হিল ভয়েস, ১৯ অক্টোবর ২০২১: রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়া ইউনিয়নের ওঁরাও-সাঁওতাল আদিবাসী পরিবারগুলোর জমি ক্রমে প্রভাবশালীরা দখল করে নিচ্ছে। এমনকি দখলের হাত থেকে বাদ পড়েনি সমাধিস্থলও। ফলে বেঁচে থাকতে যেমন হয়রানি পোহাতে হচ্ছে, তেমনি মৃত্যুর পরও ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না।
যেভাবে জমি হারাচ্ছে বাসিন্দারা
বদরগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে লোহানীপাড়া ইউনিয়নের আদিবাসী পল্লীতে ওঁরাও ও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষের বাস। বাসিন্দাদের অভিযোগ, জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০০ বিঘারও বেশি জমি দখল করেছে প্রভাবশালীরা।
গুমিতপাড়ার মৃত মুনিস মুরমুর ছেলে সুনিরাম মুরমু (৩৫) জানান, তাঁর ৯৫ শতাংশ জমি জাল দলিল করে ভোগদখল করছেন একই এলাকার কৃষ্ণ সরকার ও তাঁরই ভাই ঋষি সরকার। এ ছাড়া কদমাপাড়ায় ৭৮ শতাংশ জমি জবরদখল করে চাষাবাদ করছেন মজিবর রহমান। সেখানে একসময় সুনিরামদের ছিল বসতভিটা।
শিমুলঝুড়ি গ্রামের সোম কিসকুর ছেলে বাবু লাল কিসকু (৭০) জানান, প্রায় আড়াই শ বছর আগে লোহানী পাড়ার বনজঙ্গল পরিষ্কার করে তাঁদের পূর্বপুরুষরা বসবাস শুরু করেন। অজ্ঞতার কারণে ১৯৪০ ও ১৯৬২ সালের এসএ, সিএস খতিয়ানে অনেকের জমি ১ নম্বর খাস খতিয়ানে চলে গেছে, যার পরিমাণ হবে অন্তত ১১০ একর। এ ছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে তহশিলদারের কাছে খাজনা দিতে গেলে রসিদমূলে জমা করেন ১০০ টাকা। বাড়তি নেন এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এ ছাড়া তাঁদের অনেক জমি ২ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত হয়ে এখন বন বিভাগের দখলে।
এ বিষয়ে লোহানীপাড়ার উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা (সাবেক পদ তহশিলদার) আখেরুজ্জামান বলেন, ‘আমার সময়ে বাড়তি টাকা নেওয়া হয়নি।’
এদিকে বড়পাড়ার কারমা কিসপট্রার ছেলে সানি কিসপট্রার (৫২) অভিযোগ, স্বাধীনতার আগে তাঁর নানা এতোয়া টপ্পো তাঁর মা মানরি টপ্পোকে তিন বিঘা জমি লিখে দেন। তাঁদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ১৯৭৫ সালে গোপনে ওই জমির জাল দলিল করেন মোতালেব হোসেন। ২০১৯ সালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে এ নিয়ে সালিস হলেও বিচার পাননি তিনি। এদিকে একই বছরে মণ্ডলের হাটের উত্তরে তাঁদের এক বিঘা জমি মহির উদ্দিনের কাছে তাঁর মা এক হাজার ২০০ টাকায় বন্ধক রাখেন। পরে মহির ওই জমি গোপনে আয়নুল হক, আনিছুল হক ও ইদ্রিস আলীর নামে জাল দলিল করে বেচে দেন।
সমাধি ও শ্মশানের জমিও বেহাত
ওঁরাও-সাঁওতালদের সমাধিস্থল ও শ্মশান দখলের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় চার একর জমিতে সমাধি দিতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে। ১৯৯০ সালে হবিবর রহমান, মমিনুল হক, বৈতুল্লাহ মিস্ত্রী, বুলবুল ইসলাম ও আবুল কালাম গোপনে শ্মশানের জমি বন্দোবস্ত নেন। দখলদারদের ভয়ভীতি আর হুমকির মুখে মরদেহ সমাধিস্থ করতে প্রায়ই ভোগান্তির মুখে পড়ে বাসিন্দারা। এর আগে ইজারা বাতিল চেয়ে তারা জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করে; কিন্তু প্রতিকার পায়নি।
উপিল কর্মকার ও উকিল মুরমু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রায় ২০০ বছর ধরে পূর্বপুরুষরা এই স্থানটিতে শুয়ে আছেন। হিন্দুসহ সাত সম্প্রদায়ের মানুষকে এখানে কবর দেওয়া হয়।’
বন্দোবস্ত নেওয়া মৃত বৈতুল্লাহ মিস্ত্রীর ছেলে মোসলেম উদ্দিন ও মৃত আবুল কালামের ছেলে কামরুজ্জামান জানান, সরকারের সব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে তাঁদের বাবা ওই জমি লিজ নেন।
লোহানীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাকিব হাসান ডলু শাহ্ বলেন, ‘শ্মশান ও সমাধিস্থল গোপনে লিজ নিয়েছে। কাজটি ঠিক করেনি। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা করা হলেও সমাধান হয়নি।’
সূত্র: কালেরকন্ঠ