হিল ভয়েস, ৯ আগস্ট ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত এক শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, দেশে আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি দখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম বন্ধ রেখে চলেছে।
আজ ৯ আগস্ট ২০২১ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আদিবাসী ও দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রেরিত এক শুভেচ্ছা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেছেন। তাঁর সম্পূর্ণ শুভেচ্ছা বক্তব্যটি নিম্নে প্রদান করা হল-
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে
সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা’র শুভেচ্ছা বক্তব্য
৯ আগস্ট ২০২১
বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবার এসেছে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এই মহান দিবসে আমি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯০টি দেশের ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী ও সকল মুক্তিকামী মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এ দিবসটি আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নব চেতনায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। বিশেষ অনুপ্রেরণার দিন।
এ বছরও কোভিড ১৯ মহামারির কারণে ভিন্নভাবে দেশের আদিবাসী জনগণ আদিবাসী দিবস উদযাপন করছে। এবার জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “কাউকে পেছনে ফেলে নয়ঃ আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান।”
আমরা সবাই জানি, এই করোনাকালে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। সুচিকিৎসার অভাবসহ লকডাউনের কারণে নানা অর্থনৈতিক সংকটে এই প্রান্তিক মানুষেরা দুর্বিষহ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দলীয় স্বজনপ্রীতি ও জবাবদিহিহীনতার ফলে প্রান্তিক মানুষ এসবের আশানুরূপ সুফল পাচ্ছে না। আমি করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
দুঃখের বিষয়, দেশে আজো আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি দখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম বন্ধ রেখে চলেছে। বলাবাহুল্য বিগত ২৩ বছরেও চুক্তিরমৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বহুবার দাবি তুলে ধরা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর পরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করা হয়নি। পক্ষান্তরে অপারেশন উত্তরণ নামক সেনা কর্তৃত্ব পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করা হয়নি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করেনি। আজ আদিবাসী দিবসে আমি সরকারের প্রতি এইসব অঙ্গীকার পুরণের আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশ বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্খা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আদিবাসী জনগণের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, আজ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রবল আগ্রাসনে তথা বিশ্বায়নের প্রবল জোয়ারে তাদের সেই পরিবেশবান্ধব সংস্কৃতি ও জীবনধারা বিপন্ন হতে চলেছে।
আজ আদিবাসী দিবসে আমি জাতিসংঘ ঘোষিত মূলসুর “কাউকে পেছনে ফেলে নয় ঃ আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান” কথাটি প্রতিধ্বনিত করতে চাই। আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি আদিবাসী দিবসে দেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে অধিকতরভাবে আদিবাসী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানাই।
পরিশেষে এ দেশের শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত আদিবাসীসহ অধিকার-বঞ্চিত সকল মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে চলুক, এই কামনা করি।
জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সভাপতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম