হিল ভয়েস, ২০ নভেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হলুদ-আদা চাষ সীমিত করার ব্যাপারে কঠোর নজরদারী বৃদ্ধি করতে এবং নিরুৎসাহিত করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ২৯ আগষ্ট ২০২১ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের পক্ষে মেজর এইচ এম মোহাইমিন বিল্লাহ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত “বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জুম (হলুদ/আদা) চাষের নিমিত্তে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টকরণ প্রসঙ্গে” শীর্ষক এক নির্দেশনায় উক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অবহিত করা হয়।
উক্ত নির্দেশনায় বলা হয় যে, “পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসরত পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজন ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত জীবনধারণের জন্য প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ‘জুম’ চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে প্রস্তুত করে থাকে, যা একটি নৈমিত্তিক বিষয়। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে জুম চাষ প্রবর্তিত হওয়ায় পার্বত্য এলাকায় জীববৈচিত্র এবং প্রকৃতির উপর চরম ও সুদূর প্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।”
উক্ত নিদের্শনায় উক্ত বিষয়ে চারটি বিবরণ দেয়া হয় এবং চারটি মতামত/সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেই সাথে ‘জুম (হলুদ/আদা) চাষের নিমিত্তে পাহাড়ে অগ্নিসংযোগের আলোকচিত্র’ শীষর্ক ৬টি ছবি সংযুক্ত করা হয়, যেখানে ‘পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কর্তৃক জুম চাষের জন্য বনাঞ্চলে আগুন দেয়ার স্থিরচিত্র’ ২টি ছবি এবং ‘পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কর্তৃক জুম চাষের জন্য বনাঞ্চল আগুন পুড়িয়ে দেয়ার পরবর্তী বৃক্ষনিধনের স্থিরচিত্র’ ৪টি রয়েছে।
উক্ত নির্দেশনায় নিম্নোক্ত চারটি মতামত/সুপারিশ পেশ করা হয়-
ক। জুম চাষের সময় অবৈধভাবে পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী জনগোষ্ঠী কর্তৃক যে পাহাড়ের বড় বড় গাছপালা কেটে/আগুন লাগিয়ে পাহাড় ধ্বংস না হয় সেজন্য বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি কর্তৃক নিয়মিত নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
খ। পাহাড়ি এলাকায় হলুদ/আদা চাষ সীমিত আকারে করার ব্যাপারে কঠোর নজরদারী বৃদ্ধি করা এবং এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হলুদ, আদা চাষ নিরুৎসাহিত করতে সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাণিজ্যিক বিপণন বন্ধে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিকল্প চাষাবাদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে।
গ। Reserve Forest রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এক্ষেত্রে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন বলে প্রতীয়মান।
ঘ। পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে গণ-সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দায়িত্বপূর্ণ এলাকার বেসামরিক প্রশাসনের সাথে সমন্বয় পূর্বক এলাকার জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে সভা সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে।
মানবাধিকার কর্মী প্রীতিবিন্দু চাকমা বলেন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের এই নির্দেশনা চরম জনস্বার্থ পরিপন্থী, বর্ণবাদী এবং জুম্ম বিদ্বেষী। পার্বত্য এলাকায় জীববৈচিত্র এবং প্রকৃতির উপর চরম ও সুদূর প্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য মূল কারণকে পাশ কাটিয়ে পাহাড়ি জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কোন বিভাগ থেকে এধরনের উন্নয়ন বিরোধী সার্কুলেশন জারি করা কখনোই কাম্য হতে পারে না বলে তিনি জানান। এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দায়ভার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বহন করতে হবে। এই নির্দেশনা কার্যকর করা হলে সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর (যারা অধিকাংশ আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু এবং পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক যারা এখনো পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে) জীবন-জীবিকার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে প্রীতিবিন্দু চাকমা মত প্রকাশ করেন।
হিল ভয়েসের নির্বাহী সম্পাদক প্রীতিবিন্দু চাকমা আরো বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী চাষ (দক্ষিণ এশিয়ায় যাকে জুম চাষ বলা হয়ে থাকে) কখনোই জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নয়। সেজন্য বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী বিষয়ক আইএলও-এর ১০৭নং কনভেনশনে ঐতিহ্যবাহী চাষকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১৯ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ইফতেখার মাহমুদ-এর “বন্য প্রাণীর শত্রু-মিত্র বনাম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দায়” শীর্ষক কলামেও বলা হয়েছে যে, “বিশ্বের ৪০ শতাংশ বনভূমি ও বন্য প্রাণী রক্ষা করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা। পশ্চিমা দেশগুলোতে যাদের আদিবাসী বা ইন্ডিজেনাস কমিউনিটি বলা হয়। এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা পরিবেশ ও বন্য প্রাণী রক্ষাকে নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম আর আচারের অংশ হিসেবে পালন করেন।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহকারি তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন যে, যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কারণে দেশের বনাঞ্চল উজার এবং জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের চূড়ায় সেনাবাহিনীর যে চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে, সেসব ক্যাম্পের চারপাশে যেভাবে গাছপালা ও জঙ্গল কাটা/উজার করা হয়, তাতে একাধারে বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে থাকে এবং পাহাড়ের ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত করে। কিন্তু সেনাবাহিনী সেসবের কোন ছবি উক্ত নির্দেশনায় সংযুক্ত করেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, পর্যটনের নামে সেনাবাহিনী বান্দরবানের নীলগিরি (কাপ্রু ম্রো পাড়া), জীবননগর (সেপ্রু পাড়া), চন্দ্র পাহাড়, ডিম পাহাড় (ক্রাইডং), ভিউ পয়েন্ট (মেননিক ম্রো পাড়া), রাঙ্গামাটির সাজেকসহ বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার একর পাহাড় দখল করে বনাঞ্চল উজার করছে এবং স্থানীয় পাহাড়ি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করে চলেছে। এছাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক সাজেকের সিজকছড়ায় বাঁধ নির্মাণ, বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে শত শত কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ এবং এতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাগান-বাগিচা ধ্বংস ও জায়গা-জমি দখল ইত্যাদির ফলে পার্বত্যাঞ্চলের বনাঞ্চল উজার, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট, পাহাড়িদের জীবনজীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। অথচ সেনাবাহিনী নিজেদের অপকর্মকে পাশ কাটিয়ে পাহাড়িদের উপর দায় চাপাচ্ছে বলে শ্রী চাকমা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।