হিল ভয়েস, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, বান্দরবান: সম্প্রতি বান্দরবান জেলা সদরের রাজভিলায় সেনামদদপুষ্ট মগপার্টি সন্ত্রাসীদের গাড়িতে অজ্ঞাত প্রতিপক্ষের গুলিবর্ষণের ঘটনায় বান্দরবান সদর থানায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সদস্যসহ ২৩ নিরীহ জুম্মর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যাভাবে পিসিজেএসএস এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং মারমা, আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য মংনুচিং মারমা, পিসিজেএসএস’র কেন্দ্রীয় সদস্য ও রোয়াংছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ক্যবামং মারমাসহ নিরীহ কয়েকজন পিসিজেএসএস সদস্য ও সাধারণ গ্রামবাসীকে জড়িত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ দুপুর ১:৪৫ টার দিকে বান্দরবান সদর থানায় এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। বান্দরবান সদর থানার মামলা নং-১৩, তারিখ-২২/০৯/২০২১, ধারা ১৪৩/৩৪১/৩২৪/৩২৬/৩০৭/৪২৭/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০। মামলাটির বাদী করা হয়েছে য়ংচিং খই (৩৩), পিতা-খুইসু প্রু, গ্রাম-পোয়াইতু মুখ, গাইন্দ্যা ইউনিয়ন, রাজস্থলী উপজেলা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা নামে এক নারীকে।
মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজসে বেআইনী জনতাবদ্ধে গতিরোধ করে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করে সাধারণ ও গুরুতর জখম করতঃ ক্ষতিসাধনের অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মামলার ভুক্তভোগী কয়েক ব্যক্তি বলেন, মামলাটি সম্পূর্ণ সাজানো এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং পিসিজেএসএস ও চুক্তির সমর্থক জনগণকে দমন-পীড়ন করার হীন উদ্দেশ্য নিয়েই এই মামলাটি সাজানো হয়েছে।
তারা আরো বলেন, মগ পার্টি একটি সম্পূর্ণ সন্ত্রাসী ও গোপন সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে থানায় এসে মামলা দায়ের করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও নির্দেশনায় এই মামলা করা হয়েছে।
মামলার অন্যতম অভিযুক্ত পিসিজেএসএস’র কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তার ফেসুবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আবার পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের শিকার হলাম। য়ং চিং খই মার্মা নামের এই মারমা নারীকে মামলার বাদী করা হলেও আমি নিশ্চিত বলতে পারি এই মিথ্যা মামলাটি সাজিয়েছে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই আর ঐ নারীকে প্রক্সি করা হয়েছে। নিশ্চিত হওয়ার কারণ হলো, মিথ্যামামলাটিতে খেটে-খাওয়া বিভিন্ন পাড়া থেকে যে লোকদের মিথ্যাভাবে আসামি করা হয়েছে তা কোনোভাবেই ঐ নারীর পক্ষে সম্ভব হতো না। তারাও ঐ নারীর মতো দুঃখের জীবনে রয়েছে।’
মামলায় এক নজরে অভিযুক্তদের তালিকা নিম্নরূপ-
১. কে এস মং মারমা (৬০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-মধ্যম পাড়া, বান্দরবান পৌরসভা, ২. গর্জন তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), পিতা-কিনাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-ঘিলামুখ পাড়া, রাজস্থলী, রাঙ্গামাটি, ৩. মংনুচিং মারমা (৫০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-চিৎমরম বড় পাড়া, চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গামাটি, ৪. ক্যবামং মারমা (৫২), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-ব্যাঙছড়ি, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান, ৫. পুসুই থোয়াই মারমা (৫০), পিতা-অংসাচিং মারমা, গ্রাম-চেমীডলু পাড়া, কুহালং ইউনিয়ন, বান্দরবান, ৬. অমর জ্যোতি চাকমা অপু (৪০), পিতা-লাম্বা চাকমা, গ্রাম-ভেদভেদি পাড়া, রাঙ্গামাটি, ৭. বাদো মারমা (৩৫), পিতা-অজ্ঞাত, ৮. বাসিংমং মারমা (৩০), পিতা-অজ্ঞাত, ৯. মংচইকে মারমা (৫৫), পিতা-অজ্ঞাত, ১০.জাইলিমং মারমা (৩০), পিতা-মংচইকে মারমা, গ্রাম-তুংক্ষ্যং পাড়া, বান্দরবান, ১১. মংসিং থোয়াই মারমা (৩০), পিতা-রেনি মারমা, গ্রাম-চিংক্ষ্যং পাড়া, রাজস্থলী, রাঙ্গামাটি, ১২. সুইলুং মারমা (৩৫), পিতা-রাওয়াই মারমা, গ্রাম- চিংক্ষ্যং পাড়া, রাজস্থলী, রাঙ্গামাটি, ১৩. ধুমং মারমা (৩০), পিতা-উসাহ্লা মারমা, গ্রাম-নোয়াপতং নিচের পাড়া, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান, ১৪. চথুই মারমা (৩৫), পিতা-উসাহ্লা মারমা, গ্রাম-নোয়াপতং নিচের পাড়া, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান, ১৫. কাক্য মারমা (৩৪), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-নোয়াপতং নিচের পাড়া, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান, ১৬. সিংনুংমং মারমা (৩৭), পিতা-মং মং মারমা, গ্রাম-তালুকদার পাড়া (হ্নাকোয়া), রোয়াংছড়ি, বান্দরবান, ১৭. মংহাই মারমা (৩৫), পিতা-মং মং মারমা, গ্রাম- তালুকদার পাড়া (হ্নাকোয়া), রোয়াংছড়ি, বান্দরবান, ১৮. ক্যউচিং মারমা দাঁড়ি (৩৮), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-উজানী পাড়া, বান্দরবান পৌরসভা, ১৯. ক্যসুইমং মারমা বাবুল (৫০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-জামছড়ি মুখ পাড়া, বান্দরবান, ২০. উচিং মং মারমা (৫৫), পিতা-ফুচউ মারমা, গ্রাম-তালুকদার পাড়া (হ্নাকোয়া), রোয়াংছড়ি, ২১. গুণধন তঞ্চঙ্গ্যা (৫০), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া, রাজভিলা ইউনিয়ন, থানা ও জেলা-বান্দরবান, ২২. শক্তিলাল ত্রিপুরা (৪৫), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-আন্তা পাড়া, রাজভিলা ইউনিয়ন, বান্দরবান, ২৩. খোকন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৭), পিতা-অজ্ঞাত, গ্রাম-৯নং রাবার বাগান, রাজভিলা ইউনিয়ন, বান্দরবান এবং আরও অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জন।
উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ বান্দরবানের রাজভিলায় সেনা-মদদপুষ্ঠ মগ পার্টি নামে খ্যাত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য বহনকারী একটি চাঁদের গাড়ি প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে বলে জানা যায়। এতে মগ পার্টির ৫ জন আহত হন। সেনাবাহিনীর একদল সদস্য তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে মগ পার্টির আহত সদস্যদের উদ্ধার করে চন্দ্রঘোনা খ্রীষ্টান মিশনারী হাসপাতালে ভর্তি করে বলে জানা গেছে। গাড়িটিতে ৮ জন মগ পার্টির সদস্য ও ৪ জন নারী ছিল বলে জানা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলায় পোয়াইতু পাড়ায় মগ পার্টির বোগ্রি মারমা (ছদ্মনাম, ‘বোগ্রি’ অর্থ প্রধান নেতা), মংক্যচিং মারমা, সবুজ মারমা প্রমুখ কম্যান্ডাররা ৬/৭ মাস পূর্বে বিয়ে করেন। অতি সম্প্রতি মগ পার্টির নিম্নস্তরের আরো ৮ জন সদস্য একসাথে বিয়ে করেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সদ্য বিয়ে করা কিছু সদস্য তাদের নববধুদের নিয়ে একটি চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে রাজস্থলী পোয়াইতু পাড়া থেকে বান্দরবানের রুমা উপজেলাস্থ সেনাবাহিনীর বগালেক পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমন করতে যান। বগালেক থেকে ফেরার পথে ১৮ সেপ্টেম্বর, শনিবার, বিকাল ৩:৩০ ঘটিকায় বান্দরবান সদর উপজেলার রাজভিলা ইউনিয়নের কিউবো পাড়ার ডাক বাংলো এলাকায় (রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়কে) পৌঁছলে মগ পার্টির সদস্যরা প্রতিপক্ষের হামলায় শিকার হন। এতে গাড়িটি উল্টে গিয়ে ২ জন নারীসহ ৫ জন মগ পার্টির সদস্য আহত হন বলে জানা গেছে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে “বান্দরবানে পর্যটকবাহী গাড়িতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণে ২ জন মারমা মহিলা আহত হয়েছে” বলে প্রচার করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় কার্বারী জানান যে, সেনাবাহিনী তাদের লালিত মগপার্টির সন্ত্রাসীদের নাম গোপন করতে এবং ঘটনাটি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে হামলার শিকার মগ পার্টি সদস্যদেরকে সাধারণ পর্যটন হিসেবে প্রচার করেছে।
মগ পার্টি সদস্যদের বহনকারী উক্ত গাড়ির উপর হামলার জন্য সেনাবাহিনী জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করে। তবে বান্দরবান জেলার জনসংহতি সমিতির দায়িত্বশীল একটি সূত্র তা অস্বীকার করেন।