বাংলাদেশে আদিবাসীদেরকে এখনো পেছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, উচ্ছেদ করা হচ্ছে

সজীব চাকমা

১.
আজ ৯ আগস্ট ২০২১ জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২৭তম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। বিশ্বের কোটি কোটি আদিবাসী জাতি ও জনগণের বিশেষ এই দিনে পৃথিবীর সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সকল জাতি, সম্প্রদায় ও মানুষের প্রতি জানাই আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯০টি দেশের মধ্যে ৫ হাজার নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে প্রায় ৪০ কোটির অধিক আদিবাসীর বসবাস রয়েছে। তার মধ্যে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীর জনসংখ্যা ১৫ লক্ষ ৮৬ হাজার ২৩২ জন। তন্মধ্যে সমতল অঞ্চলে ৭ লক্ষ ৪০ হাজার ৬৯১ জন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ লক্ষ ৪৫ হাজার ৫৪১ জন। তবে আদিবাসীরা মনে করেন, বাস্তবে বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা ৩০ লক্ষের অধিক হবে এবং ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে।
বিশ্বের দেশে দেশে নানাভাবে নিগৃহীত ও বঞ্চিত কোটি কোটি আদিবাসী মানুষের ন্যায় বাংলাদেশের আদিবাসীদের জন্যও এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতিবছর ‘৯ আগস্ট’কে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের মানবাধিকার, পরিবেশ, উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারকরণের লক্ষ্যে প্রথমে ১৯৯৫-২০০৪ খ্রিস্টাব্দ সময়কে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক’ এবং পরে ২০০৫-২০১৪ খ্রিস্টাব্দ সময়কে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

২.
বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের জাতীয় অস্তিত্ব ও মানবাধিকার সুরক্ষায় আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও অগ্রগতি হল ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৪৪টি রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে বিশ্বের আদিবাসী জাতিসমূহের অধিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল ‘আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ গ্রহণ। এতে মাত্র চারটি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। অপরদিকে বাংলাদেশসহ ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রকে বলা হয় আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব, পরিচয়, মর্যাদা, মানবাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জীবন্ত দলিল। জাতিসংঘ কর্তৃক এই ঘোষণাপত্র গ্রহণ বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের সংগ্রামের ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিরূপে বিবেচিত হয়। এই ঘোষণাপত্র আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার, ভূমি, অঞ্চল বা টেরিটরি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ অধিকার, ভূমির উপর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, শিক্ষাসহ নিজস্ব ভাষা ও জীবনধারা সংরক্ষণের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের জীবনধারা, আদিবাসী এলাকা ও তাদের সহায়-সম্পদকে প্রভাবিত করে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ করতে হবে।

৩.
উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে জাতিসংঘে আদিবাসী ঘোষণাপত্র গ্রহণের সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধি ভোটদানে বিরত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালেও আদিবাসী দিবসে বাণী দিয়েছিলেন। সেই বাণীতে তিনি বলেছিলেন, “জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করা হবে।” এই পূর্বেও তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে এমন বাণী দেন। তাঁর দলের আইনমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রী ও নেতা আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও আদিবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এছাড়া দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও আদিবাসীদের স্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মসহ দেশের বাঙালি ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে অনেক আগে থেকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে আসছিল।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হল, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলেই ২০১১ সাল থেকে হঠাৎ করে সরকারের পক্ষ থেকে ‘দেশে আদিবাসী নেই’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এমনকি সরকার ও প্রশাসন দেশে ‘আদিবাসী’ শব্দটি যাতে ব্যবহার করা না হয় এজন্য নানা অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করতে শুরু করে। এবং আদিবাসী ইস্যু নিয়ে আদিবাসীদের সাথে বৈরী আচরণও করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি গত ৩০ জুন ২০১১ দেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের দাবিকে উপেক্ষা করে আদিবাসীদের “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” হিসেবে অসম্মানজনক ও বিভ্রান্তিকর পরিচয়ে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর সংবিধানে নির্বিচারে বাংলাদেশের জনগণকে ‘জাতি হিসেবে বাঙালি’ বলে পরিচিত করা হয়েছে। ২৬ জুলাই ২০১১ বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নাটকীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা না করতে এবং তার পরিবর্তে ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী’, ‘Ethnic Minority’ হিসেবে অভিহিত করার আহ্বান জানান। দীপু মনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় কোন আদিবাসী নেই।’ পরবর্তীতে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল লোকজন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশে কোনো আদিবাসী নেই বলেই দাবি করে বসে। ব্যাপারটি দেশের আদিবাসীদেরকে গভীরভাবে মর্মাহত করে। শুধু তাই নয়, এরপর থেকে সরকারের অনেকেই, বিশেষ করে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দাপ্তরিকভাবে এমনকি আদিবাসী সংগঠন ও জনগণকে ‘ইন্ডিজেনাস বা আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারে নানা প্রতিবন্ধকতা ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে, মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। যা আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের অধিকার ও বাক-স্বাধীনতা হরণ করার সামিল।

৪.
তবে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অনুপ্রেরণার বিষয় হল, সরকার ও আদিবাসী বিদ্বেষী একটি মহল নানা পরিচয়ে দেশের আদিবাসীদের অস্বীকার ও হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেও জাতিসংঘসহ সারাবিশ্বের মানুষ জানে যে, বাংলাদেশে বাঙালি ব্যতীত ৫৪টির অধিক যে সংখ্যালঘু জাতি রয়েছে তারাই আদিবাসী। এছাড়া বাঙালি সুধীজন, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে আদিবাসী হিসেবেই অভিহিত করে আসছেন। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ গ্রহণের সময় বাংলাদেশ সরকার ভোট দানে বিরত থাকলেও বর্তমান সরকারের আমলে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে জাতিসংঘের উক্ত ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছে। গত ২৬ জুন ২০২১ ‘জনশুমারী ২০২১: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভাজিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিসংখ্যান” শীর্ষক এক অনলাইন ওয়েবিনারে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ৫০টি আদিবাসীসহ এর বাইরে যদি আরো থাকে তাদেরকেও আগামী অক্টোবরের আদমশুমারীতে অন্তর্ভুক্ত করবো।’ প্রয়োজনে আদিবাসীদের জন্য স্পেশাল শুমারি করারও প্রচেষ্টা থাকবে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।

এটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক এই ঘোষণাপত্র গ্রহণের পর বিগত ১৪ বছরে ঘোষণাপত্রের বিপক্ষে ভোটদানকারী চারটি রাষ্ট্র (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ঘোষণাপত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তৎসময়ে ভোটদানে বিরত থাকা তিনটি রাষ্ট্র (কলম্বিয়া, সামোয়া ও ইউক্রেন) ঘোষণাপত্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এছাড়া এই ঘোষণাপত্র মোতাবেক অনেক রাষ্ট্র আদিবাসী জাতিসমূহের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণে এবং আদিবাসীদের সমষ্টিগত অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানে সাংবিধানিক সংস্কার করেছে, নতুন আইন প্রণয়ন বা পুরোনো আইন সংশোধন করেছে।

আরো বড় বিষয় হলো- আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার, তাদের ভূমি ও ভূখন্ডের অধিকার, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বশাসনের অধিকার ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করছে। তারা পেছনে পড়ে থাকতে চাইছে না, তারা হারিয়ে যেতে চাইছে না, হেরে যেতে চাইছে না। তারা পৃথিবীর সকল অগ্রসর ও উন্নত জাতির সাথে সমানতালে এগিয়ে যেতে চাইছে। বলাবাহুল্য, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে আদিবাসীদের অপরিসীম অবদান আজ সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশেও বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ও স্রষ্টা হয়েছেন বাংলাদেশের আদিবাসী মানুষ। এদেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ বিনির্মাণে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও আদিবাসীদের অবদান নগণ্য নয়। নিশ্চয়ই আদিবাসীরা আরও অধিকতর অবদান রাখতে সক্ষম।

৫.
জাতিসংঘ এ বছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- “Leaving no one behind: Indigenous peoples and the call for a new social contract”। তারই আলোকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিপাদ্য হল- “কাউকে পেছনে ফেলে নয়: আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান”। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের আদিবাসীদের জন্য এই অঙ্গীকার যেমন যুগোপযোগী, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ।

বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মসহ দেশের আদিবাসীদের বহু আগে থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে পেছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ বহু আগে থেকে এবং বারবার বলে আসছে যে, আদিবাসী জুম্মদের জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণের ষড়যন্ত্র চলছে।

বস্তুত বর্তমানে বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চল ও সমতল উভয় অঞ্চলের আদিবাসীদের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রান্ত হচ্ছে। ধারণা করা যায়, সরকারের অনেক ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আদিবাসীদের প্রতি সহানুভুতিশীল এবং আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকলেও সরকারের মধ্যে একটি ক্ষমতাসীন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণকারী একটি প্রভাবশালী মহল আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব ও অধিকারের প্রতি চরম বৈরীভাবাপন্ন। বিশেষ করে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এর স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়।

সেই কারণেই সরকারের সকল অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবে নিস্ফলা থেকে যায়। ফলে বর্তমান সরকারের আমলে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হলেও তা এখনো পর্যন্ত কেবল কাগজে-পত্রে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সরকারের তরফ থেকে উক্ত ঘোষণাপত্র অনুসারে দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এসডিজি বাস্তবায়নে কাউকে ফেলে না রাখার বৈশ্বিক অঙ্গীকার করা হলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করেনি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের উন্নয়নের মূল শ্রোতধারায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে এখনো পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে।

৬.
অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক যে, ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সমস্যাটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হলেও দীর্ঘ ২৪ বছর হতে চললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তির কোনো মৌলিক বিষয়ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরকারী বর্তমান সরকার এক নাগাড়ে এক যুগ ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও বাস্তবায়নের কার্যক্রম একেবারে এগুইনি। ফলে চুক্তির ফলে স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের বিশেষ শাসনব্যবস্থার যে অধিকার তা আলোর মুখ দেখেনি। বলাবাহুল্য, বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে সরকার। শুধু তাই নয়, সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিজেরাই এখন প্রতিনিয়ত চুক্তি লংঘন করে চলেছে এবং চুক্তি বিরোধী ও আদিবাসী জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে।

আজকে বাংলাদেশ সরকার শুধু পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না এবং লংঘন করছে তা নয়, সেখানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনকে দিয়ে বাস্তবায়ন করে চলেছে আদিবাসী জুম্ম জাতিবিধ্বংসী নান পদক্ষেপ, প্রকল্প ও পরিকল্পনা। এখন চুক্তির পূর্বের মতই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রায় সকল গণতান্ত্রিক কার্যক্রমকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে গণহারে মিথ্যা মামলা দিয়ে, আটক করে, অনেককে জেলে দিয়ে, বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে, হুমকি প্রদান করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে বাড়িঘর ছাড়তে এবং আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করেছে। অপরদিকে, চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে আদিবাসীদের ভূমি আদিবাসীদের ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে আশি ও নব্বই দশকে হাজার হাজার জুম্ম পরিবার সরকার ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক বেদখলকৃত তাদের ভূমি ও জায়গা-জমি এখনও ফেরত পায়নি। উল্টো আদিবাসী জুম্মদের মতামতকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীসহ সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে শত শত কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, পুরাতন ক্যাম্প সম্প্রসারণ ও নতুন ক্যাম্প স্থাপন করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার পদদলিত ও স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এখনও প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল চলছে।

শত শত আদিবাসী জুম্ম পরিবারের বাগান-বাগিচা ধ্বংস ও ভূমি দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে সাজেক সীমান্ত সড়ক এবং রাজস্থলী হতে বরকলের ঠেগাদোর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ। জুম্মদের উচ্ছেদ করে সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক সাজেকে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র। অপরদিকে স্থানীয় আদিবাসীরাসহ দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেনাবাহিনী ও বিতর্কিত শিকদার গ্রুপ কর্তৃক বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচতারা হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটন স্থাপনা। যার ফলে আদিবাসী ম্রোদের আনুমানিক ১০০০ একর ভোগদখলীয় ও চাষের ভূমি বেদখল হওয়ার আশংকা রয়েছে। যার ফলে ম্রোদের ৬টি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদের মুখে পড়বে এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা, চাষের ভূমি, ফলজ বাগান, পবিত্র জায়গা, শশ্মান ঘাট ও পানির উৎসগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া তাদের সংরক্ষিত পাড়াবন ও জীববৈচিত্র্য অচিরেই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কেবল সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র সড়ক নির্মাণ, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন এবং পুরনো সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ ও নতুন ক্যাম্প স্থাপন করার মাধ্যমেই শত শত পরিবার জুম্মর বসতভিটা, শ্মশানভূমি, বাগান-বাগিচা, জুমভূমি, সামাজিক বন ও বিচরণ ক্ষেত্র বেদখল করা হয়েছে।

এছাড়া আদিবাসীদের দমন ও সেনাশাসন জারি রাখার স্বার্থে সরকারি মহলের মদদে সৃষ্টি করা হয়েছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সরকারী মহল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে জুম্মদের ধর্মান্তরিতকরণ, বহিরাগত অনুপ্রবেশ, সেটেলারদের কর্তৃক ভূমি বেদখল ও সেটেলার বসতির সম্প্রসারণ। অপরদিকে সমগ্র পার্বত্য এলাকায় সেনাশাসন ও সেনা কর্তৃত্ব জোরদার করে জুম্মদের প্রতিবাদের ভাষাকে করা হয়েছে অবরুদ্ধ।

৭.
শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের উপর বৈরীতা ও বঞ্চনা চলছে এমন নয়। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের মানবাধিকার ও জাতিগত অস্তিত্বের অবস্থাও আজ অত্যন্ত শোচনীয় ও বিপর্যয়কর অবস্থায় উপনীত হয়েছে। দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, পটুয়াখালী, মহেশখালী, বরগুনা, সীতাকুন্ড, কক্সবাজারসহ প্রভৃতি সমতল এলাকায় যেখানে যেখানে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে সেখানে চলছে আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন ও তাদের ভূমি বেদখলের নানা প্রচেষ্টা। কখনো বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর প্রভাবশালী প্রতিবেশীরা, কখনো বনবিভাগসহ সরকারি সংস্থা অথবা কোনো বড় কোম্পানি নানা নিপীড়ন ও হামলা চালিয়ে, সম্পত্তির উপর আঘাত করে ইকো পার্ক বা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। এসব এলাকায় ক্রমে আদিবাসীদের জনসংখ্যা ও বসতি কমে যাচ্ছে।

সম্প্রতি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মৌটুটিয়াখালীতে (ছ আনিপাড়া) পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রায় তিনশ’ বছরের পুরনো ছয়টি রাখাইন পরিবারকে উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধমন্দির, মন্দিরের মঠ ও দেবোত্তর সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। গত মে মাসে আবুল খায়ের গ্রুপ কর্তৃক চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ত্রিপুরা পল্লীতে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী আদিবাসী ত্রিপুরাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের টেলকী গ্রামে আদিবাসীদের ভূমি ও প্রাচীন কবরস্থানে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে আরবোরেটুম বাগান সৃষ্টি, রেস্ট হাউজ ও প্রাচীর নির্মাণ করে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বনবিভাগ কর্তৃক মধুপুরে আদিবাসীদের বাসভূমিকে জাতীয় উদ্যান ও তথাকথিত সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে ভূমি উদ্ধারের নামে অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ২৬ মে ২০২১ ও ৩০ মে ২০২১ পর পর দুই দিনে মৌলভীবাজার জেলাধীন বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে বহিরাগত দুর্বৃত্তদের কর্তৃক আদিবাসী খাসিয়া জনগণের তিনটি পানজুম বেদখল এবং অন্তত এক হাজার পান গাছ কেটে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ১৯ জানুয়ারি ২০২১ দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটে ভূমিদস্যু কর্তৃক ভূসম্পত্তি বেদখলের উদ্দেশ্যে মাহাতো আদিবাসীদের উপর হামলায় পাঁচজন আদিবাসী নারী আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ২৬ এপ্রিল ২০২১ দিনাজপুর জেলাধীন পার্বতীপুর উপজেলার আদিবাসী সাঁওতাল অধ্যুষিত বড়চন্ডীপুর (বারকোনা) সাঁওতাল গ্রামে ভূমি বিরোধের জেরে ভূমিদস্যুদের হামলায় দুই নারীসহ তিন আদিবাসী সাঁওতাল আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রকৃতপক্ষে প্রায় নিয়মিত এভাবে আদিবাসীদের উপর কোনো না কোনো নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লংঘনমূলক ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে না আসায় চাপা পড়ে যাচ্ছে।

৮.
আদিবাসীদের বঞ্চিত করে এবং আদিবাসীদের দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশ কখনো একটি সুন্দর, বৈচিত্র্যময় ও উন্নত ভবিষ্যত রচনা করতে পারে না। যুগে যুগে বাংলাদেশের প্রগতির ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অমূল্য অবদান রয়েছে। আমরা আশাকরি, সরকার আদিবাসীদের অধিকার ও দাবির প্রতি এবং জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রসহ সংশ্লিষ্ট দলিল ও তার আহ্বানের প্রতি সম্মান জানাবে। আমরা আরও আশা করবো, সরকার ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক গৃহীত আদিবাসী বিরোধী সকল প্রকল্প ও উদ্যোগ বাতিল করা হবে।

দীর্ঘ ২৩-২৪ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায়, উপরন্তু সেনাশাসন জোরদারকরণসহ সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম গ্রহণ করায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ বিস্ফোরন্মুখ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মানবাধিকার পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে। বস্তুত সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক সেখানে সেনাশাসন এবং চুক্তি ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম পরিহার করে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া সমস্যার সমাধান, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আদিবাসী জুম্মদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প কোনো পথ নেই। অপরদিকে সমতলের আদিবাসীদের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির অধিকার সুরক্ষাকল্পে পৃথক ভূমি কমিশন ও পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন এবং আদিবাসীদের উচ্ছেদমূলক কার্যক্রম ও হামলা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ আদিবাসীদের সকল ন্যায্য দাবি ও প্রাপ্য অধিকার এবং সরকারের প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নতুন উপলব্ধিতে জাগ্রত হওয়া এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

৫৪টির অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সাংস্কৃতিক বৈভবপূর্ণ আদিবাসী জাতিকে পেছনে ফেলে রেখে এবং তাদের অস্বীকার করে বাংলাদেশ কখনো মননে, চেতনায়, উন্নয়নে অগ্রগতির পথে ধাবিত হতে পারবে না। অপরদিকে অধিকারকামী ও প্রগতিকামী আদিবাসী জনগণও কখনো নিপীড়ন, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য মেনে নেবে না।

More From Author