হিল ভয়েস, ১০ নভেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং জুম্ম জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আজ ১০ নভেম্বর ২০২১ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এব প্রচারপত্র প্রকাশ করেছে। উক্ত প্রচারপত্রে কঠিন জাতীয় ঐক্য-সংহতি জোরদার করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ে জুম্ম জনগণের বৃহত্তর আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে জনসংহতি সমিতি। জনসংহতি সমিতির উক্ত প্রচারপত্র নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো-
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং জুম্ম জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রচারপত্র
প্রিয় সংগ্রামী জনতা,
আজ শোকাবহ ১০ই নভেম্বর। জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ এবং সর্বোপরি দেশের সকল নিপীড়িত জাতি ও মানুষের জন্য এ এক গভীর শোকাবহ ও তাৎপর্যময় দিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনে দিবাগত রাতে পার্টির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদী, উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের এক বিশ্বাসঘাতকতামূলক সশস্ত্র আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে আটজন সহযোদ্ধাসহ শাহদাৎ বরণ করেন জুম্ম জনগণের প্রাণের মানুষ, মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
একের পর এক বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর নির্মম ও বর্বরোচিত দমন-পীড়নে জর্জরিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব যখন চরম অবলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছিল, ঠিক তখনি তিনি মুক্তির অগ্নিমন্ত্র নিয়ে জুম্ম জাতিকে প্রগতিশীল জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগরিত করে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁরই নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের প্রথম ও একমাত্র লড়াকু রাজনৈতিক পাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর সংগ্রামী চেতনা ও চিন্তাধারা এবং তাঁর অনুসরণীয় কাজের দৃষ্টান্ত আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ এবং জুম্ম জনগণসহ বিশ্বের মুক্তিপাগল নিপীড়িত মানুষের বিপ্লবী সংগ্রামের পাথেয় হয়ে থাকবে।
জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে প্রতিনিয়ত কঠিন প্রতিকুলতার মুখে সশস্ত্র আন্দোলন করতে গিয়ে নিজেদের অমূল্য জীবন দান করে গেছেন পার্টির শত শত কর্মী ও বীরযোদ্ধা। সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি চলমান গণআন্দোলনে সামিল হয়ে বীরত্বের সাথে শাহাদাৎ বরণ করেছেন মুক্তিপাগল অসংখ্য মানুষ। ১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পরও সেনাবাহিনী তথা শাসকগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আক্রমণে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন অনেক বিপ্লবী ও অধিকারকামী ব্যক্তিবর্গ।
আজ এই জাতীয় শোক দিবসে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মহান নেতা এম এন লারমাসহ মহান বীর শহীদদের অমূল্য অবদান ও অমর আত্মবলিদান গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। এছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে নানাভাবে অংশগ্রহণ করার কারণে পার্টির অনেক কর্মী ও সংগ্রামী ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন কারাগারে অন্তরীণ হয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে পঙ্গুত্ব জীবন বরণ করেছেন। অসংখ্য নারী ও শিশু পাশবিক ও নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। জনসংহতি সমিতি সেসব কর্মী ও ব্যক্তিবর্গের অমূল্য ত্যাগ ও অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছে এবং সকল শহীদ, বন্দী, পঙ্গু কর্মী ও ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছে।
বিশ্বাসঘাতক, ক্ষমতালিপ্সু, জাতীয় কুলাঙ্গার বিভেদপন্থী চক্র আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলেও এখনো তাদের উত্তরসূরী জাতীয় বেঈমান ও বিভেদকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী তথা শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায় পার্বত্য চুক্তি-উত্তর সময়ে নানা নামে নানা ধঙে সংগঠন সৃষ্টি করে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সংস্কারপন্থী খ্যাত বিভেদপন্থীদের কতিপয় প্রেতাত্মা মৃত এম এন লারমার নাম ব্যবহার করে তথাকথিত পার্টি গঠন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জুম্ম জনগণের মধ্যে আত্মঘাতি সংঘাত ও হানাহানি চালিয়ে যাচ্ছে। এমনিতর পরিস্থিতিতে ১০ই নভেম্বর ’৮৩-এর পরে বিভেদপন্থীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আঘাত হানার মাধ্যমে যেভাবে নির্মূল ও ইতিহাসের আস্তাকূড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে, সেভাবে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তথা সর্বাত্মক উপায়ে আঘাত হেনে নব্য বিভেদপন্থী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মমদপুষ্ট সন্ত্রাসী দলসমূহের সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করি।
প্রিয় বিপ্লবী জনতা,
এম এন লারমার গড়ে তোলা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাকার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির কিছু ধারা-উপধারা বাস্তবায়িত হলেও এখনো দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার, যে সরকার ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সাথে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, সেই সরকার ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও, চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। ফলে বিগত ২৪ বছরেও পার্বত্য সমস্যার কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক সমাধান হওয়া তো দূরের কথা, সমস্যা আরো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা চুক্তি-পূর্ব অবস্থায় ফিরে গেছে বলে বলা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের নীতি গ্রহণ করেছে। তদুদ্দেশ্যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন জোরদার করেছে। জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনা অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের, অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল, চুক্তি বিরোধী অপপ্রচার ইত্যাদি মানবতা ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
দেশে-বিদেশে প্রবল প্রতিবাদসহ স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী কর্তৃক বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ করছে। অপরপক্ষে পর্যটন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের দোহাই দিয়ে সেনাবাহিনী জুম্মদের ভূমি বেদখল ও জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলায় মুসলিম সেটেলারদের মদদ দিয়ে চলেছে এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’-এর ব্যানারে মুসলিম সেটেলারদেরকে পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।
প্রিয় অধিকারকামী জুম্ম জনতা,
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ভূলণ্ঠিত করে সত্তর দশকের মতো জুম্ম জনগণকে আবারো দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিকায়ণ করে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের মাধ্যমে, জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম (ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং) গ্রহণের মাধ্যমে, ভূমি বেদখল ও জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে, জুম্মদের উপর বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে, বহিরাগত মুসলিম জনগোষ্ঠী বসতিপ্রদান ও অনুপ্রবেশের মাধ্যমে, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে।
জুম্ম জনগণ অধিকারকামী ও সংগ্রামী। জুম্ম জনগণের রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাস। জনগণ সংগ্রামী বলেই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জুম্ম জনগণ ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যায়নি। হাজার প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জুম্ম জনগণের মধ্যে রয়েছে অযুত সম্ভাবনা। দীর্ঘ সংগ্রামে পোড় খাওয়া, জ্ঞানগরিমায় উন্নত, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এবং অধিকার সচেতন জুম্ম জাতি নিশ্চয়ই অন্যায় শাসন, শোষণ ও আধিপত্য কোনোভাবে মেনে নিতে পারে না। শাসকগোষ্ঠীর যে কোন ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার-উৎপীড়নকে গুড়িয়ে দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণ তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। কোনো যুক্তিতে ও অজুহাতে জুম্ম জনগণের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ও স্বাধিকার কেড়ে নিয়ে জুম্মদের জাতিগতভাবে ধ্বংসের অধিকার কারো থাকতে পারে না। জুম্ম জনগণের দাবি ও আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত। তাই আসুন, মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে জুম্ম জনগণের মধ্যে ইস্পাত-কঠিন জাতীয় ঐক্য-সংহতি জোরদার করি, শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াই এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ে জুম্ম জনগণের বৃহত্তর আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নিই।