হিল ভয়েস, ২১ নভেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: গত ২৪-২৫ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিজ উইনি ইস্ট্রুপ পিটারসেন-এর রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রাম সফরকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই জেলা প্রশাসককে এক হাস্যকর, ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত পরামর্শ প্রদান করেছে।
গত ২১ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব রেহানা পারভীনের স্বাক্ষরিত এক নিদের্শনায় জেলা প্রশাসকদের উক্ত পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উক্ত নির্দেশনার ৯টি পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে (ছ) ও (জ) ক্রমিকে নিম্নোক্ত দু’টি পরামর্শ হাস্যকর, ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সেগুলো হলো-
“(ছ) সাম্প্রতিক সময়ে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলাস্থ হরিণা ইউনিয়নের রাবেতং (ভারতের সীমান্তবর্তী) এলাকা হতে পিসিজেএসএস (সন্তু) এর সশস্ত্র সদস্যরা রাঙ্গামাটি সদরের বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ করত: নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে বলে জানা যায়। পাশাপাশি বরকল উপজেলার শুভলং বাজারে জেএসএস (এমএন লারমা) ও পিসিজেএসএস (সন্তু) দলের অবস্থান রয়েছে। এমতাবস্থায় সুনির্দিষ্ট ভ্রমণসূচী মোতাবেক পর্যাপ্ত পুলিশী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করা হলো।”
“(জ) ভ্রমণসূচীতে বর্ণিত প্রতিনিধিদের চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের সাথে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত ও সকালের নাস্তা গ্রহণের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সময়ে ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় স্বাধীন জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবী আদায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোপন তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তাই উক্ত বিষয়টি সরকার ও দেশের জন্য স্পর্শকাতর হওয়ায় বর্ণিত প্রতিনিধিদের চাকমা সার্কেল চীফ-এর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত ও নাস্তা গ্রহণের পরিবর্তে সাবারাং রেস্টুরেন্টে সৌজন্য সাক্ষাত ও সকালের নাস্তা গ্রহণ করা সাপেক্ষে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা আওতায় সফর পরিকল্পনার জন্য সুপারিশ করা হলো।”
নির্দেশনায় (ঙ) ক্রমিকে “পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতায় স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর” বলে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও পোষণ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি সুবর্ণ চাকমা হিল ভয়েসকে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উক্ত পরামর্শ অতিশয় হাস্যকর এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন সরকার সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক জনসংহতি সমিতি ১৯৯৭ সালে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পুন:পদার্পন করেছে। কাজেই যে দলের সাথে শেখ হাসিনার সরকার স্বয়ং চুক্তি করেছে, সেই দলের সশস্ত্র সদস্য থাকার প্রশ্ন অবান্তর।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পর শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার পৌনে চার বছর এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে ১৩ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেনি। এনিয়ে দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে সরকার প্রায়ই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির সদস্য ও চুক্তি সমর্থকদেরকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে দেশে-বিদেশে সাজানো অপপ্রচার চালিয়ে থাকে। জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদাসম্পন্ন)। প্রতিমন্ত্রী মর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এধরনের বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভুত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
সুবর্ণ চাকমা আরো যোগ করেন যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব ও সেনাবাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পৃষ্টপোষকতায় সংস্কারপন্থী খ্যাত জেএসএস (এমএন লারমা) সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনী ও আওয়ামীলীগ কর্তৃক সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সদস্যদের রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং, লংগদুর তিনটিলা, দীঘিনালার বাবুছড়া, রাঙ্গামাটি জীবতলীসহ বিভিন্ন স্থানে এবং মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়ায় সশস্ত্রভাবে মোতায়েন রেখে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও চুক্তি সমর্থকসহ সাধারণ লোকের উপর খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেনাবাহিনী তথা সরকারের ছত্রছায়ায় জেএসএস (এমএন লারমা) সহ সেসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহ সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে, আবার সেসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রদর্শন করে বিদেশী কূটনীতিকদের জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
হিল ভয়েসের সহকারি সম্পাদক সুপ্রিয় চাকমা বলেন, ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের বিরুদ্ধে স্বাধীন জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি আদায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোপন তৎপরতার অভিযোগও ষড়যন্ত্রমূলক বৈ কিছু নয়। আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তিনি তো প্রকাশ্যেই উত্থাপন করে আসছেন। আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবির বিষয়টি একটা গণতান্ত্রিক অধিকার। তিনি গণতান্ত্রিকভাবেই সেই দাবি করে আসছেন। অন্যদিকে স্বাধীন জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার থেকে কখনোই শোনা যায়নি। এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ও মনগড়া অভিযোগ বৈ কিছু নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে এধরনের অসত্য, মনগড়া ও ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য কখনোই আশা করা যায় না। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মতামত প্রদান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় তথা দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে শ্রী চাকমা উল্লেখ করেন।