হিল ভয়েস, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, বান্দরবান: সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্তৃক ৪১ জন নিরীহ আদিবাসী জুম্মর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মামলাটিতে সেনা ও বিজিবি কর্তৃক ইতোমধ্যে বেআইনীভাবে আটক ও নির্যাতনের শিকার ৪ নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীকেও মামলার আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ দুপুর ২.৪৫ টায় ১১ বিজিবি’র নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়নের নায়েব সুবেদার মো: আবুল খায়ের (মোবাইল-+৮৮০১৭৩৫৯৩৮৭৭০) বিজিবি’র পক্ষ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় এই মামলা দায়ের করেন। নাইক্ষ্যংছড়ি থানার মামলা নং ৭, তারিখ ১৫/৯/২০২১, ধারা সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ (সংশোধিত-২০১৩) এর ০৬/০৭/১২/১৪ তৎসহ ১৪৪/৩৫৩/৩০৭ দন্ডবিধি।
মামলাটিতে সরকারি কর্তব্য কাজে বাধা প্রদান, হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত এবং সাধারণ জনগণের নিকট হতে চাঁদা উত্তোলন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার কাজে সহায়তা ও সশস্ত্রভাবে অবস্থান করে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি, দেশের অখন্ডতা বিপন্ন করার লক্ষ্যে সশস্ত্রভাবে সংঘটিত হইয়া বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা এবং আশ্রয় প্রদান করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উক্ত ৪১ জন জুম্মসহ আরও অজ্ঞাতনামা অস্ত্রধারী নাইক্ষ্যংছড়ি থানাধীন দোছড়ি ইউপি’র ২নং ওয়ার্ড কামিছড়া চাক পাড়ায় ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে বিজিবি-সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান চলাকালীন কামিছড়া চাক পাড়ায় পাহাড়ি রাস্তার উপর বিজিবি’কে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে বিজিবি টহল দলের ২ জন সদস্য মারাত্মক আহত হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযুক্ত কয়েকজন জুম্ম ও সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, এটা সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র ষড়যন্ত্রমূলক মামলা। অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ সবাই নিরস্ত্র ও নিরীহ জুম্ম এবং কেউ কেউ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত মাত্র। তারা সন্ত্রাসী হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তারা বলেন, বিজিবি’র অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক।
মিথ্যা মামলার শিকার ব্যক্তিগণের তালিকা নিম্নরূপ-
১. মংলা পো (৬০), পিতা-শোয়েছা অং, গ্রাম-কামিছড়া চাক পাড়া, দোছড়ি ইউনিয়ন, নাইক্ষ্যংছড়ি, ২. লাইগ্যা ছো (৫০), পিতা-মং বা, গ্রাম-ঐ, ৩. চিংলা অং চাক (৩০), পিতা-আথাছা, গ্রাম-ঐ, ৪. মংলা থোয়াই চাক (১৫), পিতা-চিংলা অং চাকমা, গ্রাম-ঐ, ৫. অমর জ্যোতি চাকমা ওরফে অপু চাকমা (৪০), পিতা-লাম্বা চাকমা, গ্রাম-রাঙ্গামাটি সদর, রাঙ্গামাটি জেলা, ৬. ক্যবামং মারমা (৫৪), পিতা-উথোয়াই মারমা, গ্রাম-রোয়াংছড়ি, ১নং ওয়ার্ড, রোয়াংছড়ি উপজেলা, বান্দরবান, ৭. কাজল চাকমা (৪০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৮. ননাধন চাকমা হিতোশি (৪৫), পিতা-যুগল কৃষ্ণ চাকমা, গ্রাম-বলপিয়া আদাম, নানিয়ারচর উপজেলা, রাঙ্গামাটি জেলা, ৯. মায়া চাঁদ চাকমা (৫০), পিতা-ক্ষীণ রোদ চাকমা, গ্রাম-বনযোগীছড়া, জুরাছড়ি উপজেলা, রাঙ্গামাটি জেলা, ১০. অনুপম চাকমা (৪০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-লংগদু, লংগদু উপজেলা, রাঙ্গামাটি জেলা, ১১. বাসা চাকমা এ্যাসমং (৫০), পিতা-মৃত রায় মোহন চাকমা, গ্রাম-গুইমারা, গুইমারা উপজেলা, খাগড়াছড়ি জেলা, ১২. গর্জন তঞ্চঙ্গ্যা (৪২), পিতা-কিনাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-ঘিলামুখ পাড়া, রাজস্থলী উপজেলা, রাঙ্গামাটি জেলা, ১৩. অং থোয়াই চিং মারমা (২৯), পিতা-প্রু তুই মং মারমা, গ্রাম-লাছালং পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলা, বান্দরবান জেলা, ১৪. প্রীতিসেন তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), পিতা-মৃত জীতেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-আলেক্ষ্যং, রোয়াংছড়ি উপজেলা, বান্দরবান জেলা, ১৫. অংশৈচিং মারমা (৩৫), পিতা-সাহ্লাচিং মারমা, গ্রাম-রোয়াংছড়ি বাজার পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ১৬. অংকানু মারমা (২৮), পিতা-মৃত ক্রাই মং মারমা, গ্রাম-খায়ম্রুং পাড়া, নোয়াপতং, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ১৭. সাগর বাসা চাকমা (৩০), পিতা-বৈদ্য চন্দ্র চাকমা, গ্রাম-জ্ঞান কার্বারি পাড়া, আলীকদম উপজেলা, বান্দরবান জেলা, ১৮. তরুণ চাকমা (৩৫), পিতা-বসুদেব চাকমা, গ্রাম-রোয়াম্ভু বয়ামঝিরি, আলীকদম উপজেলা, ১৯. অনীল চাকমা (৩৫), পিতা-সুতবির লক্ষ্য চাকমা, গ্রাম-রম্ভু কলারঝিরি, আলীকদম উপজেলা, ২০. রুপন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৮), পিতা-কালাসেন তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-ওয়াইগ্যা পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ২১. কল্পসেন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৩), পিতা-শত্রুসেন তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-ওয়াইগ্যা পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ২২. মংশৈ মারমা (৩২), পিতা-হ্লা থোয়াই মং মারমা, গ্রাম-কানাইজো পাড়া, নোয়াপতং, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ২৩. মংবাচিং মারমা (৩৭), পিতা-মৃত চিনু মং মারমা, গ্রাম-নোয়াপতং, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ২৪. রাঙ্গোলাল তঞ্চঙ্গ্যা (২৬), পিতা-ললিত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-তাইমুরুংছড়া পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ২৫. স্বপ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (২৪), পিতা-সমিরণ তঞ্চঙ্গ্যা, গুংখ্যাংপাড়া, নোয়াপতং, রোয়াংছড়ি উপজেলা, ২৬. হিরণ ওরফে তুনিদ (২৮), পিতা-কৃষ্ণমা ধরা, গ্রাম-নানিয়ারচর, নানিয়ারচর উপজেলা, রাঙ্গামাটি জেলা, ২৭. রবিদ্বয় চাকমা (৪৪), পিতা-অজ্ঞাত, রোয়াম্বু নয় পাড়া, আলীকদম উপজেলা, ২৮. প্রাইপ্রু মারমা (৫২), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-হেডম্যান পাড়া, বান্দরবান সদর উপজেলা, ২৯. নিত্যলাল চাকমা (৫০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-হেডম্যান পাড়া, বান্দরবান সদর উপজেলা, ৩০. চসিমং মারমা (৫৫), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-হেডম্যান পাড়া, বান্দরবান সদর উপজেলা, ৩১. সুমন তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-পাইনছড়া, বান্দরবান, ৩২. অমলাম চাকমা (৪৫), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৩৩. উনুমং মারমা ওরফে রয়েল (৪২), পিতা-গংজক মারমা, গ্রাম-লাপ্রাইমুখ পাড়া, বান্দরবান সদর উপজেলা, ৩৪. মংয়োইসিং মারমা (৩৫), পিতা-থোয়াইনু চিং মারমা, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৩৫. নিরোলাল চাকমা (৪৮), পিতা-বঞ্চিত চাকমা, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৩৬. সাচিংনু মারমা (৫৪), পিতা-ক্যহ্লাচিং মারমা, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৩৭. কক্যাইনু মং মারমা (৩০), পিতা-চথোয়াই মারমা, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৩৮. অংশৈমং মারমা (৫৫), পিতা-সাথ্রচিং মারমা, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৩৯. কাঞ্চন (৩৮), পিতা-মেদংন্যা, গ্রাম-অজ্ঞাত, ৪০. ভাগ্যলতা (৩৫), স্বামী-অনীল তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-রম্ভু কলারঝিরি, আলীকদম উপজেলা, ৪১. জয়বাহাদুর ত্রিপুরা ওরফে অজিত (৪৭), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-অজ্ঞাত।
উল্লেখ্য যে, মামলায় ১ নম্বর হতে ৪ নম্বর তালিকাভুক্ত অভিযুক্তগণকে মামলা দায়ের করার ১৪ দিন পূর্বেই সেনা ও বিজিবি সদস্যরা তাদের নিজ গ্রাম থেকে আটক করে নিয়ে যায়। আটকের পর সেনা ও বিজিবি সদস্যরা আটককৃতদের মুক্তি না দিয়ে বা আইন অনুযায়ী আদালত বা পুলিশের নিকট সোপর্দ না করে সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধভাবে অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রাখে। পরে উক্ত মিথ্যা মামলাটি দায়ের করে বিজিবি সদস্যরা আটককৃত উক্ত ৪ জনকে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় সোপর্দ করে এবং মামলায় আসামী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
উল্লেখ্য, গত ১লা সেপ্টেম্বর ২০২১ বুধবার সকালে আলিকদম জোনের সেনাবাহিনী ও নাইক্ষ্যংছড়ি জোনের বিজিবি’র একটি যৌথ দল দৌছড়ি ইউনিয়নের কামিছড়া চাক পাড়ায় যৌথ অভিযান চালায়। অভিযানে সেনা ও বিজিবি সদস্যরা উক্ত ৬ নিরীহ আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীকে আটক করে। আটক করার পর সেনা ও বিজিবি সদস্যরা কয়েকজন মহিলাসহ উক্ত ৬ গ্রামবাসীকে অমানুষিকভাবে মারধর করে। মারধরের সময় সেনা ও বিজিবি সদস্যরা “জেএসএস সন্ত্রাসীরা কোথায় থাকে, তাদেরকে কত টাকা চাঁদা দাও’ ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদ করে।
আটককৃত ৬ জনের মধ্যে ২ জন, যথা- উথোয়াই হ্লা মার্মা (২৪), পীং-মংদো মারমা ও ম্যানরুম মুরুং (৬০), পীং- মৃত ধুই থং মুরুং-কে অমানুষিক মারধর ও আটক রাখার চার দিন পর গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ মিথ্যা মামলায় জড়িত করে পুলিশের নিকট সোপর্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি ১৪৪, ৩৫৩, ৩৩২, ৩৩৩, ৩০৭ ধারায় মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করা হয়।
অপরদিকে অবশিষ্ট ৪ জনকে বেআইনিভাবে ১৪ দিন পর্যন্ত আটক রাখা ও নির্যাতন করার পর গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ রাতে সেনা ও বিজিবি কর্তৃক নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর উক্ত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের মিথ্যা মামলায় তাদেরকে জড়িত করা হয়।