হিল ভয়েস, ১৫ অক্টোবর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: কুমিল্লায় “পবিত্র কোরান অবমাননার” অভিযোগ এনে মুসল্লীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্গা পূজামন্ডপে ও হিন্দু মন্দিরে ব্যাপক হামলা ও ভাংচুর করেছে।
১৩ অক্টোবর বুধবার সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ করে কুমিল্লা শহরের নানুয়ারদীঘি এলাকার একটি পূজামণ্ডপের প্রতিমায় পবিত্র কোরআন রাখার খবর ছড়িয়ে পড়ে। খবরটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে মাদ্রাসার ও স্থানীয় মুসল্লীরা প্রতিবাদ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে কুমিল্লা শহরের মণ্ডপগুলোতে হামলা করা শুরু হয়। তবে সাথে সাথে পুলিশও ব্যবস্থা নেয় বলে জানা যায়।
তারপর দিন ১৪ অক্টোবর ২০২১ কুমিল্লা, বান্দরবান, হবিগঞ্জ, খুলনা, চাঁদপুর, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, রাজশাহী, সিলেটের জকিগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় পূজা মন্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন শহরে পূজাবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে কমপক্ষে ১৫ জেলায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোরআন অবমাননা করার ব্যাপক প্রচার শুরু হলে মুসল্লীরা কুমিল্লা শহরের বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলা করে। পূজা উদযাপন কমিটির সম্পাদক নির্মল পাল অভিযোগ করেন যে, “পূজা বানচালের জন্য পরিকল্পিতভাবে কোরআন রেখে এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারাই এখন শহরজুড়ে পূজাবিরোধী বিক্ষোভ করছে। পুলিশের বাধায় কয়েকটি মণ্ডপের ভেতরে ঢুকতে না পারলেও পূজা মন্ডপের গেইট বা সামনের স্থাপনা ভাংচুর করেছে।”
অন্যদিকে বুধবার রাতেই মুসল্লীরা নোয়াখালীর হাতিয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও পটিয়ায় মিছিল নিয়ে মন্দিরে হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা হয়েছে। এসময় পুলিশের সাথে হামলাকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার সকালে বান্দরবানের লামা বাজারে এক প্রতিবাদ সমাবেশের পর মুসল্লীরা লামা কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরে দফায় দফায় হামলা চালায়। এসময় পুলিশ সদস্যসহ আহত হয় অর্ধশত। বাজারের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৪০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ৮টি বসত ঘরে ভাংচুর চালিয়ে লুটপাট করা হয়। লামা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: শাহীন এবং ওলামালীগ নেতৃবৃন্দ উক্ত হামলার নেতৃত্ব দেন বলে জানা যায়।
গাজীপুরে ৪/৫ শত লোক লাঠিসোটা নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে তিনটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমাসহ বিভিন্ন মালামাল ভাংচুর করেছে মুসল্লীরা। হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৯ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী।
লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে শ্রী শ্রী রাম ঠাকুরাঙ্গন মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। হামলাকারীদের সাথে সংঘর্ষে পুলিশের দুই এসআই সহ ৯ জন আহত হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।
কুড়িগ্রামের উলিপুরের ৩টি ইউনিয়নের ৭টি মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কুড়িগ্রাম-৩ আসনের এমপি অধ্যাপক এমএ মতিন অভিযোগ করেছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলনা। বরং হামলার সময় পুলিশের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ছিল।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের হরি বল ঠাকুর মন্দিরের হামলা চালিয়েছে মুসল্লীরা। এ ঘটনায় নবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে।
কক্সবাজারে পূজামণ্ডপ ও হিন্দুপল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়েছে। ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
খুলনা নগরীর পুরাতন রূপসা ফেরিঘাট এলাকার রূপসা মহাশ্মশান ঘাট মন্দিরের প্রবেশ পথের পাশ থেকে ১৮টি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। কোনো কুচক্রী মহল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য এই বোমা পেতে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কুরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে সংঘাতের পর বুধবার প্রথমে কুমিল্লায় দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। এরপর আরও পাঁচটি জেলায় যথাক্রমে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী ও চাঁদপুরে ধাপে ধাপে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়।
বুধবার এক তথ্য বিবরণীতে সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয় যে, কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননা সংক্রান্ত খবরটি খতিয়ে দেখছে সরকার।
বিভিন্ন জেলায় শারদীয় দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় মৌন প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিবিসি জানিয়েছে যে, কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়া এবং সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা ও পুলিশের সাথে হামলাকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে ভারতের সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভায় বিরোধীদলীয় প্রধান ও বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হামলা থেকে ‘সনাতনী জনগণ’কে রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় একযোগে পূজা মন্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুরের ফলে বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য এবারের দুর্গা পূজার আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে উল্লেখ করেন।
বৃহস্পতিবার আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে যে, নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতি তৈরি করছে।