মিতুল চাকমা বিশাল
বাংলাদেশ, যার রাষ্ট্রীয় নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’। ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এবং বিশ্বে এক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জাতি হচ্ছে বাঙালি জাতি, তবে এদেশে বাঙালি ছাড়াও ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। ভিন্ন সংস্কৃতির এই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোই বাংলাদেশকে একটি বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যমন্ডিত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে তুলে ধরেছে। কিন্তু অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক এই যে, দেশের অভ্যন্তরে এই বৈচিত্র্যময় ফুলগুলোর আবাস হলেও, রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে তাদের স্থান হয় নি। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ আইনী দলিল সংবিধান নামক কাঠামোতে আদিবাসীদের স্বীকৃতি মেলেনি। বরং তাদের ভিন্নতাকে, তাদের বৈচিত্র্যতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। পরিবর্তে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ বলে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়কে হীন করা হয়েছে এবং বাঙালি জাতির ‘উপ’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে তাদেরকে সেই রাষ্ট্র কাঠামোতে উপজাতি, ক্ষুদ্র-জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী প্রভৃতি নামে পরিচয় করানো হয়েছে। আধিপত্যবাদী আর উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের এই রাষ্ট্র আদিবাসীদের আপন করে নিতে পারে নি, যদিও তারা বাংলাদেশেরই অধিবাসী এবং নাগরিক।
বর্তমান সময়ে দেশ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে তেমন কোন তূলনামূলক পার্থক্যই দেখা যায় না। যেটাকেই বর্তমানে দেশ বলা যাচ্ছে অপরদিকে সেটিই আবার কোন না কোন রাষ্ট্র বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোদ্দা কথায় দেশ এবং রাষ্ট্রের ধারণাটা একই জায়গায় এসে ঠেকেছে। বস্তুতঃপক্ষে দেশের ক্ষেত্রে আমরা কেবল ভূখন্ডের কথাই ধরতে পারি (যেমনটি গ্রীনল্যান্ড একটি দেশ, কিন্তু এটি রাষ্ট্র নয়), কিন্তু যখনই সেই ভূখন্ডে, কোন জনসমষ্টি সরকার গঠন করে নিজেদের সার্বভৌম বলে স্বীকৃতি আদায় করে তখনই সেটা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে রাষ্ট্র বলেই গণ্য হয়। অপরদিকে আধুনিক রাষ্ট্র বলতেই কোন না কোন এক আধিপত্যকারী শ্রেণির রাষ্ট্রকেই বোঝায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণিটি অবশ্যই শাসকশ্রেণিরুপে আবির্ভূত হয় এবং অপর শ্রেণিগুলি শাসিত বা শোষিত হতে থাকে। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলিতেও সেই একই চিত্র বেশ লক্ষণীয়। অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রই বুর্জেয়া আদর্শে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র, যাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজির লগ্নিকরণ তথা সম্পদের কেন্দ্রীকরণ। এধরনের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের চরিত্রই জাতীয়তাবাদী এবং তারা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বাস্তবিকপক্ষে অপর শ্রেণি ও জাতিগুলিকে শোষণের পথকে প্রশস্ত করে। রুশ বিপ্লবের মহান স্রষ্টা মহামতি লেনিনের ভাষায়, ‘রাষ্ট্র হইতেছে সমাজ হইতে উদ্ভূত এমন এক শক্তি, যাহা ক্রমেই সমাজ হইত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র হইতেছে এক শ্রেণি কর্তৃক অপর এক শ্রেণিকে শোষণ করিবার যন্ত্র, স্বশস্ত্র লোকেদের বিশেষ প্রতিষ্ঠান, জেলখানা ইত্যাদি’।
বর্তমান জাতিরাষ্ট্রগুলোকে সংখ্যাধিক্য জাতির পরিচয়েই পরিচিত করানো হয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন জাতিরাষ্ট্রই নেই যেখানে নিরঙ্কুশভাবে কেবলমাত্র একটি জাতিরই অবস্থান। অনুরূপভাবে বাংলাদেশকেও একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে বাংলাদেশেও বাঙালি ভিন্ন আরো ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যারা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের বাঙালি জনগণের সাথে বসবাস করে আসছে নিজস্ব স্বকীয়তা এবং বৈচিত্র্যতাকে রক্ষা করেই। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছে বিজাতীয় শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির নেতৃত্বের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এটিও সত্য যে, যে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, দেশের বাঙালি ভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীও তাতে সামিল হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে কোনোমতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলা যায় না। আদিবাসীরা যুদ্ধে সামিল হয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে। শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তারা। এবং অবশ্যই একটি আশা নিয়ে, সেটি হচ্ছে, যে জাতি বিজাতীয় শাসন থেকে মুক্তি পেতে রক্ত দিতে পারে, তাদের রাষ্ট্রে হয়তো আদিবাসীরা নিরাপদে থাকতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি, সেই আশাটি ছিল সুদূর পরাহত। বরং উগ্র জাত্যভিমান, ধনতন্ত্র আর মৌলবাদের কালো ছায়ায় বরাবরই আদিবাসীদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। প্রতি পদে পদে রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের শিকার হয়ে উচ্ছেদ হয়েছে, দেশান্তরী হয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্র এদেশের আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি রাজনৈতিকভাবে নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে নি।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে বিখ্যাত ফরাসী মার্কসবাদী দার্শনিক লুই আলথুসের রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ বিষয়গুলো নিয়ে এগোনো যথার্থ হবে বলে মনে করি। উনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটি রাষ্ট্রে অধিপতি শ্রেণি নিজেদের আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখে এবং কিভাবে অধিপতি শ্রেণির ভাবাদর্শগুলো পুনরোৎপাদন করে চলে, যা অপর শ্রেণিকে দমন করতে ভূমিকা রাখে। তিনি দুটো বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস’। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোতে দুই ধরনের হাতিয়ার বিদ্যমান। একটি ভাবাদর্শিক, অপরটি দমনমূলক। ভাবাদর্শিক হাতিয়ার বা ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’-এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি বিষয়ক এবং ধর্মীয় দিকগুলো। যেমন, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, আইনব্যবস্থা ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ‘রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস’ বা রাষ্ট্রের দমন যন্ত্রগুলো, শাসন যন্ত্রগুলো। যেমন-পুলিশ, সেনাবাহিনী, জেলখানা ইত্যাদি। তিনি দেখিয়েছেন যে, উপরোক্ত কাঠামোগুলো সাদাসিধে কোন হাতিয়ারমাত্র নয়, বরং এক জঠিল কাঠামো। এরূপ প্রত্যেক জটিল কাঠামেরূপী হাতিয়ারেই রয়েছে বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং একটি বিশেষ ভাবাদর্শ। যাদের সাথে রয়েছে অধিপতি শ্রেণির বস্তুগত সহায়তা ও প্রকাশ্যে রয়েছে তাদের ভাবাদর্শের অনুশীলন।
উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করা হয়, তাহলে বিষয়গুলো বুঝতে আরো সুবিধা হবে। বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ একটি মূৎসুদ্দী বুর্জোয়া ভাবাদর্শের রাজনৈতিক দল। একই সাথে তারা দেশের সংখ্যাধিক্য বাঙালি জাতির বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শও অবশ্যই পোষণ করে। আর জাতীয়তাবাদের দুইটি দিক হচ্ছে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ। স্বভাবতই দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অধিপতি শ্রেণিটি নিঃসন্দেহে উগ্র জাতীয়তাবাদী। ফলশ্রুতিতে বুর্জোয়া ভাবাদর্শের এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্রেণিটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায়, সে তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ক্রমাগত নিজের ভাবাদর্শকে পুনরোৎপাদন করার প্রক্রিয়াটি চলমান রাখে। যেটির শুরু পরিবার থেকেই করা হয়। মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক সম্পর্ককে তারা অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কে নামিয়ে আনে এবং সেটি পুঁজির লগ্নিকরণের মাধ্যমে। পরিবারের ছোট্ট সেই শিশুটিকে মানুষ হওয়ার বদলে তার সামনে অর্থনৈতিক দিকটিই বড় করে দেখানো হয়। বেঁচে থাকার জন্য যে কাউকে শোষণ করতেই হবে-এই বদ্ধমূল ধারণাটা তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। অপরদিকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সেই ভাবাদর্শকে আরো মজবুত করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। কেননা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রদত্ত শিক্ষা কোনকালেই অধিপতি তথা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণির বিপরীতে হয় না। বরং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই অধিপতি শ্রেণিটির ভাবাদর্শকে পুনরোৎপাদন করতে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রের এই উভয় দিকগুলিই দেখতে পাই। উগ্র জাতীয়তাবাদীর খোলসে থেকে বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসমূহকে নিশ্চিহ্ন এবং সমূলে উৎখাত করার যে কৌশল, সেই কৌশলগুলোই হচ্ছে আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস এবং রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড, পর্যটন ইত্যাদি বিষয়গুলো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ভাবাদর্শিক হাতিয়ার। শিক্ষায় মৌলবাদ এবং একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, দেশে এমন একটি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটাচ্ছে, যারা বাঙালি এবং মুসলিম ভিন্ন অন্য কাউকেই মানুষ এবং জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এমনকি বাঙালি তথা মুসলিম ভিন্ন সেই জাতিসমূহের মানুষদের ইসলাম বিরোধী, ইসলামের শত্রু বলে প্রতিনিয়ত নিগ্রহের স্বীকার হতে হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী বিষয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। তাদের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে শাসকগোষ্ঠীর ভাবাদর্শেরই প্রতিফলন ঘটানো হচ্ছে এবং সেই একই ভাবাদর্শের পুনরোৎপাদন করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে যেসমস্ত শিশুরা, ছাত্ররা এসব পড়ে, জেনে বড় হচ্ছে, তাদের মনেও সেই একই শ্রেণি-শাসকগোষ্ঠীর ভাবধারা তৈরি হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মৌলবাদীকরণ, বিধর্মীদের কাফের ইত্যাদি হিসেবে আখ্যায়িতকরণ, প্রভৃতি বিষয়গুলোও রাষ্ট্রের সেই অধিপতি উগ্র ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদী শ্রেণিীটির ভাবাদর্শেরই পুনরোৎপাদন করে চলে। মোদ্দাকথায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের পুঁজিবাদী ধারণার এমন একটি শ্রেণি পুনরোৎপাদন করে চলেছে, যেটি একাধারে পুঁজিবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং একইসাথে মৌলবাদীও।
এইভাবে রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী তার আইডিওলজিক্যাল হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেটাকে ঠিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। কেননা কেবলমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই রাষ্ট্রের ক্ষমতার স্থায়ীত্বকে অর্জন করা যায় না, তার জন্য তার কলকব্জাগুলোর ভাবাদর্শিক স্থায়ীত্বটাকেও অর্জন করতে হয়।
রাষ্ট্রের আইডিওলজিক্যাল অ্যপারেটাস-এর পুনরোৎপাদনের ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই যে, রাষ্ট্র এমন কিছু সংবাদ মাধ্যম বা মিডিয়া সৃষ্টি করে, যাদের উদ্দেশ্য কেবল রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণিটির গুণগান গাওয়া। রাষ্ট্রীয় মাধ্যমগুলোর বাইরে, অন্য মাধ্যমগুলোর উপর আরোপ করা হয় কঠোর সেন্সরশীপ। অর্থাৎ সেই সমস্ত সংবাদগুলোই প্রকাশিত হবে, যেগুলো রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে। ফলশ্রুতিতে মানুষ সত্য জানা এবং শোনা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। এইভাবে একটি সংবাদমাধ্যমও রাষ্ট্রের ভাবাদর্শের পুনরোৎপাদন করে চলে।
একইভাবে উন্নয়ন, পর্যটন, বনায়ন প্রভৃতি বিষয়গুলোর সাথেও রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণিটির আধিপত্যবাদী এবং আগ্রাসী ভাবাদর্শের খোঁজ পাওয়া যায়। কেননা, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে উন্নয়ন এবং পর্যটন স্থাপনা করার সময়ে তাদের মতামতকে সম্পূর্ণরূপে আগ্রাহ্য করা হয়, এমনকি তাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করা হয় না। ফলাফল হিসেবে যা দাঁড়ায়, এই উন্নয়ন আদিবাসীদের জন্য কাল হয়ে মাথাচড়া দিয়ে ওঠে এবং একটা সময় তাদেরকে গ্রাস করে ফেলে। অন্যদিকে দেশের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীকে এই বিষয়টি অত্যন্ত সহজভাবে গেলানো হয় যে, আদিবাসীরা উন্নয়ন বিরোধী, পর্যটন বিরোধী। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তথা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, উন্নয়ন শব্দটির সাথে শোষণের পথটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই উন্নয়নের মধ্যদিয়েই শোষণ আর দমনের পথকে আরে উন্মুক্ত এবং প্রশস্ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই তথাকথিত উন্নয়ন লুন্ঠন প্রক্রিয়ার আরেক নাম ছাড়া আর কিছুই নয়।
অপরদিকে দেশের এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সমগ্র দেশের এক-তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা, তার উপর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উপচে পড়া উপস্থিতি, পুলিশ, আনসার বাহিনী প্রভৃতি আধা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি, সমতল অঞ্চলে আইনী বিধি ব্যবস্থার দ্বারা নিরাপত্তা বাহিনী, ফরেস্ট গার্ড, পুলিশ বাহিনীর উপস্থতি হচ্ছে ‘রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস’। মূলত আইনী ব্যবস্থাটি উভয় দিক দিয়েই কাজ করে থাকে। আইনী ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিগুলো রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণিটির ভাবাদর্শের পুনরোৎপাদন করে চলে। অপরদিকে সেই আইনী ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং অন্যন্য দমনমূলক বাহিনীগুলোও রাষ্ট্রের অধিপতি শ্রেণিটির ক্ষমতা রক্ষার্থে দমনযন্ত্র হিসেবে কাজ করে চলে এবং সেই সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনরোৎপাদন করে চলে।
আমরা দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি প্রভৃতি বাহিনীগুলো রাষ্ট্রের দমননীতির কত সুক্ষ্ম বাস্তবায়ন করে চলে। বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশী এবং জুম্ম জনগণকে হয়রানি, মিথ্যে মামলা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে হয়রানি, মারধর। অপরদিকে সেই রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শকে কাজে লাগাতে, পাহাড়িদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিশ্চিহ্ন করতে জোরপূর্বক ভূমি দখলের কার্য চলমান রাখা। বহিরাগতদের পুনর্বাসনের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বি-টীমে পরিণত করে তাদেরকেই পাহাড়িদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া।
সমতল অঞ্চলের চরিত্রটাও এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও বনবিভাগ ইচ্ছামত জোর খাটিয়ে ভূমি দখল করে চলেছে এবং প্রতিবাদ করতে গেলেই রাষ্ট্রীয় দমন বাহিনীগুলিকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোনরূপ আলোচনা, পরামর্শ ব্যতিরেকে তাদের আবাসস্থলকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে, ইকোপার্ক, ইকোট্যুরিজমের নাম করে সাইনবের্ড ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিয়ে ভূমি দখলে নামে, আদিবাসীদের ভূমির কথা থাক, রাষ্ট্রীয় ভূমিগুলোকেও নিজেদের বলে দাবি করে তারা।
প্রকৃতপক্ষে আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস যে ভাবাদর্শকে টিকিয়ে রাখতে চায়, রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস সেই ভাবাদর্শকে সুরক্ষা দিয়ে চলে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকশ্রেণির সমতলের আদিবাসী তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব, তাদেরকে বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে সমূলে উৎখাত করার যে প্রক্রিয়া, বাংলাদেশকে নিরঙ্কুশ বাঙালি জাতির ভূমিতে পরিণত করার যে ভাবাদর্শ, সেইটাই রাষ্ট্রের দমনমূলক বাহিনীগুলো বাস্তবায়ন করে চলে, সহিংস পন্থায়, উগ্র বল প্রয়োগের মাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বসবাসরত ভিন্ন সংস্কৃতির, বৈচিত্র্য ধারণকারী আদিবাসীদের বিষয়ে রাষ্ট্রের ধারণা সবসময়ই বৈষম্যমূলক এবং নিপীড়নমূলক। তারা চায় বাংলাদেশকে একটি নিরঙ্কুশ মুসলিম বাঙালি জাতির রাষ্ট্রে পরিণত করতে। তারা চায় এখানে নিরঙ্কুশ ইসলামীতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। বহুসংস্কৃতির, বহু ভাষা-ভাষীর দেশ নয়, বাংলাদেশ হোক কেবলমাত্র বাঙালি জাতির, এটাই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শ্রেণিটি এবং তার ভাবাদর্শের ফল হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের দাবি।