হিল ভয়েস, ৯ ডিসেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আদিবাসী রাখাইনদের ভূমি অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে।রাখাইনদের জবরদখল হওয়া ভূমি, উপাসনালয় ও শ্মশানের জমি পুনরুদ্ধার ও প্রত্যর্পণ নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘু নয় সংখ্যাশুন্য হতে চলেছে পটুখালীর রাখাইন আদিবাসীরা। আজ বৃহষ্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে সরেজমিন তদন্তকারী নাগরিক প্রতিনিধিদল এসব দাবি তুলে ধরেন।
পটুয়াখালী জেলায় বসবাসরত রাখাইন জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও সংকটের ধরন পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪ সদস্যের নাগরিক প্রতিনিধিদল গত ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর ২০২১ কয়েকটি রাখাইন জনপদ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। নাগরিক প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামে পৌঁছে স্থানীয় রাখাইন পরিবারসমূহের সদস্যসহ অন্যান্যদের সাথে কথা বলে এসেছেন। এর মধ্যে ছিল টিয়াখালী ইউনিয়নের ছয়আনী পাড়া ও চৈয়াপাড়া, মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের তুলাতলীপাড়া ও মধুপাড়া, কুয়াকাটা পৌর এলাকার কেরানীপাড়া এবং লতাচাপলী ইউনিয়নের মিশ্রিপাড়া। প্রতিনিধিদলের পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আজ বৃহষ্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমিলা’র সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, নাগরিক উদ্যোগ এর নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন এবং এএলআরডি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার আজিম হায়দার। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
লিখিত বক্তব্যে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সারা দেশে আদিবাসীরা নানাভাবে শোষণ, বঞ্চনা, ভূমি উচ্ছেদ ও শঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করছে, এটা আমরা জানি, কিন্তু পটুয়াখালী অঞ্চলের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা যারপরনাই শোচনীয়। রাখাইনরা প্রথম এ এলাকায় কুয়া খনন করেছিল, তাই নাম হয়েছে কুয়াকাটা। অধিকাংশ রাখাইন আদিবাসী আজ দেশান্তরি, বিপন্ন; কেবল সংখ্যালঘু নয় বরং তারা সংখ্যাশূন্য হতে চলেছেন।
তিনি আরো বলেন, যেখানে কয়েক দশক আগেও লক্ষাধিক রাখাইনের পদচারণে মুখরিত ছিল, সেখানে তাদের সংখ্যা বর্তমানে মাত্র আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। ১৯৪৮ সালে পটুয়াখালীতে ১৪৪টি ও বরগুনায় ৯৩টি রাখাইনপাড়া ছিল, বর্তমানে সেখানে যথাক্রমে ২৬টি ও ১৩টি পাড়া টিকে আছে। এর মধ্যে সর্বশেষ যে রাখাইন পাড়াটি এ বছর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেটি হলো ছয়আনি পাড়া। পায়রা বন্দরের জন্য অধিগ্রহণের কবলে পড়ে পাড়াটি বিলুপ্ত হয়েছে।
আদিবাসী রাখাইনদের সকল উৎসব ছিল ভূমি কেন্দ্রিক দাবী করে তিনি আরো বলেন, রাখাইন দের জমি, পুকুর, শ্মশানসহ সবকিছু দখল হয়ে যাচ্ছে বলেই নিজভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন তারা। জালিয়াতির মাধ্যমে জমি জবরদখল, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী দালাল চক্রের দৌড়াত্ম এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা তাদের ভূমি হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাখাইনদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে তার ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে এই অঞ্চলে রাখাইনদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমরা দেখতে চাই আর যেন একটি রাখাইন পাড়াও নিশ্চিহ্ন না হয়। একই সাথে আমরা চাই উচ্ছেদ হওয়া রাখাইন পরিবারগুলোকে যথাযথভাবে তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে পুণর্বাসন নিশ্চিত করার দাবীও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, সেখানে না গেলে বোঝা যায় না পরিস্থিতি কত ভয়াবহ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর কত উৎসব উৎযাপিত হচ্ছে এখানে। কিন্তু আজ রাখাইন আদিবাসীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দিনে-দুপুরে পুকুর ছুরি হচ্ছে। বৌদ্ধ মন্দিরের পথ ব্লক করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এসডিজি’র মূলকথা-কাউকে পেছনে রাখা যাবে না। কিন্তু আমরা তো তাদেরকে (আদিবাসীদেরকে) পেছনে রেখেই সবকিছু করছি। কিছু ভূমিদস্যু প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব হচ্ছে কাজেই প্রশাসনও এই দায় এড়াতে পারে না। রাস্তার কোনো দোকানে টাইপ করা কাগজ নিয়ে সেখানে জমি দখল করে দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে বলে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। এসব নিয়ে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট করারও আহ্বান জানান তিনি।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, স্বাধীনতার পর যদি খেয়াল করেন আদিবাসী ও সংখ্যালঘু যারা আছেন তাদের জায়গা, জমি দখল করা হয়েছে। তাদের সম্পত্তি এবং নারী নির্যাতন হয়েছে। তারা যেন কথা বলতে না পারে, অধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে না পারে। এইসব দেখার জন্য একটা কমিশন করা দরকার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের জমি দখল করেছে, নিপীড়ন করেছে। গণতন্ত্রহীনতার জন্যই এসব হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। গণতন্ত্র যদি শক্তিশালী হত তাহলে এসব নির্যাতন ও নিপীড়ন অনেক ক্ষেত্রেই কমে যেত বলেও মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী।
সভাপতি’র বক্তব্যে এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা হয়ত লিখিতভাবে দেওয়া যায় না। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছি। আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কিন্তু বিজয়ের পাশাপাশি অনেক লজ্জ্বা আমাদের আছে। বাংলাদেশ আসলে ভূমি লুন্ঠনের ভূসর্গ। ক্রমাগত প্রশাসনের ছত্রছায়ায় অনেক ভূমিসস্যু ভূমি দখল করেছে। একদিকে ভূমি প্রশাসনের দুর্নীতি, তাদের সহায়তায় অনেকেই ভুয়া কাগজ বানয়ে ভূমি দখল করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সমস্ত জেলাগুলোতে ভূয়া, জাল দলিল তৈরীর কারখানা তৈরী হয়ে আছে। প্রশাসনের একটি গোষ্ঠী এটি মদদ দেয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের সভ্যতা, কৃষি, অর্থনীতিসহ সমস্ত কিছুর এতটা অপরিহার্য অংশ রাখাইন জনগোষ্ঠীর মানুষ বলেও দাবী করেন তিনি। আদিবাসীদের রক্ষা করতে না পারলে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সাথে বেঈমানী করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা থেকে আমরা অনেক দূরে সড়ে গেছি। এখন সময় এসেছে সবাইকে সাথে নিয়ে যারা পেছনে আছে তাদেরকে সামনে নিয়ে আসার। কিন্তু যারা পেছনে আছেন তাদেরকে আরো পেছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
বেদখলকৃত বৌদ্ধ বিহারের জমি ও রির্জাভ পুকুর বেদখলমুক্ত করা, রাখাইন ভাষা রক্ষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অবিলম্বে রাখাইন ভাষায় শিশু শিক্ষা কার্যক্রম শুরু এবং বিদ্যালয়সমূহে রাখাইন শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার সুয়োগ দেয়া, রাখাইন সংস্কৃতি রক্ষা, বিকাশ ও চর্চার লক্ষে রাখাইন কালচারাল একাডেমিকে সক্রিয় করা সহ ১৩ দফা দাবীও উত্থাপন করা হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে।