সুহৃদ চাকমা
দেশের মধ্যে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িক হামলা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা অসংখ্যবার। ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে সৃষ্ট জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশের পথে বড় বাধা। তাই একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে দেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা বপনের বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত শক্ত করে গাঁড়তে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং অসাম্প্রদায়িক দেশ বিনির্মাণের জন্যে সমাজের সব স্তরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশের মধ্যে চলমান উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, চরম আগ্রাসী ইসলামী সম্প্রসারণবাদ, উগ্র মুসলিম ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা উগ্র সাম্প্রদায়িকতার খোলস ভাঙতে না পারলে অসাম্প্রদায়িক দেশ ও সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়ন হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বা সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা ও প্রতিবাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বারবার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তার বহিঃপ্রকাশ হলো এই সরকারের মতের বিপক্ষে কথা বললেই আজ সেই ব্যক্তি ও সংগঠনকে দেশ বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক হামলা অতি সাধারণ একটা বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জুম্ম জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রয়ন্ত্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাঙালি মুসলিম সেটেলার কর্তৃক অসংখ্যবার বর্বর ও নৃশংসতম সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়েছে, জুম্মদের ভূমি বেদখলের হোলিখেলায় মেঠে উঠেছে, চিরায়ত নিজস্ব ভূমি হতে জুম্মদের চিরতরে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এবং নারী ধর্ষণ, নারীর উপর শ্লীলতাহানিসহ হত্যা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়েছে আমাদের নিজস্ব গ্রাম ও বসতভিটা। এতো বড় অন্যায়ের সুস্থ তদন্ত ও বিচার পাহাড় কিংবা সমতলে আজ পর্যন্ত হয়নি, কারণ রাষ্ট্র, সরকার কতৃপক্ষ স্বয়ং উগ্র সাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ রোপণ করা হয়ে থাকে এবং সেটিই সমাজের রন্ধ্র রন্ধ্রে ও তাদের রক্তের শিরায়-উপশিরায় আজও প্রবাহিত হচ্ছে। সমাজের আমূল পরিবর্তন ব্যতিত এই সাম্প্রদায়িকতার মরণ ব্যাধি হতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়, কঠিন অপারেশনের মাধ্যমেই এই মরণ ব্যাধিকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা হতে তাড়িয়ে দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে এনেছে এবং সব ধর্মের মানুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে বলে দাবি করলেও তা ছিল একটি জগাখিচুরি প্রয়াস। সংবিধানে ঠিকই ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’কে রাখা হয়েছে, যা ছিল সম্পূর্ণভাবে স্ববিরোধী ও ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির সাথে বিরোধার্থক।এই সরকারের আমলেই ২০১১ এবং ২০১৩ সালে অর্পিত সম্পত্তি আইনে ব্যাপক সংশোধন করা হয়েছে। এই সরকার অসংখ্য আইন ও নীতিমালায় সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সমুন্নত ও টেকসই করার প্রয়াস গ্রহণ করেছে, কিন্তু সমাজের সর্বস্তর থেকে ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করতে পারেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই আইন ও নীতিমালাগুলো কেবল লোক দেখানো (আই-ওয়াজ) ছাড়া কিছুই নয়। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের এধরণের অসংখ্য আইন হয়ে থাকে, কিন্তু এই আইন কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারক-বাহক শোষকশ্রেণিকে টিকিয়ে রাখতে বেশি প্রয়োগ করা হয়। সমাজের ও রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ট শোষিত মানুষের উপর দমন-পীড়নের যন্ত্র হিসেবে এই আইনগুলো কার্যকরী হয়ে উঠে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা জারী থাকায় দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরা অসংখ্যবার আক্রান্ত হচ্ছেন, পাহাড় কিংবা সমতলে আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। সবচেয়ে যেটা উদ্বেগের বিষয়, ধর্মের কারণে এই বৈষম্য করার জন্য কাউকে কিন্তু বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। তাহলে রাষ্ট্রের আইন করে কি লাভ?
আমি যদি আরও একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করি, যে সকল সামাজিক ব্যাধি একটি জাতির দেহে ক্ষত সৃষ্টি করে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাম্প্রদায়িকতা। অথচবাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সংবিধানে অঙ্গীকার সত্বেও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটি আজ দেশের জাতীয় রাজনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশ আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষে চরমভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, যার প্রমাণ এবারের হিন্দু ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পুজার দিনে হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দিরে হামলা ও জিনিসপত্র ভাঙচুর, পুজামন্ডবে সামনে হিন্দু ধর্মালম্বী লোকজনদের উপর হামলা, হামলার সময় হিন্দুদের পিটিয়ে মেরে ফেলার বর্বর, হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট আমাদের স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে। এ ঘটনায় সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় যে, এসব হামলায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং কতেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ।
তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? দেশের সংবিধানের সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূলনীতির স্তম্ভগুলো আজ কোথায়??? এই চার মূল স্তম্ভগুলো আজ সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে আঘাতে খসে-খসে পড়ছে। এবারের হিন্দু ধর্মালম্বীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা অতীতের সকল বর্বরতা, নৃশংসতা ও সাম্প্রদায়িকতার রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। বাস্তবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে, এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ ও প্ররোচনামূলক কাজকে বুঝানো হয়। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ভাব পোষণ করা এবং তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোই হলো সাম্প্রদায়িকতা। আজ বাংলাদেশের মুসলমান ধর্মাবলম্বী মুসল্লিরা তাই করে চলেছে, তাদের মনোভাব সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির।
কোনো সম্প্রদায় নিজের অস্তিত্বকে রাজনৈতিকভাবে জাহির করাই হচ্ছে চরম সাম্প্রদায়িকতার বহি:প্রকাশ, তারপরও রাজনৈতিক ভাষায় যদি আরও একটু বাড়িয়ে বলি, সাম্প্রদায়িকতা হলো একটা মতাদর্শ যা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে বেশি প্রাধান্য দেয়। বিশ্বের বুকে দুই দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে-একটা ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি অন্যটি বস্তুবাদী। এই জায়গা থেকে আমরা আজ পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের মধ্যে ধর্ম ও রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলে গোটা দেশের সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম ধর্মীয় মৌলবাদের শিকড় গেঁড়ে পাকাপোক্ত হয়েছে। দেশের শিক্ষা, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ডালপালাতে এবং কি রাজনীতিতে কোনো একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, সেই ধর্মীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করা হচ্ছে। রাজনীতিতে, প্রশাসন ব্যবস্থায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মের হস্তক্ষেপই যদি হয় সাম্প্রদায়িকতা, তাহলে এর সূত্রানুযায়ী বাংলাদেশ পুরোপুরি একটা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ধারক বাহক এর রাষ্ট্র। দেশের মধ্যে জামাত ইসলাম ও হেফাজত ইসলাম অন্যতম সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদের ধারক বাহক এর এক একটি দল। হেফাজত ইসলামকে কোলে নিয়ে আওয়ামী লীগ পুরোটা সময় পার করে আসছে, এর অর্থ হলো এই হেফাজত ইসলাম যদি সাম্প্রদায়িক দল হয়ে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগও একই পথের পথিক, শুধুমাত্র হতে পারে মুদ্রার এপিট-ওপিট। প্রতিটি দলের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের কাজে আত্মনিয়োগ করে দেশের মধ্যে যে চার মূল স্তম্ভ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আজ চিরতরে বিনষ্ট করে চলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি যে, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে উদ্ভুত বিরোধ যখন দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ও দাঙ্গার মধ্য দিয়ে ফেটে পড়েছে। এই বিরোধ, বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার মূল লুকায়িত মূলত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে, তারই ভিত্তিতে সমাজের মানুষের লালিত চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটে। এধরনের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সাম্প্রদায়িকতার মূল কারণ। আজ দেশের চলমান পরিস্থিতিই আমাদের বিবেককে জানান দিয়ে যায়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার বীজ প্রচন্ডভাবে বাসা বেঁধেছে, যার চুড়ান্ত পরিণতি এবারের শারদীয় দূর্গা পুজার উৎসবে বিস্ফোরণ ঘটেছে। দেশের মধ্যে এক জাতি, এক ধর্মের মানুষই কেবল অবস্থান করতে পারবে-এমনই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ প্রতিটি মুহুর্তে আমরা পরিলক্ষিত করছি। কারণদেশের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অন্ধভাবে নিজের ধর্মীয় চেতনাকে অনুসরণ করে আসছে। এই অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করাতে চায় একজন মানুষের পরিচয় হবে সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক।
ধর্মই হবে তাদের সামাজিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি, যা হাজার হাজার বছর ধরে এই সমাজ ব্যবস্থার মানুষেরাই এধরনের একটা সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদের চেতনা লালন করে চলবে। সেকারণেই সাম্প্রদায়িকতাকে সেই সব সমাজের সাধারণ মানুষের মননে ও চিন্তায় বাস্তবে প্রতিফলন দেখা যায়। সত্যিকার অর্থে মানুষ যদি নিজের অন্তরাত্মাকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শিখে, নিজেকে “সর্বশ্রেষ্ঠ” প্রমাণের জন্য সব সময় ব্যস্ত থাকে, তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ কিন্তু আজকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা উল্টো ‘সবার উপরে ধর্মই সত্য তাহার উপর নাই’! বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের দেশ আমরা কখনো শুনিনি! হিন্দু-বৌদ্ধদের উপর হামলা হলে প্রতিবাদ শুধু তারাই করবে না। এই প্রতিবাদ আসতে হবে দেশের আপামর মেজরিটি মুসলমানদের পক্ষ থেকে সবার আগে, তাহলে নির্যাতিত হিন্দু-বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সাহস পাবে এই ঘোরতর অন্ধকারে নতুন করে বাঁচবার।
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ ধর্মকে ঘিরে একটা উদ্ভূত দর্শন, যা ধর্মকে রাজনৈতিক মতাদর্শে রূপান্তরিত করেছে এবং এর পূর্বশর্ত হল ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের মধ্যে ধর্ম-ভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িক পুষ্ট হচ্ছে, আরও অধিকতর শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে তা হলো অর্থনীতি ও সামাজিক ভিত্তির ওপর ভর করে। সাম্প্রদায়িক শক্তির নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড কতটুকু শক্ত ও সুদৃঢ়, ধর্মীয় মৌলবাদের ভিত্তিতে জিহাদি আন্দোলন কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিতে পারলে তাদের আসল উদ্দেশ্যই স্বার্থক হবে। আজ বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি কেবল সামান্য একটা সমস্যার পর্যায়ে নেই, বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরাট একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, যা অনাগত দিনে দেশের মধ্যে সংকট বয়ে আনবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পরিমাণগত পরিবর্তনের পর গুণগত পরিবর্তনের দিক থেকে বিচার করলে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ৭১-এর মানবতা বিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমসহ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে প্রগতিবাদী তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকে আরও এক ধাপ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু হেফাজত ইসলাম ব্যানারে এই চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান আবারও নতুন মাত্রা পেয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড এভাবেই চলমান থাকলে বাংলাদেশ হাজার হাজার বছর পিছিয়ে যাবে। আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ যুক্তির কোন ধার ধারে না, অন্ধকারই তার যুক্তির একমাত্র ভিত্তি। তাই দেশ ও সমাজকে বাঁচাতে হলে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গিত্বকে প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
মৌলবাদী জঙ্গীদের লক্ষ্য হলো ইসলামি রাজ কায়েম করা, এবং এই রাজ প্রতিষ্ঠায় যে সব ব্যক্তি, সংগঠন তথা রাষ্ট্র বাধা দেবে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করা সাম্প্রদায়িক শক্তির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাদের এই লক্ষ্য অর্জনের পথে জঙ্গিত্বের নৃশংস ও অসভ্যতার বহি:প্রকাশ আমরা দেখেছি ১৭ আগস্ট ২০০৫ সালে, এরপরেও সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশের ধারাবাহিক নৃশংস রূপ আমরা দেখেছি হেফাজতে ইসলামের নারী বিদ্বেষী ও প্রগতি বিরোধী ১৩ দফাসহ তাদের সকল কর্মকাণ্ড। আমরা আরও দেখেছি বিভিন্ন পথ-পন্থা পদ্ধতিতে দেশের নানা স্থানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মুক্ত বুদ্ধিচর্চাতথামুক্ত চিন্তার মানুষদের খুন ও জখমসহ নতুন নতুন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আগ্রাসী উত্থানের ফলে আমাদের দেশের অনেক প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, লেখক, শিক্ষক, আইনজীবী ও জাতীয় পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীকে হারিয়েছি এবং অনেকেই নিজের দেশ থেকে পালিয়ে বাইরে দেশে নিরাপদ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। দেশের জাতীয় পর্যায়ে এক ধরনের সংকট, যা রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রসহ সর্বত্র আত্মঘাতী লুন্ঠন সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। এই লুন্ঠন সংস্কৃতির চরিত্র নিয়ামক হলো কালো টাকা, সন্ত্রাস, অবৈধ অস্ত্র, পেশি শক্তি, ঘুষ, দুর্নীতি, দূর্বৃত্তায়ন, অপশাসন ও দমন-পীড়ন ইত্যাদি। এসবই কিন্তু আজ বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও মৌলবাদী শক্তি গঠনের সহায়ক শক্তি ও উপাদান। তারপরও দেশের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি বিকাশ অব্যাহত রাখতে পারলে এসব উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা দ্রুত গতিতে বিকাশ ঘটেছে, গত ৩ কিংবা ৪ দশকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, আর বিপরীতে দাখিল মাদ্রাসা সংখ্যা বেড়েছে ৮ গুণ। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বেড়েছে দ্বিগুণ আর দাখিল মাদ্রাসায় বেড়েছে ১৩ গুণ, তারমানে শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রচন্ডভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে তা সত্য। দেশের জাতীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার ভিত শক্ত হওয়ার পেছনে এযাবতকালে অর্থনীতিও একটা বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। তারমধ্যে মৌলবাদীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঔষধ শিল্প ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান; মসজিদ, মাদ্রাসা, ব্যবসায়িক/বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান; খুচরা ও পাইকারী ব্যবসা, স্থানীয় সরকার, বেসরকারি সংস্থা, ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন, যোগাযোগ পরিবহন খাত, কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সমিতি, বাংলাভাই প্রকৃতি প্রকল্প, রিয়েল স্টেট, সংবাদ মাধ্যম ও তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি অর্থনীতি শক্তির মোডেল হিসেবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পাকাপোক্ত করেছে বলে অনেক প্রগতিশীল লেখকের প্রবন্ধে উঠে এসেছে।
শেকড়ের ইতিহাস না জানলে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে না বুঝলে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এর বহুমাত্রিক কারণগুলো কখনই জানা যাবে না। তাইপৃথিবীর দেশে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ উত্থানের পেছনে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাত রয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে রাষ্ট্রের বা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে, এবং রাষ্ট্র নিজেই তা লালন করে চলেছে। রাষ্ট্রের তথা সরকার দলের জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ববৃন্দের আস্কারা পেয়ে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদের শেখড় আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁড়ে বসেছে। পরিশেষেসাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কুরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে সারা দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, মন্দির, প্রতিমা ভাঙচুর ও খুনের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, যা সমগ্র বিশ্বের মানবতাবাদী ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্রের জাতীয় বিবেককে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। অতীতের সমস্ত উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের রেকর্ড ছাড়িয়ে এবারের শারদীয় দুর্গা পূজা উৎসবে মেজরিটি মুসলমান ধর্মান্ধতার ধারক-বাহক সাম্প্রদায়িক অপশক্তিই দেশের মধ্যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাই সরকারকে এবং আপামর দেশবাসীকে এখনিই মানবতা বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে, না হলে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই দেশটি ইসলামিক মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা কারোর জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। পাশের দেশ ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ও তালেবানী রাষ্ট্র আফগানিস্তান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।