হিল ভয়েস, ১০ নভেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ বুধবার (১০ নভেম্বর) দেশের বিভিন্ন স্থানে যথাযথ মর্যাদায় জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সাংসদ মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে পালিত হয়েছে।
পার্বত্য জেলাসমূহে:
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে রাঙ্গামাটিস্থ দলীয় জেলা কার্যালয় প্রাঙ্গণে সকাল ৮.০০ ঘটিকায় কালো ব্যাজ ধারণ, ৮.৩০ ঘটিকায় পুষ্পমাল্য অর্পণ, ৯.০০ ঘটিকায় শোক প্রস্তাব পাঠ, বিকাল ৫ ঘটিকায় প্রদ্বীপ প্রজ্বালন ও ফানুস উত্তোলনসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমার সঞ্চালনায় স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সৌখিন চাকমা। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পিসিপি রাঙামাটি শহর শাখার সভাপতি রাজন তঞ্চগ্যা ।
এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে দুই মিনিট আলোকপাত করেন পিসিপি’র সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্টাফ সদস্য আশিকা চাকমা। এম এন লারমা’র অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন। এছাড়াও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনও বিপ্লবী এই নেতার অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
অন্যদিকে বিকালে রাঙ্গামাটির দেবাশীষনগরে মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ও এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগার উদ্যোগে স্মরণসভা ও মোমবাতি প্রজ্বলন অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন এর সভাপতি শ্রী বিজয় কেতন চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগার এর সভাপতি সাগর ত্রিপুরা। স্মরণসভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখা এর সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা (অব: উপসচিব)।
অন্যান্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পলাশ কুসুম চাকমা, বাংলাদেশ উদিচি শিল্পীগোষ্ঠী ও সচেতন নাগরিক কমিটির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি অমলেন্দু হাওলাদার, পার্বত্য চট্টগ্রামের চারু শিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি ও সাবেক রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এর সাবেক সেক্রেটারি এম জিসান বখতিয়ার, ছাত্র ও যুব ঐক্য পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি দেবাশীষ পাল রাজা, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী নবাশীষ চাকমা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধান অতিথি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা বলেন, আজকে শিক্ষিত সমাজ ভুলতে বসেছে এম এন লারমা ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা ও জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে যৌবনে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। জুম্ম জনতা জেগে থেকেও ঘুমিয়ে আছে, বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজ।এম এন লারমাকে নিয়ে শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয় বরং চিন্তা চেতনার বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে হবে।জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র ও যুব সমাজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পলাশ কুসুম চাকমা বলেন, মানুষের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।তার আত্মবলিদান অনুসরণ করে ছাত্র ও যুব সমাজকে আরো অনেক সচেতন হতে হবে এবং ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
চারুশিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন পাহাড়ের আলোকবর্তিকা, ঘুমিয়ে থাকা জুম্ম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী ও গুণী এবং পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।এমন নেতা হারানো জাতির জন্য দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।তার আদর্শ ও চেতনা চিরজীবন অনুসরণীয়।
অমলেন্দু হাওলাদার বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন নিপীড়িত জনগণের বন্ধু। তার মেধা ও কন্ঠস্বর রুদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র করে বিপথগামী কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল এই নিন্দনীয় কাজ করতে দ্বিধা বোধ করেনি। মহান নেতার প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার আত্মবলিদানের প্রতি লাল সালাম জানান।
যুব ইউনিয়নের নেতা এম জিসান বখতিয়ার বলেন, মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শ পার্বত্য চট্টগ্রামে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে আহ্বান জানান।
মহান নেতার সংগ্রামী জীবনকে স্মরণ করে দেবাশীষ পাল রাজা বলেন, শিশু ও তরুণ প্রজন্মের কাছে এম এন লারমার আদর্শ ও চেতনাকে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরি বলে মত দেন।
সাংস্কৃতিক কর্মী নবাশীষ চাকমা বলেন, মানুষের জন্য জীবন দিতে যিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন, বর্তমানে অবচেতন হয়ে থাকা জুম্ম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে তার আদর্শ ও চেতনাকে আগামী প্রজন্মের তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেন।পরিশেষে বিকালে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে স্মরণ সভা ও মোমবাতি প্রজ্বলন অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
অপরদিকে জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখার উদ্যোগে ১০ নভেম্বর পালিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে ছিলেন প্রভাত কুমার চাকমা, সভাপতি, জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটি। প্রধান অতিথি ছিলেন ডা. সুমুতি রন্জন চাকমা, সদস্য জনসংহতি সমিতিররাঙ্গামাটি জেলা কমিটি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন নয়ন জ্যোতি চাকমা, সদস্য সচিব, জনসংহতি সমিতি বাঘাইছড়ি থানা শাখা। এছাড়া বক্তব্য রাখেন সুমনা চাকমা, সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির বাবাঘাইছড়ি থানা শাখা, যতিন রায় চাকমা, সাবেক চেয়ারম্যান ৩০নং সারোয়াতুলী ইউনিয়ন, ৩৮৪ নং মৌজার প্রতিনিধি ও সারোয়াতুলী ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিবৃন্দ।
বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সাজেক ইউনিয়নের থালছড়াতে পালন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন উৎপালক্ষ চাকমা (জিতেন), সহ-সভাপতি, জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখা, বিশেষ অতিথি হিসেবে সুব্রত চাকমা, সদস্য সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি উপস্থিত ছিলেন।
সারোয়াতুলী ইউনিয়নের চুরখালি গ্রামে পালন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে জ্ঞান প্রকাশ চাকমা, সদস্য, জনসংহতি সমিতিরবাঘাইছড়ি থানা শাখা এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ললিত রঞ্জন চাকমা, সভাপতি, জনসংহতি সমিতির সারোয়াতুলী ইউনিয়ন কমিটি উপস্থিত ছিলেন।
মারিশ্যা ইউনিয়ন থালছড়ায় ১০ই নভেম্বর পালন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন ত্রিদীপ চাকমা, সদস্য, জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখা এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন শান্তি বিজয় চাকমা ও শ্যামল কান্তি চাকমা।
বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের দোজর পাড়ার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন শান্তি মোহন চাকমা, সদস্য, জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখা এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন সুশীল তালুকদার, সভাপতি, জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি ইউনিয়ন শাখা।
জনসংহতি সমিতির লংগদু থানা শাখার তত্ত্বাবধানে লংগদুতে বিভিন্ন শাখা/গ্রাম কমিটির ১০ই নভেম্বর পালন করা হয়েছে। শাখা/গ্রাম কমিটির মধ্যে গুলশাখালী ইউনিয়নের ছোট মাহিল্যা, ভূইয়াছড়া, জারুলছড়া ও শান্তিনগর; বগাচতর ইউনিয়নের ঘুইছড়ি, রাঙিপাড়া, নোয়াপাড়া,ররজিত পাড়া ও চিবেরেগা; ভাসন্যাদম ইউনিয়নের চাল্যাতুলি, ঘনমোড় ও কুসুমছড়ি। এছাড়াও লংগদু ও আটরকছড়া ইউনিয়নের গ্রামবাসীদের স্ব স্ব উদ্দ্যেগে কয়েকটি জায়গায় পালন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বান্দরবানে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বান্দরবান জেলা শাখার উদ্যোগে ফানুস উত্তোলন কর্মসূচি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে:
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের যৌথ উদ্যোগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শহীদ বেদিতে মহান নেতা ও শহীদদের স্মরণে পুষ্পার্ঘ্য অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে বিশ্বশান্তি প্যাগোডা চত্বরে স্মরণ সভা, বিপ্লবী কবিতা পাঠ, বিপ্লবী গান পরিবেশন সহ নানা কর্মসূচি আয়োজন করেছে। প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহান নেতা ও শহীদদের স্মরণে পুষ্পার্ঘ্য অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাজশাহী মহানগর শাখা।
এছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন জায়গায় দিনটি পালন করা হবে।