হিল ভয়েস, ৮ ডিসেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: সরকারের আন্তরিকতার অভাবে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন হচ্ছে না । সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। পার্বত্য চুক্তিতে পাহাড়ের আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর যে নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খারিজ করে দেওয়ার অপচেষ্টাও হচ্ছে।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪ বছরপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা: ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এমন বক্তব্য উঠে এসেছে। পার্বত্য চুক্তির ২৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) এ আলোচনা সভার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান।
গৌতম দেওয়ান তাঁর প্রবন্ধে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। এ ছাড়া তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইনের সংশোধন এবং প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি জানান।
শ্রী দেওয়ান আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বরং প্রতিনিয়ত উন্নয়নের নামে, পর্যটনের নামে পাহাড়ে ভূমি বিষয়ক নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ে পর্যটন ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাজার হাজার জুমভূমি বহিরাগতদের কাছে লিজ দেওয়া হচ্ছে। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
সরকারের আন্তরিকতার অভাবে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, ‘সরকারপক্ষ বা যারা চিন্তাভাবনা করে, তারা মনে করে, ওরা (পাহাড়ি জনগোষ্ঠী) এখন বিভিন্নভাবে দ্বন্দ্বে বিভক্ত। ওরা দুর্বল হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে ভাবনার দরকার নেই। কাজেই ওখান থেকে ওদেরকে উচ্ছেদ করা যাবে।’ তিনি হুশিয়ারি উচ্চারন করে বলেন, ‘সরকার এরকম ভাবলে ভুল করবে। জুম্ম জনগণ অধিকার চায়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা লড়াই করতে জানে।‘
সভাপতির বক্তব্যে মানবাধিকারকর্মী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো–চেয়ার সুলতানা কামাল বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল, সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমরা সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেখানে শান্তির কোনো আভাস আমরা পাচ্ছি না। সেখানে জনসংখ্যার সমীকরণ বদলে গেছে। নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দলীয়করণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন সেখানে বিরাজ করছে। তার ফলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখন চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের অনীহা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেকের ধারণা, প্রধানমন্ত্রী ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর পদক্ষেপগুলো স্পষ্ট করছেন না। আমরা আশা করব, তিনি আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে যেভাবে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহ দেখিয়েছেন, চুক্তি বাস্তবায়নেও তাঁর পদক্ষেপ স্পষ্ট করবেন।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্য ও বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, ২৪ বছর আগে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। সে সময় রাষ্ট্রের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এ চুক্তি করেছিল। কিন্তু চুক্তিতে যে শাসনব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকারের কথা বলা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষ করে ভূমি সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বর্তমানে পাহাড়ে পর্যটনের নামে পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে যা পার্বত্য চুক্তিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে উপেক্ষা করার সামিল। তিনি বলেন, পাহাড় কিছু মানুষের কাছে লাভজনক হয়ে উঠেছে। সেখানে পর্যটনের রিসোর্ট করা হচ্ছে। অথচ সারা দেশের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ে দারিদ্র্য অনেক বেশি।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করলেও বিগত ৫০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভূমি সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমি কমিশনই বর্তমানে একটি অন্তরায় হয়ে আছে। কারণ এ কমিশনের অর্থ নাই, লোকবল নাই, এমনকি এর বিধিমালাও প্রণয়ন করা হয়নি। ২০১৬ সালে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভূমি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারাসমূহ সংশোধন করা হলেও ৬ বছরেও কমিশনের বিধিমালা অনুমোদিত হয়নি। অনেক আইন বা বিধিমালা খুব অল্প সময়ে প্রণয়ন করা হলেও বিগত ৬ বছরে পার্বত্য ভূমি কমিশন বিধিমালা অনুমোদন হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের ভেতরেই এমন কোন মহল রয়েছে যারা চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘পাহাড়ে আমরা প্রতিনিয়ত সামরিক শাসনের সম্মুখীন হচ্ছি। বাকস্বাধীনতা ও চলাফেরার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। যারা চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী, তাদের সাথেই পাহাড়িদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। বরং নিরাপত্তার অজুহাত, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইত্যাদির তকমা দিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীকে পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য প্রফেসর মংসানু চৌধুরী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার করা হচ্ছে মূলত পাহাড়ে সামরিকায়নকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। যারা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলছে আজ তাদেরকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হচ্ছে। আমরা চাইনা পার্বত্য চট্টগ্রামে আর কোন রক্ত ঝরুক। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুমাত্রিক সমস্যার আশু সমাধান হওয়া দরকার।’
উন্নয়ন কর্মী লেলুং খুমী বলেন, ‘পর্যটন সম্প্রসারণ, উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের ভূমি অধিগ্রহণ অব্যাহত থাকায় প্রতিনিয়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ আতংকে দিন কাটাতে হচ্ছে। সবকিছু মিলে পাহাড়ে সবসময় একটা ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজমান রয়েছে। এসব সংকট রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া দরকার। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ খুবই প্রয়োজন।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের বসতভিটা ও ভূমি ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানান।