মঙ্গল কুমার চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। জুম্ম জনগণ তথা দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি আশা করেছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা সরকার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তাই স্বভাবতই সকলেই প্রত্যাশা ছিল যে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসীরা স্বশাসন পেতে যাচ্ছে এবং যুগ যুগ ধরে চলমান বঞ্চনা, বৈষম্য ও অবহেলার অবসান ঘটিয়ে পার্বত্যবাসী একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ও জুম্ম জনগণ স্বকীয় জাতীয় বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে আত্মমর্যাদাপূর্ণ জীবন ফিরে পেতে যাচ্ছে।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে শেখ হাসিনা সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বা ধারা বাস্তবায়ন করেছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল- ভারত থেকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা, আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য পরিষদ আইন প্রণয়ন, পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে তিন দফায় ১০০টি ক্যাম্প প্রত্যাহার, চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, পার্বত্য ভূমি কমিশন ও প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স প্রভৃতি কমিটি গঠন করা, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রণালয় স্থাপন করা, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কিছু বিষয় হস্তান্তর করা ইত্যাদি অন্যতম।
কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, পার্বত্য চুক্তির কিছুদিন যেতে না যেতেই শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম গ্রহণ করতে থাকে। চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সরকারের একের পর এক চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা উন্মোচিত হতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় অনেকে মনে করেছিল যে, এটা হয়তো সরকারের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও সাময়িক আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা। সকল প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা সরকার সত্যিকারভাবে আন্তরিকতা ও পূর্ণ সচ্ছিদা নিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় থাকবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ততই শেখ হাসিনা সরকারের একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা জোরদার হতে থাকে।
পার্বত্য চুক্তির পর শেখ হাসিনা সরকার দীর্ঘ পৌনে চার বছর সময় পেলেও সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার কারণে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ সেভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ বক্তব্য দিতে থাকে যে, চুক্তির পর চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামীলীগ সরকার তেমন সময় পায়নি। আর তারপর প্রায় ৭ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। তাই নির্বাচনকালে শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন যে, নির্বাচনে জয়যুক্ত হলে চুক্তির পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি ক্রমাগত ১৩ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। পক্ষান্তরে পূর্বের মতো একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। শুধু তাই নয়, চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে সামরিকায়নের মাধ্যমে ফ্যাসীবাদী কায়দায় সমস্যা সমাধানের নীতি গ্রহণ করে শেখ হাসিনা সরকার। বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো বর্তমান সময়ে শেখ হাসিনা সরকার একদিকে জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলীকরণের তৎপরতা, অন্যদিকে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে জুম্ম জনগণ চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতার ফলে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হতে বসেছে। শেখ হাসিনা সরকার একদিকে সামরিকায়নের মাধ্যমে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়ন, অন্যদিকে ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে জুম্মদের ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং পার্বত্যাঞ্চলের বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্যতা ধ্বংস করে চলেছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্তমানে চুক্তি-পূর্ব অবস্থায় চলে গেছে। সরকারের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে জুম্ম জনগণের পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন তাদের পেছনে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই আজ জুম্ম জনগণ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। বলা যায়, শেখ হাসিনা সরকারই জুম্ম জনগণকে নতুন করে আবার উচ্চতর আন্দোলনের দিকে জোর করে ঠেলে দিয়েছে। তাই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে এক সংঘাত ও সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং তার জন্য পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী শেখ হাসিনা সরকারই প্রধানত দায়ী।
নিম্নোক্তশেখ হাসিনা সরকারের পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতা তুলে ধরা হলো-
১। শেখ হাসিনা সরকারের পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সর্বপ্রথম তৎপরতা দেখা গিয়েছিল পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়নের সময়। অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা সংজ্ঞায় “যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা-জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণত বসবাস করেন”- এসব শব্দাবলীর মধ্যে ষড়যন্ত্রমূলক উদ্দেশ্যে ‘এবং’ শব্দের স্থলে ‘বা’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত করে পার্বত্য জেলা পষিদ আইন ১৯৯৮ পাশের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার গোড়াপত্তন করে শেখ হাসিনা সরকার। পরে জনসংহতি সমিতির প্রবল প্রতিবাদের মুখে তা সংশোধন করা হলেও উন্নয়ন সংক্রান্ত ধারা ত্রুটিপূর্ণভাবে প্রণয়ন করে সরকার।
২। চুক্তি বিরোধী দ্বিতীয় তৎপরতা ছিল চুক্তি মোতাবেক অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ গঠনে সরকারের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ। অলিখিত চুক্তি ছিল যে, অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ জনসংহতি সমিতি গঠন করবে। জনসংহতি সমিতির প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পরিষদের
সদস্যদের মধ্যে পাহাড়ি সদস্যদের নাম গ্রহণ করলেও তিনজন বাঙালি সদস্যদের নাম বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগের মনোনীত বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে শেখ হাসিনা সরকার।
৩। চুক্তি বিরোধী তৃতীয় তৎপরতা ছিল সেটেলারদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পুনর্বাসনের শেখ হাসিনা সরকারের ষড়যন্ত্র। চুক্তিতে কেবল পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কথা রয়েছে। কিন্তু সেই বিধানকে লঙ্ঘন করে সেটেলারদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগ থেকে ১৯ জুলাই ১৯৯৮ তারিখে এক আদেশপত্র জারি করা হয়। এই ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পাহাড়ি উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদেরকে তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসন প্রদানের কাজ বাধাগ্রস্ত করে রেখে দিয়েছে। ফলে পাহাড়ি উদ্বাস্তু ও ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থীরা এখনো যথাযথ পুনর্বাসন পায়নি। এই নির্দেশনা প্রত্যাহারের জন্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত হলেও তা এখনো শেখ হাসিনা সরকার প্রত্যাহার করেনি।
৪। চুক্তি বিরোধী আরেকটি তৎপরতা হচ্ছে জেলা প্রশাসকদেরকে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ। চুক্তিতে কেবল সার্কেল চীফদেরকে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের বিধান করা হয়েছিল, যা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সেই বিধানকে লঙ্ঘন করে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে ২১ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে ইস্যুকৃত এক অফিসাদেশে তিন সার্কেল চীফের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদেরও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। বস্তুত একটা সংসদীয় আইনকে লঙ্ঘন করে এধরনের অফিসাদেশ জারি করা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার সেই আইন বিরোধী কাজও করতে দ্বিধাবোধ করেনি। বার বার দাবি করা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকার এখনো উক্ত অফিসাদেশ প্রত্যাহার করেনি। এই ক্ষমতা বলে জেলা প্রশাসকরা পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন বহিরাগত বাঙালিদেরকে স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র দিয়ে চলেছেন। উক্তরূপ সনদপত্র বিশেষত চাকরি, জমি বন্দোবস্ত, ঋণ গ্রহণ, ভোটার তালিকাভুক্তি বা কোটা ব্যবস্থাধীনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৫। ২০০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় খাগড়াছড়ি জেলার সদর ও মহালছড়ি উপজেলার গামারীঢালা, বিজিতলা, নুনছড়ি, পাগুজ্যাছড়ি, কাটিং টিলা, লেমুছড়ি, জয়সেন কার্বারী পাড়া ইত্যাদি জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়াগা-জমি জবরদখল করে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ করা হয়।
৬। ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ হতে শেখ হাসিনা সরকার একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি করে। যার বদৌলতে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, বিচারব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ও কর্তৃত্ব করে চলেছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।
৭। আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে শেখ হাসিনা সরকার ১৭ জুলাই ২০০১ তারিখে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন’ প্রণয়ন করে, যেখানে চুক্তির সাথে অনেক বিরোধাত্মক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ২০১৬ সালে আইনটির এসব বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। এরপর ২০১৬ সাল থেকে আজ অবধি ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নে শেখ হাসিনা সরকার আবার টালবাহানা করে চলেছে। এই বিধিমালা প্রণীত না হওয়ায় ভূমি কমিশন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ করতে পারছে না। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালির সংঘাত প্রায়ই সংঘটিত হয়ে থাকে।
৮। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় ভোটার তালিকা প্রণয়নের পরিবর্তে চুক্তি লঙ্ঘন করে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০১ সালে স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে তিন পার্বত্য জেলার ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের আরেকটি অন্যতম চুক্তি বিরোধী তৎপরতা।
৯। চুক্তি বিরোধী তৎপরতার মধ্যে অন্যতম ছিল সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন না করা। সমঝোতা বৈঠক চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবির প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলকে বারংবার জানান যে, প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন যে উনিশ্শো আশি দশকে বসতি প্রদানকারী সেটেলারদেরকে সমতল অঞ্চলে পুনর্বাসন দেয়া হবে। তবে বিশেষ কারণে তা চুক্তিতে উল্লেখ করা যাবে না। ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের দিনও জনসংহতি সমিতির সভাপতির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের নিকট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত ও আশ্বাস প্রদান করেন। কিন্তু সেই অলিখিত চুক্তি সরকার এখনো বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি লঙ্ঘন করে বরঞ্চ সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ও সমতল জেলাগুলো থেকে বহিরাগত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বসতি প্রদান করে চলেছে।
১০। পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আরেক তৎপরতা হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের সময় পার্বত্য চুক্তির বরখেলাপ। শেখ হাসিনা সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির সমঝোতা বৈঠক চলাকালে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে পার্বত্য চুক্তি এবং চুক্তি মোতাবেক প্রণীতব্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা আইনের সাংবিধানিক গ্যারান্টি দাবি করা হয়েছিল। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, সংবিধান সংশোধনের মতো জাতীয় সংসদে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যদি ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে পার্বত্য চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইনগুলোর সাংবিধানিক গ্যারান্টি দেয়া হবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় সংবিধান সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলোকে সংবিধানের প্রথম তফসিলে ‘কার্যকর আইন’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হলেও সরকার সেই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি, যা ছিল চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন ও চুক্তি বিরোধী আরেকটি অন্যতম কার্যক্রম।
১১। চুক্তির বিরুদ্ধে ২০০০ সালে ও ২০০৭ সালে দায়েরকৃত পৃথক দু’টি মামলায় গত ১২-১৩ এপ্রিল ২০১০ হাই কোর্ট থেকে আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অসাংবিধানিক মর্মে অবৈধ ঘোষণা করে যে রায় দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়কে আপীল বিভাগে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করে। আপীল বিভাগে চলমান আপীল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির কোন উদ্যোগ বিগত ১২ বছরেও সরকারের তরফ থেকে গ্রহণ করা হয়নি, যা চুক্তির প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের অসদিচ্ছা ও অবজ্ঞার প্রতিফলন বলে বলা যেতে পারে।
১২। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের পরিবর্তে শেখ হাসিনা সরকার দলীয় সদস্যদের দিয়ে অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করে চলেছে এবং পার্বত্যবাসীর বিরোধীতা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে দলীয়করণের মাধ্যমে পরিচালনা করার হীনউদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী পরিষদের সদস্য-সংখ্যা পাঁচ থেকে ১৫ জনে বৃদ্ধি করে একতরফাভাবে ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করেছে। তার মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার গণবিরোধী ও দলীয়করণের ধারা আরো জোরদার করেছে। অপরদিকে চুক্তিকে পদদলিত করে শেখ হাসিনা সরকার ২০১৪ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন প্রণয়ন করে। অথচ ২০০০ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচনের জন্য নিবার্চন বিধিমালা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নের কাজ শেখ হাসিনা সরকার নির্লজ্জভাবে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে।
১৩। জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি প্রত্যর্পণের পরিবর্তে শেখ হাসিনা সরকার ঠেগামুখে স্থল বন্দর স্থাপন, ঠেগামুখ-চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়ক ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, সেনাবাহিনী কর্তৃক অনেক বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বিজিবির বিওপি স্থাপন, কাচলং-সীতা পাহাড় ভূ-গঠনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন ইত্যাদি তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
১৪। চুক্তি বিরোধী আরেকটি তৎপরতা হলো শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর না করা। চুক্তি লঙ্ঘন করে শেখ হাসিনা সরকার এসব বিষয়াদি পূর্বের মতো জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সেনাবাহিনীসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালনা করে চলেছে। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি।
১৫। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০২১) কমপক্ষে ১৫টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। তম্মধ্যে ৪ এপ্রিল ১৯৯৯ বাঘাইহাট, ১৬ অক্টোবর ১৯৯৯ বাবুছড়া, ১৮ মে ২০০১ বোয়ালখালী-মেরুং, ২৫ জুন ২০০১ রামগড়, ১৯-২০ ফেব্রুযারি ২০১০ বাঘাইহাট, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ খাগড়াছড়ি, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ লংগদু, ১৭ এপ্রিল ২০১১ রামগড়-মানিকছড়ি, ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা, ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ রাঙ্গামাটি, ৩ আগস্ট ২০১৩ তাইন্দং-মাটিরাঙ্গা, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ কমলছড়ি-বেতছড়ি, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ বগাছড়ি, ১৭ অক্টোবর ২০১৫ রাঙ্গামাটি কলেজ, ২ জুন ২০১৭ লংগদু ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ছিল অন্যতম। জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং উগ্র জাতীয়তবাদী শক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে এসব সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করা হয়েছে। কিন্তু এধরনের নৃশংস হামলার কোন ঘটনারই দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। শেখ হাসিনা সরকার এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কার্যত দায়মুক্তি দিয়ে চলেছে।
১৬। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষাকে অবহেলিত অবস্থায় রেখে শিক্ষা প্রসারের নামে তথা চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী রাজনৈতিক কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
১৭। জুম্মদের মধ্যে তাবেদার গোষ্ঠী সৃষ্টি করে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব কর্তৃক সৃষ্ট সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ, জেএসএস (এমএন লারমা) সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি, আরএসও, আরসাসহ পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সদস্যদের রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং, লংগদুর তিনটিলা, দীঘিনালার বাবুছড়া, রাঙ্গামাটি জীবতলীসহ বিভিন্ন স্থানে এবং মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়ায় সশস্ত্রভাবে মোতায়েন রেখে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও চুক্তি সমর্থকসহ সাধারণ লোকের উপর সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে।
১৮। শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিকে ধ্বংস করতে শেখ হাসিনা সরকার আজ উঠেপড়ে লেগেছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ জুম্ম জনগণের উপর সেনা অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের, নারীর প্রতি সহিংসতা, অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল, চুক্তি বিরোধী অপপ্রচার ইত্যাদি মানবতা ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
১৯। পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আরেকটি অন্যতম তৎপরতা হলো চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। অপরদিকে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ২৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত এবং সরকার এসব ধারা লঙ্ঘন করে চলেছে, এবং অবশিষ্ট ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সরকার অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এটা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করার হীনউদ্দেশ্যেই চুক্তি স্বাক্ষরকারী শেখ হাসিনা সরকার এভাবে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিবেচনা করা যায়।