হিল ভয়েস, ১৮ আগস্ট ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: গতকাল ১৭ আগস্ট ২০২১ ভারতে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (সিএনসিআই) কর্তৃক ঘোষিত ‘কালো দিবস’ উপলক্ষে অনলাইন আলোচনা সভা এবং বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক সম্মেলন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিএনসিআই’এর উদ্যোগে আয়োজিত অনলাইন আলোচনায় আগামী দিনে এই কালো দিবসকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আরও জোরালোভাবে পালন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতীয় চাকমাসহ আদিবাসী বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের কষ্টের কাহিনী নিয়ে এই অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, দিল্লী ও কানাডা থেকে নির্ধারিত বক্তাগণ আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (সিএনসিআই) এর সহ-সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিকাশ চাকমার সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরা থেকে ইন্টারন্যাশনাল চাকমা সাহিত্য এন্ড সুদোম জধা’র চেয়ারম্যান বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক নিরঞ্জন চাকমা, সিএসসিআই’র সহ-সভাপতি অনিরুদ্ধ চাকমা ও রেগা কানেক্ট এর প্রধীর তালুকদার; মিজোরাম থেকে সিএনসিআই’র সভাপতি নিরূপম চাকমা, সিএনসিআই’র মিজোরাম রাজ্য কমিটির সভাপতি রসিক মোহন চাকমা, চাকমা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের চীফ এক্সিকিউটিভ মেম্বার ও সিএনসিআই’র মিজোরাম রাজ্য কমিটির সম্পাদক দুর্যোধন চাকমা, সিওয়াইসিএ এর সভাপতি ড. জ্যোতির্ময় চাকমা ও প্রবীণ চাকমা; আসাম থেকে অল আসাম চাকমা সোসাইটি’র সহ-সভাপতি আশুতোষ চাকমা ও আলেক্সান্দার চাকমা; অরুণাচল প্রদেশ থেকে সিআরডিও এর সভাপতি মহেন্দ্র চাকমা; দিল্লী থেকে অল ইন্ডিয়া চাকমা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন এর সভাপতি পরিতোষ চাকমা এবং কানাডা থেকে প্রীতিবিন্দু চাকমা।
আলোচনায় বক্তাগণ বলেন, এই কালো দিবস শুধু বছরে একদিন নয়, এই দিবসকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং এজন্য প্রয়োজনে সহসা দিল্লীতে একটি কার্যালয় স্থাপন করা এবং সেখান থেকে বিভিন্ন লবি, প্রচার চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি এই দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে শুধু চাকমা নয়, ত্রিপুরা, মারমা, বাঙালি যাকেই পাওয়া যায়, সবার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের নিজেদের অনুভুতি ব্যাপক পরিসরে প্রচার করা এবং ছড়িয়ে দেয়া দরকার।
আলোচকগণ আগামী দিনে দিবসটি আরো জোরালোভাবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং নেতৃত্বকে মেনে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
আলোচকগণ বলেন, দেশ বিভাগের ফল হিসেবে অরুণাচলের চাকমারা এখনও পর্যন্ত নানা দুর্দশা ভোগ করে চলেছে। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিগত সাড়ে ২৩ বছরেও চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার এখন চুক্তিটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সেনাবাহিনী এখন নিজেদের সুবিধার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের চারিদিকে একের পর সড়ক নির্মাণ করে চলেছে। সেটা উন্নয়ন কার্যক্রম বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য সেটা নয়, নিজেদের সামরিক উদ্দেশ্যেই সেটা করা হচ্ছে।
সঞ্চালক শান্তি বিকাশ চাকমা তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে ১৭ আগস্টকে ‘চাকমা জাতির পরাকবাল্যা দিন’ অর্থাৎ চাকমা জাতির পোড়াকপাল দিন বলে আখ্যায়িত করেন । তিনি আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় অন্যায় করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে চাকমা জাতির দূর্গতি বৃদ্ধি পায়। তারই প্রতিবাদে ২০১৬ সাল থেকে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র আয়োজনে এই দিনটি চাকমা জাতির পড়াকবাল্যা দিন হিসেবে হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
তিনি বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন গোটা ভারতবর্ষের সাথে চাকমাদেরও খুশির জোয়ার বয়ে যায়। কিন্তু এই খুশির জোয়ারের সাথে দুঃখটাও কম ছিল না। সেটা হচ্ছে দেশবিভক্তি। এই দেশবিভক্তির কারণে গোটা ভারতবর্ষ তিন খন্ড হয়ে যায়। লক্ষ-কোটি মানুষ হেস্তনেস্ত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর মুখে পড়েন। ব্যাপক মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। এই দেশভাগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় চাকমা জাতি। এই দেশবিভাগের ফলে গোটা চাকমা জাতি দেশহারা, ভূমিহারা হয়ে এখন বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত।
তিনি আরও বলেন, যে নীতির ভিত্তিতে গোটা ভারতবর্ষ তিনভাগে বিভক্ত হয়, সেই নীতি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনোভাবে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল না। কারণ তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯৮.৫% ভাগ মানুষই ছিল অমুসলিম, অর্থাৎ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন আদিবাসী জাতির মানুষ। তবু অন্যায় করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে চাকমা জাতিকে আজ পোড়াকপাল জাতি হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
অনলাইন আলোচনা সভাটি ১৭ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬:০০ টায়, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬:৩০ টায় Dhunduk Agartala ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
অনলাইন আলোচনা ছাড়াও ত্রিপুরা রাজ্যের কাঞ্চনপুরে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি ও ত্রিপুরা চাকমা স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন এর উদ্যোগে এক সাংবাদিক সম্মেলন, গন্ডাছড়াসহ বিভিন্ন স্থানে জমায়েত এবং আসামের গোয়াহাটিতে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র আসাম রাজ্য কমিটির উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ব্যাপক গণজমায়েতের মাধ্যমে র্যালি, সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হলেও এবছর করোনা দুর্যোগের কারণে অনলাইনে ও সীমিত আকারে পালন করা হয়েছে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সাল থেকে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (সিএনসিআই) এর উদ্যোগে ভারতের চাকমা জনগোষ্ঠী প্রতিবছর ‘১৭ আগস্ট’কে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। মূলত ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় ৯৮.৫ শতাংশ অমুসলিম অধ্যুষিত (অর্থাৎ আদিবাসী অধ্যুষিত) পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদে এই কালো দিবস পালন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৪ ও ২৫ মার্চে আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত সিএনসিআই’এর প্রথম জাতীয় সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। তখন থেকে ভারতের চাকমা অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় এই ‘কালো দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।