হিল ভয়েস, ১৮ জুলাই ২০২১, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি) এর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বিষয়ক সাইড ইভেন্ট রাষ্ট্র ও আদিবাসী জাতিসমূহের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিসমূহ এবং বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগসমূহের উপর একটি গবেষণা চালানোর জন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মেকানিজম (এমরিপ) ও মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এর কাছে সুপারিশ জানিয়েছে।
এআইপিপি “এশিয়ায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার কিভাবে আদায় হতে পারে; চ্যালেঞ্জসমূহ মূল্যায়ন এবং সক্রিয়করণের শর্তসমূহ অন্বেষণ” বিষয়ক একটি সাইড ইভেন্টের আয়োজন করে। গত ১৫ জুলাই জেনেভা সময় সকাল ১০:০০ টায় এমরিপ ২০২১ এর ১৪তম অধিবেশনের অতিরিক্ত সময়ে ভার্চুয়ালি আয়োজিত এই ইভেন্টের সহ-আয়োজক ছিল ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজেনাস এ্যাফেয়ার্স (ইবগিয়া), ডিপ্লোম্যাসি ট্রেইনিং প্রোগ্রাম (ডিটিপি) ও ইন্ডিজেনাস পিপল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারর্স নেটওয়ার্ক (আইপিএইচআরডি)।
অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট এর সেক্রেটারি জেনারেল মি. গ্যাম এ শিমরে, যেখানে এশিয়ার চারটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন এর চার আলোচক তাদের স্ব স্ব দেশে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ চর্চার পরিপ্রেক্ষিতের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেন। মি: চাকমা বলেন, রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া সত্ত্বেও সরকার এখনো পর্যন্ত চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসেনি।
মি: চাকমা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি জানতে, প্রতিবন্ধকতা ও ব্যবধানসমূহ চিহ্নিত করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন গবেষণা পরিচালনা করার জন্য এমরিপের নিকট সুপারিশ জানান। এছাড়া তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগণের নিকট আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সহজতর করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অপারেশন উত্তোরণসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর করতে, সাধারণ প্রশাসন, আইন ও শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ ইত্যাদি হস্তান্তর বিষয়ে বাংলাদেল সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা পিপলস মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস এর সদস্য মি: আখুম লংকুমার বলেন, সরকার ও উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসী জনগণের মধ্যে প্রায় ১৪টি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে, সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রের ‘শান্তি’র সংজ্ঞা ও এইসব ‘চুক্তি’র চেতনা অব্যাহভাবে সমস্যাসঙ্কুল হয়ে থাকছে।
তিনি এই অঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনকে এগিয়ে নিতে পরিস্থিতিকে বোঝার জন্য এবং স্থানীয় পর্যায়ে ও জাতিসংঘে সংলাপ আয়োজনে সাহায্য করার জন্য ভারত সরকার এবং নাগা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য আদিবাসী জনগণের মধ্যে শান্তি সমঝোতাসহ শান্তিচুক্তিসমূহের উপর একটি গবেষণা চালাতে এমরিপ ও মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের কার্যালয়কে পরামর্শ/সুপারিশ প্রদান করেন।
ফিলিপাইনের কাট্রিবু (ন্যাশনাল এলায়েন্স অব ইন্ডিজেনাস পিপলস অরগানাইজেশন) এর আন্তর্জাতিক সংহতি কর্মকর্তা মিস ভেবারলি এল লংগিড বলেন, ১৯৯৭ সালের ফিলিপাইনের আদিবাসী জনগণের অধিকার আইন’কে বিশ্বে আদিবাসী জনগণের আচরণ সংশ্লিষ্ট এই ধরনের অন্যতম একটি প্রগতিশীল আইন বলে উল্লেখ করা হয়। এটা ছিল ১৯৮৭ সালের ফিলিপাইন সংবিধানে সন্নিবেশিত একটি প্রগতিশীল বিধানের প্রত্যক্ষ ফল, যা স্বৈরাচার ফার্ডিনান্দ মার্কোসের ক্ষমতাচ্যুতির পর সৃষ্টি ও অনুমোদন করা হয়। বর্তমান দুতার্তে শাসনের অধীনে ন্যাশনাল কমিশন অন ইন্ডিজেনাস পিপলস (এনসিআইপি) এর নিজের স্বার্থে এফপিআইসি (স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি) অধিকারের ব্যবহার সবচেয়ে শোচনীয় হয়ে উঠেছে। ইহা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, স্বার্থ, ও কল্যাণকে সুরক্ষা দেয়নি এবং অগ্রগতিতে সাহায্য করেনি। বরং ইহা আদিবাসী জনগণের অধিকতর দমন-পীড়ন ও শোষণের জন্য একটি প্রাথমিক যন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।
মিস বেভারলি বলেন, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে একটি যোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য প্রশাসন এগিয়ে নিতে বৃহৎ জাতীয় জোটে অংশগ্রহণ করা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা হবে আসন্ন নির্বাচনে আমাদের সমস্যা ও আকাক্সক্ষাগুলো তুলে ধরার একটি উপায় এবং একটি ঐক্যবদ্ধ বিরোধী অবস্থান বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর অংশ। অনেক নীতিমালা যেগুলো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ও ফিলিপিনো জনগণের স্বার্থে কাজ করে না সেগুলো তীক্ষèতর করা, বিশ্লেষণ করা এবং সচেতনভাবে পরিবর্তন করা অপরিহার্য।
মিয়ানমার থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর এক অধিকার কর্মী মি: কে জুং আদিবাসী জনগণের আন্দোলন, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সংগ্রাম এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্তমান পরিস্থিতি, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে কথা বলেন।
তিনি বলেন, যদিও আমাদের সরকার ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার এবং মিয়ানমারের জনগণের জন্য সমঅধিকার বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এছাড়া তিনি জাতীয় যুদ্ধ বিরতি চুক্তির (২০১৫) ভিত্তিতে ইউনিয়ন শান্তি সম্মেলন/২১তম পাংলং সম্মেলন এর মাধ্যমে সৃষ্ট ইউনিয়ন চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ইউনিয়ন শান্তিচুক্তিটি বাস্তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারগুলো সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে জাতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর বিগত পাঁচ বছরে আমরা যা অর্জন করেছি বর্তমান সামরিক অভ্যুত্থান পরিস্থিতি সেটাকে আবার পেছনে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা এখন ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চিত। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নের জন্য সামরিক শাসন কোনো সমাধান নয়।
জাতিসংঘ এমরিপের ভাইস-চেয়ার মি: বিনোতাময় ধামাই এই বছরের এমরিপের খসড়া প্রতিবেদন থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক মানবাধিকার র্যাপোর্টিয়ারশিপ সংক্রান্ত আন্ত-আমেরিকান কমিশনের বিশেষজ্ঞ এটর্নি মি: লিউনার্দো আলভারাদো একটি বিশেষ ভিডিও বার্তা নিয়ে অনুষ্ঠানের মাঝখানে অংশগ্রহণ করেন।
ইবগিয়া’র গ্লোবাল গভর্ন্যান্স সিনিয়র উপদেষ্টা মিস লোলা গার্সিয়া এলিক্স এবং ডিপ্লোম্যাসি ট্রেইনিং প্রোগ্রাম (ডিটিপি) এর নির্বাহী পরিচালক মি: প্যাট্রিক আরলে কিছু বৈশ্বিক সুপারিশমালা নিয়ে তাদের সমাপনী বক্তব্য রাখেন।
সাইড ইভেন্টের বৈশ্বিক সুপারিশমালা:
১. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মেকানিজম ও মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় এশিয়ায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাষ্ট্র ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের অগ্রগতিতে সাহায্য করতে বাধাসমূহ পরীক্ষণ এবং সক্রিয়করণের শর্তসমূহ সৃষ্টিকরণের উপর আলোকপাত করে চলমান শান্তি আলোচনাগুলোসহ শান্তিচুক্তিসমূহ ও সমঝোতা উদ্যোগগুলোর উপর একটি গবেষণা শুরু করুক।
২. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও সর্বজনীন মানবাধিকার মানদন্ডের ভিত্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের উপলব্ধি ও বাস্তবায়নের জন্য পথনির্দেশক নীতিমালাসমূহের উন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য রেখে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়াকে সহজতর করার জন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম ও স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার এর সাথে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মেকানিজমকে উৎসাহিত করা। এশিয়া থেকে আদিবাসী সংগঠনের অর্থপূর্ণ ও ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মেকানিজম ও স্থায়ী ফোরামের উচিত মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় এবং জাতিসংঘের রাজনৈতিক ও শান্তি গঠন বিষয়ক বিভাগকে সাথে নিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের উপলব্ধি ও বাস্তবায়নের জন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে সংলাপকে সহজতর করা।
৪. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসন ব্যবস্থা বিষয়ে বিভিন্ন মেকানিজমের প্রতিবেদনে গৃহীত সুপারিশসমূহ যৌথভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য এবং এসব গুরুত্বপূর্ণ অধিকারসমূহের বাস্তব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতিসাধনের জন্য তাদের কাজ ও সহযোগিতাকে পথনির্দেশ করতে পারে এমন একটি সাধারণ রোডম্যাপ প্রণয়ন করার জন্য টঘচঋওও, স্পেশ্যাল র্যাপোর্টিয়ার, ও ওঅঈঐজ-কে সাথে নিয়ে একটি আন্ত-অধিবেশন সংক্রান্ত কৌশলগত সেমিনার আয়োজনে সহযোগিতা করতে এমরিপকে সুপারিশ।
৫. জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র প্রবর্তনে ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম আচরণ ও অর্জিত শিক্ষার উপর রাষ্ট্র ও তাদের জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট সুপারিশমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহ (জিএএনএইচআরআই) এর বৈশ্বিক জোটের সাথে একটি সংলাপ আহ্বানের জন্য এমরিপকে সুপারিশ।
সূত্র: ইন্ডিজেনাস পিপলস হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারর্স-আইপিএইচআরডি’র নেটওয়ার্ক, এশিয়া (ফেসবুক পেইজ)