবং প্রচার চালাতেন। কিন্তু মুরগির রাজ্যে তেমনটি হতে পারি নাই। রাজা যেমন মূর্খ থাকতো, নিজের আরাম-আয়েশ ছাড়া বুঝতো না; বুদ্ধিজীবীরা রাজার মতোই হলো। মুরগির বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের রাজার মতোই ভাবতেন। জ্ঞানীর নীতিকে তারা ভুল ব্যাখ্যা করতো, জ্ঞানীর প্রধান নীতি-আদর্শ ও রাজ্যবাসীর কল্যাণকর নীতিগুলো না বলে বা প্রচার না করে অপ্রধান বা গৌণ ও অনুপকারক নীতিগুলিই প্রচার বা আলোচনা করতেন। ‘লোভ-দ্বেষ-মোহ’-তে না পড়তে বলতেন; আবার বাস্তব জীবনের সুখ-শান্তিকে ধামাচাপা দিয়ে পরকালের সুখ-শান্তির ‘লোভ-মোহ’ সৃষ্টি করে দিতেন। জ্ঞানকে সকলের মুক্তির জন্য, অনুন্নতি থেকে উন্নতি জন্য, নিচু থেকে উঁচুতে উত্তরণের জন্য না করে রাজা বা ক্ষমতাশালীদের সেবার জন্য করা হলো। শিক্ষা দেওয়া হতো মুক্তি এখন নয়, মৃত্যুর পরে।
ফলে সকলে মূর্খের অন্ধকারে ডুবে থাকলো। কেউই বাস্তবে দেখেও বুঝতে পারলো না এবং ভাবলো না অন্য রাজ্যের মুরগিরা অভাব ও বিভিন্ন বাধা হতে মুক্তি পেয়েছে, আমরাও তো মুক্তি পেতে পারি। এরাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা কখনো বলতো না, ‘যা শক্তিতে পারা যায় না, তা জ্ঞানে পারা যায়’। অন্য রাজ্যের মুরগিরা মুক্তি পেলে আমাদের কোথায় সমস্যা, তা নিয়ে এরাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা চিন্তা করতো না; শুধুই মুখস্ত বলতো, বাস্তবের সাথে মিল-অমিল রয়েছে কিনা, জ্ঞানীর নীতি-আদর্শের সাথে মিল আছে কিনা, তা চিন্তা না করে এবং জেনে না নিয়ে চোখ-কান বন্ধ রেখে বলতো; বলেই চলতো। রাজা বা ক্ষমতাশালীদের অনুগ্রহ লাভের আশায় সাধারণ মুরগিদের মূর্খের জ্ঞান দিতে দিতে নিজেরাও মূর্খ হয়ে গেল। এখন মুরগির রাজ্যে রাজা মূর্খ, বুদ্ধিজীবীরা মূর্খ, প্রজারা মূর্খ। সবাই মূর্খ। তারা ভবিষ্যতে কী কী হতে পারে তা দেখতে পেল না।
মহাঝড়ের ফলে রাজ্য বদলে গেল, সমাজ বদলে গেল; শাসনের নিয়মকানুনও বদলে গেল। পূর্বে রাজা শাসন করতো, এখন একটা দল শাসন করে। পূর্বে হতো জন্মগত শাসক; এখন হতো নির্বাচিত শাসক। প্রজারা তাদের শাসনের জন্য শাসক নির্বাচন করে দিতো। মুরগির রাজ্যে মুরগিরা যেহেতু সংখ্যা বেশি তাই বাঘদের মনে ভয় দেখা দিলো মুরগিরা একদিন বিদ্রোহ করতে পারে; মুরগিরা আলাদা দেশ করে আলাদা হয়ে যেতে পারে। বাঘদের কুমতলব হলো মুরগির সমাজ ধ্বংস করে দেবার। তাই মুরগিদের অঞ্চলে বাঘদের নিয়ে আসার কাজ শুরু করে দিলো। এরফলে মুরগির অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। বাঘের শাসনে ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা কমে গেল। এখন সমস্ত কিছু বাঘের হাতে চলে গেল। ক্ষমত ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য মুরগির রাজাও নির্বাচন করে বাঘের শাসনে অংশীদারী হতেন। কিন্তু সেই স্বভাবগত বশে রাজা তার প্রজাদের স্বার্থ ও কথা ভুলে যেতেন; নিজের ভোগবিলাসে মত্ত থাকতেন। আর প্রজাদের সাথে বাঘের আচরণ করতেন। এক রাজা মরে, আরেক রাজা আসে। কিন্তু মুরগিদের ভাগ্যে ও জীবনে কোনো পরিবর্তন হলো না। এভাবেই চলে থাকে মুরগিদের জীবন।
জগৎ পরিবর্তনশীল, সমাজ বিকাশশীল কথাটি মুরগিরা মুখে বললেও মনে বিশ্বাস করতো না এবং বুঝতে পারতো না। মূর্খতার কারণে সবকিছু চোখে দেখেও বুঝতো না। সংস্কার বা পরিবর্তনকে তারা বুঝতো শুধু মৃত্যুকে। মুরগিদের পাশে এক বিড়াল পরিবার বাস করতো। ঐ বিড়ালের পরিবারে এক বিড়াল ছানার জন্ম। মুরগি বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করতে করতেই বিড়াল ছানাটি বড় হয়ে ওঠে। মুরগি বাচ্চাদের সাথে সাথে বড় হওয়াতে কথাবার্তায় বিড়াল ছানাকে মুরগিরই মনে হয়। একসময় মুরগির নীতি ও ধর্মও পালন করতে থাকে বিড়াল ছানাটি; এখন যেন পুরোপুরি মুরগি।
প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে জগৎ যেমন পরিবর্তন হয়; তেমনই জ্ঞান ও সংগ্রামের শক্তির দ্বারা সমাজ এবং নিজে পরিবর্তন হতে পারে – এ চিন্তা যেসব মুরগি বুঝতো, যারা নিজের সমাজ ও জাতিকে ভালোবাসতো তারা অধিকার পাওয়ার জন্য বাঘের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলো। একসময় বাঘের সাথে মুরগির চুক্তি হলো। মুরগিদের স্বাধিকার বাঘরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলো। চুক্তিতে মুরগিদের বিষয় ও সমস্যা দেখা, মুরগিদের সাহায্য এবং উন্নতি করার জন্য বাঘের শাসনে একটা পদ রাখা হলো। শর্ত থাকে যে, ঐ পদে বসার জন্য মুরগি অঞ্চলের সদস্যরা এক মুরগিকে নির্বাচিত করবে। পদটি মুরগিদের শাসনাধিকার হওয়ায় ঐ পদে বাঘ বসতে পারবে না। তবে বাঘ-মুরগি সবাই ঐ পদে শাসক নির্বাচনের জন্য ভোট দেওয়ার অধিকার থাকে।
মুরগিদের অঞ্চলে পূর্বের তুলনায় বাঘের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বাঘ-মুরগির সংখ্যা প্রায় সমানে সমান। একদিন মুরগির অঞ্চলে শাসক নির্বাচনের জন্য ভোটের দিন আসে। মুরগিরা মূর্খ হওয়ায় যারা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে, কষ্ট করছে তাদের পছন্দ হলো না; রাজারা পূর্বে অনাচার করার কারণে তাদের পছন্দ হলো না; শেষ পর্যন্ত মুরগিরা পছন্দ করলো বিড়াল ছানাকে। ভোট চাওয়াতে মুরগির রাজাও বলতো, “আমি তোমাদের রাজা, আমার পিতা রাজা ছিল, আমি রাজার বংশধর, তোমারা আমাকে ভোট দাও।“ কিন্তু রাজা প্রজাদের কল্যাণে কৃত কর্মের উদাহরণ দেখাতে পারে না; প্রজাদের কল্যাণের কোনো চিন্তাও বলতে পারে না। রাজার প্রজা কল্যাণে কাজকর্ম না থাকায় এমনিতেই মুরগিরা রাজার উপর রুষ্ট। তার উপর রাজা আরো রাজা রাজা বলাতে প্রজারা আরো বেশি রুষ্ট হলো।
ঐদিকে বিড়াল ছানা বলতো, “আমি নির্বাচিত হলে রাজা যে প্রজার কল্যাণে কাজ করে নাই, আমি প্রজার কল্যাণে কাজ করবো। আমি তোমাদের মতো মাটি থেকে খাবার খোঁজে খায়, তোমাদের মধ্যে যে আমি বড় হয়েছি তা কোনো দিন ভুলে যাবো না।” এমন সময়ে কোনো কোনো প্রবীন মুরগি বলতো, তারা শুনেছে মারমাদের একটা প্রবাদ আছে ‘ক্রং ক্রীগে ক্যাহ ফ্রইটে (বিড়াল বড় হলে বাঘ হয়)’। এ বিড়াল ছানাটি বড় হলে বাঘ হতে পারে বলে অন্য মুরগিদের সতর্ক করেছিল। অন্য মুরগিরা কথাটি শুনতে চাইতো না। অন্য মুরগিরা বলতো, “তোমাদের রাজা তো শুধু রাজা রাজা বলে বেড়ায়, প্রজা কল্যাণের কথাই নেই; কিভাবে প্রজা কল্যাণ হবে, কি কল্যাণ করতে হবে কিছুই তো বলে না। নিজ রাজ্য শাসনের ক্ষমতা তো হারিয়েছে আবার আচরণ করে ইংরেজের মহারাজার মতো। ইংরেজের রাজাও তো এখন তার মতো আচরণ করে না।“ ফলে বিড়াল ছানাটির মনগলানো কথায় মুরগিদের মনগলে গিয়ে বিড়াল ছানাটিকে মুরগিরা তাদের প্রতিনিধি ও শাসক বানালো।
শাসক হওয়ার পর বিড়াল ছানাটি হৃষ্টপুষ্ট হলো, তার গায়ের হলুদ লোমে কালো দাগগুলো স্পষ্ট হতে লাগলো। ক্ষমতায় এবং চেহারায় বাঘের মতো হতে লাগলো। বিড়াল ছানাটি নিজের দিকে তাকিয়ে বাঘের মতোই মনে হয়। কিন্তু মুখের লজ্জায় নিজেকে বাঘ বলতে পারলো না। তবে মনে ভাবে, ‘আমি তো বাঘ; বিড়ালের পূর্বপুরুষেরা বাঘ’।
এই কারণে মুরগির চেয়ারে বসে থাকলেও বাঘের কথাই ভাবে; বাঘের কথাই বলে। বিড়াল ছানাটি বলে, “আমি মুরগিদের জন্য অনেক অনেক উন্নয়ন করেছি। মুরগিদের জন্য রাস্তা বানিয়েছি ও ধর্মঘর বানিয়েছি। মুরগিদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছি ইত্যাদি।” কিন্তু মুরগিদের পর্যাপ্ত খাবার, চিকিৎসা ক্ষমতা বাড়ানো ও সুখ-শান্তির জন্য ব্যবস্থা করার কোনো কথা বলে না। প্রশ্ন উঠলে বলে, ‘তোমাদের রাজারা কী করেছে? তোমাদের রাজারা তো তোমাদের জন্য কিছুই করেনি, যা করেছি আমিই করেছি’ ইত্যাদি বলে মুখ বন্ধ করে দিত। আর মুরগিরা তো মূর্খ। তারা চিন্তা করতে পারলো না। রাস্তাতে মুরগিদের চেয়ে বাঘদের লাভ বেশি। রাস্তার কারণে দ্রুত মুরগিদের দমন করতে পারে, বাঘদের ব্যবসা বেড়েছে, মুরগিদের সম্পদ শেষ হয়েছে তবে সেই তুলনায় উন্নতি বাড়েনি। মুরগিরা গাড়ি চড়তে পেরে খুশি কিন্তু গাড়ি চড়ে নিজের থেকে যে পয়সা দিতে হয় সেটা খেয়ালে থাকে না।
যখন চিকিৎসার জন্য অভাব পড়ে, খাবারের অভাব পড়ে – তখন একটু মুরগিদের মনে পড়ে, তাদের উন্নয়ন না হওয়ার কথা । কিছু দিন পর আবার ভুলে যায়। ধর্মঘর পেয়ে মুরগিরা খুশি হয় যেন দুই-এক দিন পরেই তারা স্বর্গে চলে যাবে। স্বর্গে গেলে খাবারের অভাব, রোগ থাকবে না। সুখ-শান্তি শেষ হবে না। ধর্মগুরুরাও তাই বলে। পৃথিবীতে কোনো সুখ নেই, শান্তি নেই। সব সুখ স্বর্গে। কোনো কোনো মুরগি অন্যদেশের সুখের কথা বললেও গুরুরা বলে সব মিথ্যা। বাস্তব চোখে দেখা গেলেও মিথ্যা। অনেক সময় যুক্তিতর্কে গুরুরা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও বলে, ‘এখন কলিযুগ। কলিযুগে পাথর পানিতে ভাসে, লাউয়ের খোল পানিতে ডোবে। আমরা হলাম ধার্মিক জাতি। অমঙ্গল ভাবতে পারি না।‘
প্রশ্ন ওঠে, নিজের জাতির উন্নতি, উন্নতির প্রয়োজনে অধিকার – তা কি অমঙ্গল ভাবনা? কলিযুগ সারা বিশ্বের জীবজন্তুর জন্য না হয়ে কি শুধুই মুরগিদের জন্য? এর উত্তরে বলে, ‘ধর্মকর্ম কর’। মুরগিদের গুরু ও বুদ্ধিজীবীসহ কেউ ভেবে দেখলো না, তাদের পূর্বপুরুষেরাও কতোই না ধর্মকর্ম করেছে; তার বদলে তাদের রাজা ও তাদের ক্ষমতা আর অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। একমাত্র আন্দোলনের কারণে ক্ষমতার অংশীদারে যুক্ত হলো। ভেবে দেখলো না, অন্যরা করলে ধর্মের ফল হয়, তারা করলে ধর্মের ফল হয় কেন? এর নিয়ম ও কারণ কী? শুধুই শোনানো হয় ধর্মের কাহিনী, জ্ঞানের আলোচনা হয় না; বিড়াল ছানাটির প্রশংসা চলে। শেখানো হয় অভাব, রোগ-শোক,দুঃখ অধর্মের কারণে; শাসনের কারণে নয়। এর ফলে হয়ে যায়, ক্ষমতাবানদের অন্যায়-দুর্নীতি-আত্মস্যাৎ করার ধর্মের কারণে।
জ্ঞানের আলোচনা না হওয়ায় মুরগিরা মূর্খ থাকে। এই মুরগিরা সামান্য এতটুকু চিন্তা করতেও জানলো না মুরগির আসনে বসে মুরগির ক্ষমতা ভোগ করে বিড়াল ছানাটি কেন মুরগিদের দুঃখ-কষ্ট, অভাব ও সমাজ ছোট হয়ে আসার ব্যাপারে কখনো বলে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলে কিন্তু ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে কিনা, শিক্ষক আছে কি না – তা বলে না কেন? আবার বাঘের সুরে সুরে তো বলে। নিশ্চয় বিড়াল ছানা বাঘ হয়ে উঠেছে। কিছুদিন পর পুরোপুরি বাঘ হতে পারে। এতটুকু চিন্তা শক্তি-সামর্থ্যও নেই মুরগিদের। শুধু শাসকের মুখের শব্দ শোনেই আনন্দ।